শালবন ফিরিয়ে আনতে সরকারের প্রতিশ্রুতি: সত্যি নাকি শুধুই আশ্বাস

চারজন শ্রমিক খেত থেকে আনারস তুলছেন। মধুপুর শালবন এলাকায় সর্বত্র এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। কিন্তু মধুপুর শালবনের জায়গায় গড়ে ওঠা রাবার বাগানের ভেতর এ আনারস বাগানে চমকে দেওয়ার মতো বিষয় হলো—খেতের মধ্যেই সব ফল পেকে গেছে। আসলে ফল পাকানোর রাসায়নিক হরমোন স্প্রে করে বিশাল এ বাগানের সব আনারস খেতের মধ্যেই পাকানো হয়েছে। সব ফলই গাড় হলুদ রং ধারণ করেছে। এসব আনারস বড় করতে হরমোন ব্যবহার করা হয়েছে।
আগে দেখেছি ফল কাটার পর পাকানো হরমোন স্প্রে করতে। আর এখন ফল খেতে থাকা অবস্থায় পাকানো হচ্ছে। দেখে মনে হলো—আনারসগুলো রসালো ও সুস্বাদু হবে। অনেকটা কৌতূহলবশত ১০০ টাকা দিয়ে পাঁচটি আনারস কিনলাম। ঢাকা ফেরার পথে গাড়িতে বসে একটি আনারস কাটি। আনারস রসালো বটে, তবে তা মুখে দেওয়ার মতো নয়। চামড়ার নিচে কালো এবং পচন ধরেছে। ফেলে দিলাম। ঢাকায় এসে কৌতূহলবশত আরেকটি আনারস কাটি। একই অবস্থা, ফেলে দিলাম। আমার দুই সহকর্মী ও গাড়িচালককে বাকি তিনটি আনারস দেই। তাদের দুজন জানিয়েছেন, তাদের ভাগের আনারসগুলোও পচা এবং ফেলে দিতে হয়েছে।
দিনভর চার শ্রমিক আনারস তুলবেন। তাদের সঙ্গে আনারস ক্রেতার চুক্তি, তারা ১৫ মার্চ ৪৬ হাজার আনারস তুলবেন। প্রতি হাজারে তাদের পারিশ্রমিক ৩০০ টাকা। খেতের মধ্যে পাকা আনারস স্তূপ করে রাখছেন তারা। বিকেলের দিকে ট্রাকে বোঝাই হবে এসব আনারস এবং রাতারাতি পৌঁছে যাবে ঢাকাসহ অন্য শহরে। ধারণা করতে পারি, রোজার সময় এসব আনারস দ্রুত পাকানো হয়েছে রোজাদারদের ইফতারির প্লেটে তুলে দেওয়ার জন্য।
মধুপুর শালবন এলাকায় পাঁচটি বাগানে সাত হাজার ৫০৩ একর বনভূমিতে রাবার চাষ হয়েছে। মধুপুরে রাবার চাষের সূচনা ১৯৮৬ সালে। এর উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদ। মধুপুরে শালবন পরিষ্কার করে এসব বাগান করেছে বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশন বা বিএফআইডিসি। বনবিভাগ বনের এসব জমি বিএফআইডিসিকে লিজ দিয়েছে। মধুপুরসহ বাংলাদেশের অন্য যেসব জায়গায়, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে, বিএফআইডিসি রাবার বাগান করেছে, তার সবই করেছে বনভূমিতে এবং বনজঙ্গল কেটে। রাবার চাষকে সেকারণে প্রাকৃতিক বনের জন্য মৃত্যুদণ্ড হিসেবে দেখা হয়।
রাবার গাছ আমাজন জঙ্গলের গাছ। এটিকে ইউরোপীয়রা আবিষ্কার করে এবং আমাজনের বাইরে নিয়ে আসে। আমাজন জঙ্গলে প্রতি একরে দুই-তিনটা রাবার গাছ জন্মে। ইউরোপীয়রা এ গাছটিকে এশিয়াতে নিয়ে আসে এবং এর বাণিজ্যিক আবাদ শুরু করে। বাণিজ্যিক আবাদে একরে ২০০ থেকে ২৫০টি পর্যন্ত রাবার গাছ লাগানো হয়। রাবার পণ্য পৃথিবীর অর্থনীতির চালিকা শক্তিতে পরিণত হয় এক পর্যায়ে।

বাংলাদেশে রাবার চাষের ইতিহাস বেশিদিনের নয়। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিএফআইডিসি ১৯৬২ সাল থেকে রাবার চাষে যুক্ত হয়। বর্তমানে সরকারি এ প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যক্তি, ক্ষুদ্র রাবার চাষি, পার্বত্য অঞ্চল উন্নয়ন বোর্ড এবং চা-বাগান মালিকরা সারা দেশে এক লাখ ৪০ হাজার একর জমিতে রাবার চাষ করছে।
বাণিজ্যিক রাবার চাষের একটি দিক হলো এ গাছটি রাবার উৎপাদনের জন্য ২৬ বছরের মতো সময়জুড়ে যথেষ্ট কষ উৎপাদন করতে পারে। তারপর গাছটি অনুৎপাদনশীল হয়ে পড়ে। অর্থাৎ তখন আর সে যথেষ্ট কষ উৎপাদন করতে পারে না। তখন এ গাছটি কেটে ফেলা হয় এবং আবার নতুন করে চারা লাগানো হয়। মধুপুর শালবন এলাকায় প্রথম আবর্ত শেষে ২০২৩ সালে প্রথম ১১০ একরের রাবার গাছ কাটা হয়। ২০২৪ সালে কাটা হয় ৩০০ একরের গাছ। এ বছরও ৩০০ একরের ৫১ হাজার ৮৬৯টি রাবার গাছ কাটা হচ্ছে।
গাছ কাটার পর বিএফআইডিসি তিন বছর আনারস চাষের জন্য লিজ দিচ্ছে। টেন্ডারের মাধ্যমে দেওয়া প্রতি একরের লিজমূল্য ২০২৪ সালে এক লাখ ১৩ হাজার ৫৬৫ টাকা (ভ্যাট ও ট্যাক্সসহ) ছিল বলে বিএফআইডিসি সূত্রে জানা গেছে। অর্থাৎ রাবার বাগানে আনারস চাষের জন্য বড় অঙ্কের টাকা লেনদেন চলছে। যারা লিজ নিচ্ছেন, তাদের অনেকে আবার অন্যদের কাছে বেশি টাকায় সাব-লিজ দিচ্ছেন। একদিকে আনারস চাষ হচ্ছে, অন্যদিকে রাবার চারা বাড়ছে। আনারস বড় করতে ও পাকাতে বিপুল পরিমাণ হরমোন ব্যবহার হচ্ছে। এর অবধারিত ফল স্বাস্থ্যঝুঁকি।
টাঙ্গাইল বন বিভাগীয় কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসীন হোসেইন মধুপুরের মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে বললেন, 'টাঙ্গাইলের মধ্যে মধুপুরে ক্যানসার আক্রান্ত ও বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি'। তবে রাবার গাছ কাটার পর তিন বছরের জন্য আনারস চাষিদের কাছে উচ্চমূল্যে জমি লিজ দেওয়ার বিষয়টি তিনি জানেন না। বিষয়টি তাকে জানানো হলে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে জানালেন, মধুপুরে ১৬টি হরমোন ও ১৬টি মারাত্মক ক্ষতিকর কীটনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে।

শালবনের জায়গায় রাবার চাষ এবং সেখানে আনারসের আবাদ কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং কিছু আয় সৃষ্টি করছে বটে, তবে তা প্রাকৃতিক বন এবং পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে দিয়েছে।
মধুপুরে এ বছর পুরো মার্চ মাসব্যাপী রাবার গাছ কাটা হবে। এখানে হাজারের অধিক শ্রমিক কাজ করছেন। গাছ কাটার জন্য পেট্রোলচালিত করাত ব্যবহৃত হচ্ছে। ট্রাকের পর ট্রাক রাবার গাছের সেকশন করা গুড়ি নিয়ে যাচ্ছে। একেকটি গাছের নিলামমূল্য এক থেকে দেড় হাজার টাকা। রাবার গাছ যারা অকশনে কিনে নিচ্ছেন, তা তারা পৌঁছে দিচ্ছেন আকিজ গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানের কারখানায়। রাবার গাছ কাটার পর একে বিবেচনা করা হয় লাকড়ি হিসেবে। ম্যাচের কাঠি এবং হার্ডবোর্ড তৈরির জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে রাবার গাছের কাঠ। এবার মধুপুর শালবন এলাকার তিনটি রাবার বাগানের গাছ কাটা হচ্ছে। এগুলো হলো—চান্দপুর, পীরগাছা ও সন্তোষপুর।
আগামী কয়েক বছর ধরে চলবে মধুপুরে অনুৎপাদনশীল রাবার গাছের নিধনযজ্ঞ। আর এভাবেই ইতিহাস থেকে আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যাবে হাজার বছরের ঐতিহ্য শালবনের কথা। এক সময় শালবনে ছিল বাঘ, ভাল্লুক, অজস্র ময়ূর ও হাতিসহ অসংখ্য প্রজাতির পাখি। কিছু পাখি ও বানর-হনুমান এখনো টিকে থাকলেও যেখানে রাবার চাষ হয়েছে সেখানে কোনো বন্যপ্রাণীই নজরে আসে না। মধুপুরের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামসহ অনেক জায়গাতে প্রথম আবর্তের রাবার গাছ কাটা হচ্ছে। রাবার চাষ মানেই প্রাণ ও প্রকৃতির সম্পূর্ণ বিনাশ।

রাবার চাষের পাশাপাশি বিদেশি প্রজাতি বিশেষ করে ইউক্যালিপটাস ও আকাশিয়া দিয়ে সামাজিক বনায়ন, যা আসলে মনোকালচার, মধুপুর শালবনসহ সর্বত্র শাল-গজারি বনের অপূরণীয় ক্ষতি করে দিয়েছে। উল্লেখ্য, প্রথম আবর্তের পর ইউক্যালিপটাস লাগানো বন্ধ করা হয়। শালবনের বাইরে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের কোনো কোনো জায়গায় অপূরণীয় ক্ষতি করে দিয়েছে সামাজিক বনায়ন। তবে সবসময় আলোচনায় আছে মধুপুর শালবন। কারণ মধুপুর শালবনের মধ্যে গ্রামগুলোতে বাস করেন ২০ হাজারের অধিক গারো ও কোচ। আর এখানে বাঙালি বাস করে এই দুই জাতিগোষ্ঠীর দ্বিগুণ। গারো, কোচ ও বাঙালিদের ৯০ শতাংশের মতো পরিবারের ভিটেমাটি ও চাষাবাদের জমির মালিকানা দলিল নেই। সামাজিক বনায়নের সুযোগে মধুপুর শালবনের সর্বত্র মানুষের দখলে থাকা ভূমিতে ব্যাপক কলা ও আনারস চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৭ সালের হিসাবে টাঙ্গাইল জেলায় ২০১৬-২০১৭ সালে আনারস উৎপাদন হয়েছে এক লাখ ২০ হাজার ৩৫২ মেট্রিক টন, যা কিনা দেশের মোট উৎপাদিত আনারসের অর্ধেকের বেশি। আর এর সিংহভাগ এসেছে মধুপুর শালবন থেকে। সরকারি হিসাবে তখন মধুপুরে আনারস চাষ হয়েছিল ১৬ হাজার ৫৭৫ একর জমিতে। গত বছর থেকে রাবার বাগানে আনারসের চাষ যেভাবে শুরু হয়েছে, তাতে ধারণা করা হয় বর্তমানে আনারস চাষ আরও বেড়েছে।
মধুপুর শালবনে কলা চাষও ব্যাপকভাবে হচ্ছে। মধুপুরে কলা চাষের ব্যাপকতা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবেই সুস্পষ্ট। ২০১৬-২০১৭ সালে ঢাকা বিভাগে পাকা কলা উৎপাদন হয়েছে এক লাখ ৮৩ হাজার ৬১৫ মেট্রিক টন। এর মধ্যে কেবল টাঙ্গাইল জেলাতেই উৎপাদন হয়েছে ৯২ হাজার ৮৮৮ টন। বলা চলে মধুপুর শালবনই টাঙ্গাইল জেলার কলা চাষের কেন্দ্র।

সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (সেড) তিন দশকের অধিককাল ধরে মধুপুরে রাবার চাষ, সামাজিক বনায়ন, আনারস, কলা ও মসলা চাষের ওপর গবেষণা করছে, অনুসন্ধান চালাচ্ছে এবং প্রকাশ করেছে গ্রন্থ, অনুসন্ধানী রিপোর্ট এবং তৈরি করেছে তিনটি প্রামাণ্য চিত্র। সেড সবসময় দেখিয়েছে, রাবার চাষ ও সামাজিক বনায়ন এবং তার সূত্র ধরে কলা, আনারস ও মসলার চাষ কীভাবে শালবনকে গ্রাস করেছে এবং শালবনের ঐতিহ্য প্রায় সর্বাংশে বিনষ্ট করেছে। সেডের গবেষণার ফলাফল ও অন্যান্য কারণে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশসহ এশিয়াতে বনখাতে সমস্ত বিনিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকও বনখাতে বিনিয়োগ একেবারে কমিয়ে দিয়েছিল। বিশ্বব্যাংক আবার বড় ধরনের প্রকল্প সাহায্য নিয়ে ফিরে আসে। বিশ্বব্যাংকের ১৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রকল্প টেকসই বন ও জীবিকা, যা সুফল নামে পরিচিত, এযাবতকালের বাংলাদেশের বনখাতে সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এ প্রকল্প শুরু হয়েছে ২০১৮ সালে আর শেষ হচ্ছে এ বছর। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, বিশ্বব্যাংক, ইউএসএইড এবং আরও কিছু দাতা সংস্থা যে ভুল কৌশল অবলম্বন করে বনখাতে বিনিয়োগ করেছে এবং তার ফলে যে বন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সে কথা সেড তার প্রকাশনা ও প্রামাণ্য চিত্রে দেখিয়েছে।
দেরিতে হলেও বনবিভাগের কর্মকর্তারা স্বীকার করছেন যে, সামাজিক বনায়নের কারণে প্রাকৃতিক বন ব্যাপকভাবে নষ্ট হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা এবং বনবিভাগ বলছে, সামাজিক বনায়নে আকাশিয়া লাগানো ভুল হয়েছে। তবে সামাজিক বনায়ন করতে গিয়ে এলাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে সহ-ব্যবস্থাপনার যে মডেল তৈরি হয়েছে, সেটা যে ভালো কাজ হয়নি—এমন কথা তারা বলছেন না। বরং তারা 'সহ-ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মধুপুর গড়ের শালবন পুনরুদ্ধার' বিষয়ক কর্মশালা করেছেন। সামাজিক বনায়নের মধ্যে সহ-ব্যবস্থাপনাটাই যে বিতর্কিত, সেই কথা তারা বলছেন না। সরকার ও বনবিভাগ মধুপুর শালবন পুনরুদ্ধার করতে চাইছে। কিন্তু আজকের পরিস্থিতির জন্য যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, বিশ্বব্যাংক, ইউএসএইড ও অন্যরা দায়ী, সেই ব্যাপারে তারা নিশ্চুপ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজিমুদ্দিন খান তার পিএইচডি থিসিস করেছেন বাংলাদেশের গ্যাস, বন ও জীবিকা (দ্য প্রজেক্ট ইন বাংলাদেশ: গ্যাস, ফরেস্ট অ্যান্ড লাইভলিহুড) নিয়ে। তিনি সহ-ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে পাঁচটি সংরক্ষিত এলাকার (লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান, চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও টেকনাফ বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রম) ওপর গভীর অনুসন্ধান চালিয়েছেন। এসব জায়গায় সহ-ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তার মূল্যায়ন হলো, সহ-ব্যবস্থাপনায় সব অংশীজনের সমান অংশগ্রহণ থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি ও সহ-ব্যবস্থাপনা পরিষদে স্থানীয় প্রভাবশালীরা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেছেন। বন রক্ষার চাইতে তারা তাদের নিজেদের স্বার্থ বেশি করে রক্ষা করেছেন। ইকো-ট্যুরিজম, পিকনিক স্পট ব্যবস্থাপনা, মাছচাষ—এসব থেকে তারা বেশি লাভবান হয়েছেন।
বন রক্ষায় সহ-ব্যবস্থাপনা নিঃসন্দেহে বিতর্কিত। যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এডিবি ও বিশ্বব্যাংক) এবং দ্বিপাক্ষিক দাতা সংস্থা (যেমন: ইউএসএইড) প্রকল্প সাহায্য ও অনুদান দিয়েছে, তাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্যই কি বনবিভাগ প্রাকৃতিক বন রক্ষা, সামাজিক বনায়ন ও রাবার চাষের জায়গায় শালবন রক্ষা করার কথা বলছে? তা না হলে বিশ্বব্যাংক থেকে পাওয়া বিপুল অর্থে প্রাকৃতিক বন রক্ষার যে কার্যক্রম গত ২০১৮ সাল থেকে চলছে, সে ব্যাপারে তারা কথা বলতেন। বিশ্বব্যাংকের এক উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা (নাম উল্লেখ করা হলো না) বলেছেন যে, প্রাকৃতিক বন পুনরুদ্ধারে বনবিভাগ যেসব গাছ লাগিয়েছে, তার ২০ শতাংশ বা তার কম বেঁচে আছে। বনবিভাগ প্রাকৃতিক বন ফিরিয়ে আনার যে অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে, তাহলে তা কি অবাস্তব?
বন রক্ষার জন্য যা কিছু বলা হচ্ছে, তা পরিষ্কার নয় বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক বন সংরক্ষক মো. ইউনুস আলী। তিনি বলেন, 'মধুপুর ও গাজীপুরে সামাজিক বনায়নের যেসব জায়গার শালবন বিলীন হয়েছে, সেসব জায়গায় শালবন ফিরিয়ে আনতে হলে সুস্পষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। তার জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।'

আমরা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ও বনবিভাগের সদিচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু তাদের কাছে কি খবর নেই যে যেসময় গাছ থেকে পেরেক তোলার কর্মসূচি পালিত হচ্ছে (শেরপুরের জেলা প্রশাসক ১২ মার্চ বন বিভাগের সঙ্গে এ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন), সেসময় মধুপুরে হাজারের বেশি শ্রমিক হাজারো রাবার গাছ কাটছেন? বিএফআইডিসি সেসব জায়গায় এ বছর আবারও রাবার গাছের চারা রোপণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিএফআইডিসির নার্সারিগুলোতে হাজারো চারা তৈরি হয়ে আছে।
এ সময় টাঙ্গাইল ও গাজীপুর জেলার অনেক জায়গায় সামাজিক বনায়নের তৃতীয় আবর্তের আকাশিয়া গাছ কাটা হচ্ছে। সামাজিক বনায়নের যেসব প্লট কাটা হয়েছে, সেসব এখন বৃক্ষশূন্য। সেখানে টপসয়েল বলতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। সামাজিক বনায়নের অংশীদাররা আবারও আকাশিয়া গাছের চারা লাগাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাদের কাছে কোনো খবর পৌঁছায়নি যে, এবার যেখানে গাছ কাটা হচ্ছে সেখানে শালগাছের চারা লাগাতে চায় বনবিভাগ। কোথাও শালের চারা তৈরির কোনো নার্সারিও গড়ে ওঠেনি। কাজেই প্রাকৃতিক বন ফিরিয়ে আনার সরকারের অভিপ্রায় কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তা বোধগম্য নয়।
প্রাকৃতিক বন আমাদের নিরাপদ খাবারের একটি উৎস। বন ও বননির্ভর শিল্প আমাদের আয়, ঘরবাড়ি তৈরি ও মেরামতের উপকরণ এবং কর্মসংস্থান দিয়ে থাকে। তবে তা যদি হয় বনভূমির মাটি ও প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস করে, তবে আমরা কালক্রমে আমাদের বাঁচার মূল উৎস হারাব। আমাদের সরকার ও বনবিভাগ দাতা দেশের অর্থ ও পরামর্শ নিয়ে বনভূমিতে এমন বনায়ন অর্থনীতির পৃষ্ঠপোষকতা করছে যে, প্রাকৃতিক বন ফিরিয়ে আনার যে কথা আমরা সরকারি উচ্চমহল থেকে শুনছি, তা বাস্তবসম্মত মনে হচ্ছে না।

এ ধরনের অঙ্গীকার ও আশ্বাস চলছে ১৯৯২ সালের ধরিত্রী সম্মেলনের সময় থেকে। যে সময় পৃথিবীকে গাছে গাছে ভরে ফেলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন বিশ্বনেতারা, সে সময়ই প্রাকৃতিক বৃক্ষনিধন হয়েছে বেশি। কারণ বনায়ন অর্থনীতি ঘিরে তৈরি হয়েছে নানা স্বার্থগোষ্ঠী, যারা প্রাকৃতিক বন ফেরাতে চাইবে না। আমাদের সরকার ও তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যদি সত্যি সত্যি প্রাকৃতিক বন রক্ষা ও ফিরিয়ে আনতে আন্তরিক হয়, তবে সবপক্ষ, বিশেষ করে বনজীবীদের সঙ্গে নিয়ে সঠিক কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। বনবিনাশের প্রকৃত কারণ বিশ্লেষণ করতে হবে এবং প্রকৃতির বিরুদ্ধে যারা নানা কৌশলে অপরাধ করেছে, তাদেরকে থামাতে হবে। কঠিন কাজ, কিন্তু অসম্ভব নয়।
ফিলিপ গাইন: গবেষক ও সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউমেন ডেভেলপমেন্টের (সেড) পরিচালক
(সেডের গবেষণাকর্মী ফাহমিদা রহমান, ঝিদিত চাকমা, সামান সাদ ও প্রবীন চিসিম লেখককে মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহে সহায়তা করেছেন)
Comments