শিল্পকলা একাডেমি: ঢাকার বুকে এক চিলতে সাংস্কৃতিক পুণ্যভূমি
সেগুনবাগিচার পুরোনো পাড়ায়, রমনা পার্কের সবুজে ঘেরা প্রাচীরের এক ধারে থাকা বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি সবসময়ই যেন থিয়েটার দেখা হোক বা বিভিন্ন প্রদর্শনী, সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামের আঙিনা হয়ে থেকেছে। ঢাকায় অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত চারুকলা ও পারফর্মিং আর্টসের জন্য একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
আমার এখনো মনে আছে প্রথম কখন শিল্পকলায় গিয়েছিলাম। সত্তরের দশকের শেষের সময়। তখন একদল চিনা সাংস্কৃতিক দল ঢাকায় অনুষ্ঠান করতে এসেছিল এবং তাদের নরম, মৃদু স্বরে তারা বাংলা গান গেয়েছিল। এ ছাড়াও বিভিন্ন অ্যাক্রোব্যাটের অবিশ্বাস্য সব লম্ফঝম্প, রাশিয়ান শিল্পীদের গান ও নাটকের মহড়া ইত্যাদিতে চঞ্চল হয়ে উঠেছিল দর্শকপাড়া। আজ এত বছর পরও এই স্থানটা সেসব প্রিয় গন্ধই মেখে আছে।
শিল্প-সংস্কৃতির জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা করে দেওয়া এবং এর যথাসাধ্য উন্নয়ন ঘটানোই মূলত এই একাডেমির কাজ। একাডেমির কর্মসূচির মধ্যে বিভিন্ন কর্মশালা, সেমিনার, আলোচনা সভা, স্বল্পমেয়াদি বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ, শিক্ষাবৃত্তি প্রদান, প্রতিভাবান শিল্পীদের জন্য আর্থিক অনুদান জোগাড় করে দেওয়া, শৈল্পিক বহু ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা আয়োজন—এ সবই রয়েছে।
এই জায়গাটা এখন যেন বহু গ্যালারি, থিয়েটার ও সেমিনার হলের এক গোলকধাঁধায় পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া যখন যে নাটকই চলুক না কেন, তার টিকিটের জন্য সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ভিড় দেখার মতো। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি, কোনো মৌসুমেই শিল্পকলার প্রদর্শনীগুলো খালি পড়ে থাকে না কখনো।
আমাকে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আনন্দ দেয়, তা হচ্ছে এই যে—শিল্পকলায় আজও ছুটে আসে এক ঝাঁক তারুণ্যের ভিড়। আর এ প্রাঙ্গণে প্রায় সবসময়ই একাধিক নাটক, প্রদর্শনী ও কর্মশালার রমরমা বজায় থাকে। শিল্পচর্চার কোর্স, আবৃত্তি, নৃত্যনাট্য— যা কিছু রয়েছে শিল্প সম্পর্কিত—শিল্পকলা একাডেমিই সঠিক গন্তব্য।
শিল্পকলায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিয়মিত আসা-যাওয়া রয়েছে আজিজা আহমেদের। তিনি নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে বলেন, 'আসলে বড় হলগুলোর মধ্যে একজন শিল্পীর চমক আরও বেশি ফুটে ওঠায় "লার্জার দ্যান লাইফ" অভিজ্ঞতা দেয়। তরুণ পরিচালকদের বিভিন্ন নিরীক্ষামূলক কাজের সুফল তো সম্প্রতিই এসব হলের মধ্যে পাওয়া গিয়েছে। এ ছাড়াও অভিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ পরিচালকরা তাদের উচ্চমার্গীয় নাটকগুলোর জন্যও শিল্পকলাকেই প্রথম পছন্দ হিসেবে বেছে নেন। ডেটে যাওয়া হোক বা বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সুন্দর সময় কাটাতে—শিল্পকলা সবকিছুতেই মানানসই। আমি তো মা দিবসে আমার মাকে নিয়েও এখানে নাটক দেখতে গিয়েছিলাম।'
তবে প্রশংসার পর কিছু পরামর্শের দিকেও নজর দিতে হয়। মেহের নিগারের মতো নিয়মিত দর্শকের ধারণা এই যে, এক্সপেরিমেন্টাল হলটা নতুন করে ঢেলে সাজানো দরকার। এতে প্রয়োজন আরও আধুনিকীকরণের ছোঁয়া। বসার ব্যবস্থাও নতুনভাবে করা উচিত।
অন্যদিকে এনবি মনসুর আহমেদ বরং এই আমেজেই সমমনা মানুষদের সঙ্গে এই শৈল্পিক আবহ উপভোগ করতেন, যাদের সমানতালে আগ্রহ রয়েছে নাটক, সিনেমা, সংগীত, কবিতা কিংবা চিত্রকলায়।
ওদিকে মেহের নিগার আরও জানান, 'কোনো একটা পারফরম্যান্সের একেবারে মাঝখানে যদি কাঠের মঞ্চে হুট করে "ক্যাঁচ" করে শব্দ হয়, তবে নাটক থেকে মনোযোগ সরে যায়। আমি মনে করি একাডেমির পারফর্মিং আর্ট আয়োজনের এসব পুরোনো হলগুলোকে একটু আধুনিক করে তোলার জন্য সরকারি অনুদান প্রয়োজন। তবে সে যা-ই হোক, এক্সিবিশন হলগুলো একেবারে নতুন অবকাঠামোয় গড়ে তোলা হয়েছে, তা নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই।'
শিল্পকলার ওয়েটিং লাউঞ্জে এখনো যেন আশির দশকের ময়লা পড়ে আছে। দেয়ালে ঝুলন্ত মাকড়সার ঝুল একে আরও বেশি অলস আর একঘেয়ে করে তোলে। এই জায়গাটিকে সমসাময়িক ও আধুনিক একটা চেহারা দিতে ইন্টেরিওর কনসালটেন্টের সঙ্গে আলাপ করা উচিত।
আহমেদ মনে করেন, 'এখানে শৌচাগারের ভালো সুযোগ-সুবিধা থাকা উচিত এবং পুরোনো ক্যানটিনের সেই চা-শিঙারা ছাড়াও একটু ভালো ফুড কোর্ট দরকার। সেইসঙ্গে সামগ্রিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর দেওয়াটাও খুব জরুরি।'
তবে শিল্পকলার আশেপাশের এলাকা কিন্তু পুরোটাই তেলে ভাজা পিঁয়াজু-বেগুনি আর ডালপুরির মতো চনমনে। শুধু কি তাই? কোনো কোনো স্টলে মিলে যায় হাঁসের মাংস, রুটি, কাবাব-ঝাল ফ্রাই আরও কত কী! চাইলে কেউ নিতে পারেন চাওমিন বা নুডলসও। ডাবের জল, নয়তো গরম চায়ের সঙ্গে হাপিস করে দেবার খাবারের অভাব নেই এখানে।
তাই পরের বার যখন একেবারে একঘেয়ে সময় কাটবে, তখন একবার মনে করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ঘুরে আসবেন কিন্তু! ঢাকার বিনোদনমহলে এমন আকর্ষণীয় স্থানের অভাব নেই, শুধু ঠিকঠাক খোঁজ-খবর রাখতে পারলেই হলো!
অনুবাদ করেছেন অনিন্দিতা চৌধুরী
Comments