সাহিত্য সংস্কৃতিতে বিপ্লবের দায় ও মুক্তি

বিপ্লবের কোনো দেশ নেই। একটি জনগোষ্ঠী দ্বারা সংঘটিত হলেও, তাতে আছে সবার অধিকার। বিপ্লব একটি বাস্তব ঘটনা, যা ঘরে বসে হয় না। অনলাইন এক্টিভিজম মনোজাগতিক পরিবর্তনে দরকার হলেও, মাঠে থাকার বিকল্প নেই। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ থেকে ২০২৪-এর অভ্যুত্থানের প্রধান স্পিরিট পরিবর্তন। কেনো বা কার জন্য এ-পরিবর্তন? বিপ্লবে শিল্পসাহিত্য কাজে আসে? বিপ্লব-পরবর্তী শিল্পীদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত? উত্তর একবারে দেওয়া কঠিন।

বিপ্লব নষ্ট-খল-দুষ্টচক্র থেকে পরিত্রাণের জন্য জীবনবাজি। বিপ্লবীদের সঙ্গে সমীকৃত বোধ করে জনমানুষ। করবে না কেনো, বিপ্লব তো তাদেরই জন্য। তবে গণমানুষের মুক্তি আপেক্ষিক, ইতিহাস যা বলে। তাহলে বিপ্লব কি একটা রোমান্টিক বিষয়? তা কি একটা নির্দিষ্ট দেশের মানুষের কথা বলে? নবারুণ ভট্টাচার্যের মতে, 'দেশ বলতে শুধু ভৌগোলিক সীমারেখাকেই বোঝায় না— বোঝায় জনগণের হৃদয়ভূমিকেও'। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোতে জনগণের অংশীদারিত্ব শতভাগ। স্বৈরাচারী শাসকেরা তা অস্বীকার করতে চায়। বন্দুকের নল, বারুদ ও কামানের আঘাতে ছিন্নভিন্ন করে দিতে চায়। পরিবর্তনকামীদেরকে তারা পরস্পরবিচ্ছিন্ন করে দিতে চায়। বিপ্লবের সাহিত্য-সংস্কৃতি সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জনগণের আশাকে তা জাগিয়ে রাখে, উদ্দীপ্ত করে, নবজীবনে আহ্বান করে। পুনশ্চ নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতা স্মর্তব্য, ২৪-এর অভ্যুত্থানে তা উজ্জীবিত করেছে: "এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না/এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না/এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না/এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না।" লক্ষণীয়, এখানে দেশকে অস্বীকার নয়, নিহিতার্থে আষ্টেপৃষ্ঠে ধারণ করা।

জনগণের জন্যই রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের জন্য জনগণ নয়। তাদের মতের প্রতিফলন ছাড়া রাষ্ট্রব্যবস্থা ব্যর্থ। বিপ্লবের মাধ্যমে জনগণ পরিবর্তনের রোমান্টিক স্বপ্ন দেখে। বিপ্লব-পরবর্তী শাসকের মনোভাব একে রক্ষা কিংবা ভূলুণ্ঠিত করে। বিপ্লব ব্যর্থ হলে সময়ে জনগণ আবার সংঘটিত হয়, রক্ত ঝরায়। চক্রান্তকারীরা বিপ্লবের পর উপপ্লবের ঝামেলায় ফেলতে পারে। পূর্ববর্তী তল্পিবাহকেরা বিপ্লব-নস্যাতে নারকীয় ভূমিকা রাখতে দ্বিধাবোধ করে না।

১৭৭৫-৮৩ আমেরিকান বিপ্লবের সময়, পিউরিটান সাহিত্যকাঠামোর বাইরে চলে যান শিল্পীরা। নতুন অভিজ্ঞতায় তৈরি হয় নতুন শৈলী। ঔপনিবেশিক যুগের সাহিত্য মানে ছিল নিউ-ইংল্যান্ডের দৈনন্দিন জীবন-বর্ণনা। উপনিবেশবাদীরা তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা-অনুসন্ধান ও আশাবাদ জারি রাখে। ব্যবহারিক জীবনে রাজনৈতিক চালাকির মাধ্যমে তা পরিবেশনের চেষ্টা করে। বিশুদ্ধতাবাদী প্রোটেস্ট্যান্টরা এর বিরোধিতা শুরু করেন। তারা ইংল্যান্ডের চার্চ ও তথাকথিত নীতি-আদর্শের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে সরল করে, যথাযথভাবে পালনের মধ্য দিয়ে নতুন সমাজের প্রতিষ্ঠা চান। বিজ্ঞানচিন্তা, আবিষ্কার, প্রকৃতিচেতনা, স্বাধীনতার ধারণাও বদলে যায়। ঔপনিবেশিক মূল্যবোধ পরিবর্তিত হয়ে চালু হয় নতুনধারা। চৈতন্যের আমূল বদলে বিপ্লবের প্রকৃত ফসল ঘরে ওঠে।

আমেরিকান বিপ্লবের আগে বাচ্চাদের স্কুলের বই আমদানি করা হতো ইংল্যান্ড থেকে। সেগুলো কেবলই ধনী ব্যক্তিদের জন্য উপলব্ধ ছিল। এগুলোতে নাকি কঠোর পরিশ্রম ও আত্ম-উন্নতির উপর জোর ছিল। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসক-পরিচালিত এই শিক্ষাব্যবস্থা তেমন কাজে আসেনি। বিপ্লবোত্তর কালে সঙ্গীত ও চিত্রশিল্পের জগতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ইংরেজ-বংশোদ্ভূত রাজনৈতিক লেখক টমাস পেইন 'কমন সেন্স' নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। এ-কাজটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাতে সাম্য-স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখার মন্ত্র ছিল। তাঁর কাছে স্বাধীনতার অর্থ ছিল বিশুদ্ধ 'সাধারণ জ্ঞান'। বিপ্লবের বড় পরিচয় পূর্বের শেকড় তুলে ফেলা। এ-বিপ্লবে সংবাদপত্রগুলোও যথার্থ ভূমিকা গ্রহণ করে।

১৭৫০-এর পূর্বে মার্কিন ধনীরা বাড়ির আসবাব থেকে শিল্পকর্ম সবই আমদানি করতো। বিপ্লবের পর নিজস্ব পণ্য-উৎপাদনের হিড়িক পড়ে। ভিন্ন স্বাদ ও শৈলীর জিনিসপত্র প্রশংসাও কুড়ায়। এভাবে একটা নতুন দেশ সমৃদ্ধির দিকে যায়। পূর্বের চেয়ে বর্তমান-ব্যবস্থা ভালো—শুধু কথায় নয়, কাজেও প্রমাণ দিতে হয়। শিল্পকলা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার নতুন জীবনের স্বাদ এনে দেয়। সন্তানরা অধিকার পায় নিজস্ব চিত্রকলা, কবিতা, সঙ্গীত, স্থাপত্যবিদ্যাসহ নানাকিছু অধ্যয়নের। জন অ্যাডামস বিশ্বাস করতেন, শিল্পকলা ও ব্যবহারিক জীবন পাশাপাশি চলতে হবে। 'এ বায়োগ্রাফি ইন হিজ ওন ওয়ার্ডস'-এ তিনি ঘোষণা করেন: "আমাকে অবশ্যই রাজনীতি ও যুদ্ধ অধ্যয়ন করতে হবে, যাতে আমার ছেলেরা গণিত ও দর্শন, ভূগোল, প্রাকৃতিক ইতিহাস, নৌ-স্থাপত্য, নৌচলাচল, বাণিজ্য ও কৃষি বিষয়ে অধ্যয়ন করতে পারে।"

ইংল্যান্ডে ১৭৯৮-তে ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজ 'প্রিফেইস টু দ্য লিরিক্যাল ব্যালাডস' লিখে সূচনা করেন সাহিত্যে নতুন একটি বিপ্লবী যুগ। উচ্চবিত্তের আধিপত্য কমিয়ে সাধারণ ও নিপীড়িতের জন্য সাহিত্যরচনার অভিমত প্রকাশিত হয়। এভাবে বইটি হয়ে ওঠে শিল্পীদের বিপ্লবমন্ত্র, যা রোমান্টিক যুগেরও সূত্রপাত ঘটায়। ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো পুরনো জাল কেটে গণতন্ত্রের পথে চলতে শুরু করে। ইউরোপের ইতিহাস-পাঠে এই দীর্ঘযাত্রা স্পষ্ট হয়। শিল্পী-সাহিত্যিকরা সেখানে পালন করেছেন ব্যাপক ভূমিকা। উপনিবেশের দরুণ আমরা পশ্চিম-ইউরোপীয় সাহিত্য সম্পর্কে কমবেশি জ্ঞাত। অর্থোডক্স চার্চের অযৌক্তিক রুদ্ধদ্বার থেকে মুক্তি পেতে পি.বি. শেলিকে দেশান্তরে যেতে হয়। আলোকায়ন ও ফরাসিবিপ্লব তাঁকে গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখায়। 'প্রমিথিয়ুস আনবাউন্ড' এই স্বপ্ন ও কল্পনার প্রতিচ্ছবি।

১৭৮৯ সালে সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার ফরাসিবিপ্লব ইউরোপীয় সাহিত্য, বিশেষত ইংরেজি সাহিত্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লব বিশ্বসাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ভাবাদর্শিক প্রভাব ফেলে। সুকান্তের মতো নিতান্ত অল্পবয়সী কবি ব্যবস্থা-বদলের জন্য বারুদ হয়ে ওঠেন : আমি একটা ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি/এত নগণ্য, হয়তো চোখেও পড়ি না;/তবু জেনো/মুখে আমার উসখুস করছে বারুদ—/বুকে আমার জ্বলে উঠবার দুরন্ত উচ্ছ্বাস;/ আমি একটা দেশলাইয়ের কাঠি। ১৯৩০-এ বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে সূচিত হয় এক বিপ্লবীকাল। কাজী নজরুল ইসলাম অবশ্য স্বকীয়ভাবে তার আগেই বৈপ্লবিক পটভূমি তৈরি করছিলেন। ১৯২১-এর দিকেই তিনি শ্রমজীবী মানুষের বঞ্চনাকে সাহিত্যের অবলম্বন করেন। 'বিদ্রোহী', শেকল ছেঁড়ার গান', 'কুলি ও মজুর' প্রভৃতি কবিতা বৈপ্লবিক চেতনামুখি করে।

বলশেভিক পার্টির ক্ষমতা-গ্রহণে রাশিয়ায় কৃষিব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়। ভূমিহীন কৃষকরা সুষমবণ্টনের বহু প্রতিশ্রুত ফল পায়। উৎপাদন ও ভোগের নতুন সংস্কৃতি তৈরি করে তারা। তবে শ্রেণিশত্রুরা মানবিক রাষ্ট্রযন্ত্রকে অঙ্কুরে বিনাশ করতে চায়।

তিনি 'কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল' বাংলায় রূপান্তর করে লেখেন, "জাগো অনশন বন্দী ওঠরে যত/জগতের লাঞ্চিত ভাগ্যাহত জাগো।" প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, বলশেভিক বিপ্লব, ভারতে ব্রিটিশবিরোধী ও অসহযোগ আন্দোলন, তুরস্কের কামাল পাশা— বৈপ্লবিক সব পটভূমি নজরুলকে 'বিদ্রোহী' কবিতা লেখায় প্রভাবিত করে। তিনি হয়ে ওঠেন উপমহাদেশের মজলুমদের পক্ষের শক্তি, বিপ্লবী ও কলমযোদ্ধার উচ্চতর প্রেরণা। শরৎচন্দ্র বহু বিপ্লবীকে রিভলভার, বন্দুকের গুলি ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করতেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের নায়ক বিপ্লবী সূর্যসেনকে তিনি অর্থসাহায্য করেন। বিপ্লবের অভিজ্ঞতার জেরেই তাঁর 'পথের দাবী'র সব্যসাচী চরিত্র সৃষ্টি।

বলশেভিক পার্টির ক্ষমতা-গ্রহণে রাশিয়ায় কৃষিব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়। ভূমিহীন কৃষকরা সুষমবণ্টনের বহু প্রতিশ্রুত ফল পায়। উৎপাদন ও ভোগের নতুন সংস্কৃতি তৈরি করে তারা। তবে শ্রেণিশত্রুরা মানবিক রাষ্ট্রযন্ত্রকে অঙ্কুরে বিনাশ করতে চায়। নিজেদের মধ্যেও শুরু হয় প্রভূত মতদ্বন্দ্ব। ফলে সম্ভাবনাময় একটি বিপ্লব একসময় বেহাত হয়ে যায়। বিশ শতকে ৩০-এর দশকে হিটলারের প্রভাবে ইউরোপজুড়ে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটে। ১৯৩৬-এ ফ্রান্সের আক্রমণ থেকে স্পেনকে সমুন্নত রাখতে বিশ্বের সচেতন মানুষ, সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী-বুদ্ধিজীবী স্পেনে সমবেত হতে থাকেন। স্পেনযুদ্ধ চিলির কবি পাবলো নেরুদাকে সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দেয়। 'শিল্পের জন্য শিল্প' স্লোগানের পরিবর্তে তিনি হয়ে ওঠেন গণচৈতন্যের কবি। ক্রিস্টেফার কডওয়েল, র‌্যাল্ফ ফক্সের মতো তাত্ত্বিক এ-যুদ্ধে শহীদ হন।

যুদ্ধ করতে করতে আন্দালুসিয়ার পর্বতমালার অরণ্যে হারিয়ে যান কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা। তাঁদের আত্মদান নিয়ে সোমেন চন্দ লেখেন কবিতা 'শুভদিনের সংবাদ শোন'— 'রালফ্ ফক্সের নাম শুনেছো?/ শুনেছো কডওয়েল আর কনফোর্ডের নাম?/ ফেদরিকো গার্সিয়া লোরকার কথা জান?/এই বীর শহিদেরা স্পেনকে রাঙিয়ে দিল,/ সবুজ জলপাই বন হলো লাল,/ মার – বুক হল খালি –/ তবু বলি, সামনে আসছে শুভদিন।' কিন্তু স্পেন-গৃহযুদ্ধে তাঁদের মৃত্যুসংবাদ বেমালুম চেপে যায় ব্রিটেনের গণমাধ্যম।

বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতিতে এই কাল প্রতিবেশের প্রভাব পড়ে। ১৯৩৮-এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হয় 'প্রগতি লেখক সংঘে'র দ্বিতীয় সম্মেলন। মুলকরাজ আনন্দ, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখের নেতৃত্বে খ্যাতনামা শিল্পীসাহিত্যিকরা এতে যোগ দেন। 'অগ্রণী' পত্রিকার মধ্য দিয়ে নতুন ভাবধারা ও সংস্কৃতির প্রসার জনমনে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। সোমনাথ লাহিড়ী, গোপাল হালদার, ভবানী সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সমর সেন, চিন্মোহন সেহানবীশের লেখার পাশাপাশি রোঁলা, জিঁদ, কডওয়েল, রালফ ফক্স প্রমুখের লেখায় সমৃদ্ধ হয় 'অগ্রণী'। ইতোমধ্যে ২য় বিশ্বযুদ্ধ আর ফ্যাসিবাদী তাণ্ডবে ইউরোপ প্রকম্পিত। ঢাকা থেকে বের হয় প্রগতিশীল সাহিত্য-সংকলন 'ক্রান্তি'। রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন প্রমুখ এক নতুন সাহিত্য-আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৪২-এ ঢাকায় ফ্যাসিবিরোধী মিছিলে তরুণ লেখক সোমেন চন্দ্রকে হত্যা করা হয়। ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক-শিল্পীর মধ্যে আরও ছিলেন মনীন্দ্র রায়, গোলাম কুদ্দুস, নরহরি কবিরাজ, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, শওকত ওসমান, আহসান হাবীব প্রমুখ।

চট্টগ্রামের সোমনাথ হোর ও জয়নুলের দুর্ভিক্ষের ছবি আলোড়িত করে সারা বাংলা। লোককবি রমেশ শীলের গান সর্বস্তরের মানুষে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ভারতীয় 'গণনাট্য সংঘ' ও 'আইপিটিএ' পরিবেশিত নাটক দর্শকদের মাতিয়ে তোলে। এদিকে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার মুখেও সত্যেন সেন ও রণেশ দাশগুপ্ত বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। '৫২-র ভাষা-আন্দোলন, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ২০২৪-এর অভ্যুত্থানকেন্দ্রিক বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি এক বৈপ্লবিক ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর।

১৯২০ সালে বসন্তের দুর্ভিক্ষে চীনজুড়ে গণবিদ্রোহের সূত্রপাত হয়। সরকার নির্যাতন ও দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। মাও-এর উপলব্ধি ছিল, 'এই বিদ্রোহীরা অতি সাধারণ মানুষ, অবিচার এদের জীবনকে পঙ্গু করে রেখেছে।' বন্দুক দিয়ে দমন করা যায় না—চীনের ইতিহাস সাক্ষী। গণজাগরণ যে-বিপ্লব বয়ে আনে, তাতেই গড়ে ওঠে জনতার শিল্পসংস্কৃতি। বাংলা ভাষায় মাও-এর কবিতার বিস্তার ঘটে। কবি বিষ্ণু দে প্রথম মাও-সে-তুংয়ের কবিতা অনুবাদ করেন। সন্দীপ সেনগুপ্ত, কমলেশ সেন, জয়ন্ত চৌধুরী, অমল দত্ত, ফয়েজ আহমদসহ অনেকে অনুবাদ করেন। মাও-এর 'লংমার্চ' কবিতা হয়ে ওঠে বিপ্লবীদের হাতিয়ার। বিপ্লব-রূপান্তরিত সংস্কৃতিকে মাও-সে–তুং নয়া সংস্কৃতি বলে উল্লেখ করেন। পুরনো সংস্কৃতির প্রতিক্রিয়াশীল অংশ বর্জন করে নতুন রাজনীতি-অর্থনীতির পথে হাঁটতে চেয়েছেন তিনি, বোঝাতে চেয়েছেন, জনবিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশ ও বিস্তার অসম্ভব।

জনসাধারণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনকে তিনি সর্বাগ্রে গণ্য করেন। এজন্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির মাধ্যমে চিন্তাধারা পরিবর্তনের কাজ করেছেন। জনগণের সঙ্গে মিশে, জনগণের ভাষায়, তাদের বোধগম্য সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার কথা বলেছেন। তাঁর ধারণা ছিল এখান থেকেই উঠে আসবে জনতার কথা, মুক্তির বার্তা। মতাদর্শ কখনও ব্যক্তনির্ভর। আলবেনিয়ার কালো অধ্যায় তৈরি হয়েছিল কমিউনিস্ট শাসক এন হোক্সা'র মাধ্যমে। স্বৈরশাসনের বিপন্ন বাস্তব-পরিস্থিতিকে মুক্তিকামী লেখক ইসমাইল কাদারে 'দ্য জেনারেল অব দ্য ডেড আর্মি'(১৯৬৩), 'দ্য প্যালেস অফ ড্রিমস' (১৯৮১)-এর মাধ্যমে তুলে ধরেন। তাঁর ভাষায়, 'সাহিত্য হলো এমন এক শক্তি, যা আপনাকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে ও একনায়কের বিরুদ্ধে জয়ী হতে সাহায্য করবে। আর এ-কারণেই আমি সাহিত্যের প্রতি এত কৃতজ্ঞ। কারণ, এর মধ্য দিয়েই অসম্ভব বলে যা প্রতীয়মান হয়, তা-ও জয় করা সম্ভব।'

১৯৭৯-এর ইরান বিপ্লবে একনায়কতন্ত্রী শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির পতন ঘটে। তার অমিত ভোগবিলাস, দুর্নীতি, জুয়া, মদ্যপান ও অবাধ যৌনাচারে অতীষ্ঠ ইরানিরা বৈপ্লবিক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনিকে প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৭৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর রেজা শাহ-র বাহিনী বিশাল জনসমাবেশে নিরস্ত্র মানুষের ওপর (কুখ্যাত 'ব্লাক ফ্রাইডে') নির্বিচারে গুলি চালায়। সূদৃঢ় ক্ষমতাধিকারী রেজা শাহ মাত্র একদিনের গণঅভ্যূত্থানে পরাভূত হন। আধ্যাত্মিক চৈতন্যনির্ভর ইরান-বিপ্লব গোটা জীবনধারাকে বদলে দেয়। ইমাম খোমেনির আওয়াজ উত্থাপিত হয় বিশ্বের তাবৎ নির্যাতিত-অবহেলিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য।

বিপ্লবোত্তর ফারসি সাহিত্যে এমন কিছু লেখকের আবির্ভাব ঘটে যাদের গল্প তুরস্ক, বুলগেরিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার জাতীয় পর্যায়ের সমমানের। লেখকরা শহুরে নাগরিকতার পাশাপাশি গ্রামজীবন চিত্রায়ণে দক্ষতার পরিচয় দেন। একুশ শতকের প্রথম দশকে এক নবধারা গতিশীল হয়। মোস্তফা মার্স্তুর মতো লেখকদের সাহিত্যকর্মে আসে আধুনিক-উত্তরাধুনিক ফর্ম। বিপ্লবোত্তর অধিকাংশ সাহিত্যের বিষয়বস্তু মানবিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক। উদ্দীপনাপূর্ণ অনুসন্ধানী পরিবেশে সামাজিক ও বৈশ্বিক দৃষ্টির মেলবন্ধন ঘটে। বিপ্লবোত্তর কালের সামাজিক সচেতনতাই ফারসি সাহিত্যের সমৃদ্ধির কারণ।

সবচেয়ে খারাপ সময়েও তৈরি হতে পারে উৎকৃষ্ট সাহিত্য। নির্মম শাসকের অধীনেও তৈরি হতে পারে উচ্চমানের সাহিত্য। তবে সতর্কবার্তা হচ্ছে—নিয়ন্ত্রণ-প্রবণ শাসকরা সাহিত্যকেও ব্যবহার করতে চায়। কিন্তু যে-সাহিত্য অরাজক-স্বৈরাচারী শাসকের পক্ষে কথা বলে, তা হয়ে যায় ক্লিশে, কালে মানুষ আবর্জনায় ছুঁড়ে দেয়।

এছাড়া ফারসি কথাসাহিত্যে বিপুলসংখ্যক নারী লেখকের আবির্ভাব ঘটে। এ-যুগে সিমিন দানেশভার, গোলী তারাঘি, শাহরনুশ পারসিপুর, গাযালে আলীযাদে, মনিরো রাভানিপুর, ফেরেশতে মাওলাভি, ফেরেশতে সারির উপন্যাসে সমাজ-বিবর্তন, নারীর অবস্থান ও সমস্যা চিত্রায়িত হয়। পুরুষশাসিত সমাজে তা নারীর আত্ম-অধিকারও প্রতিষ্ঠা করে। মোহ্সেন মাখ্মালবফ দুঃস্বপ্ন ও বাস্তবতার সংমিশ্রণে বিস্ময়কর মনস্তাত্ত্বিক গল্প লেখেন। মানবতাবাদী গল্পকার হোশাঙ্গ আসুরযাদের গল্প বাস্তববাদী, যন্ত্রণাগ্রস্ত মানুষের চিত্র। সাইয়্যেদ মাহদী শোজায়ীর গল্প একক কথন বা স্বগতোক্তিধারার নতুন ফর্মে উপস্থাপিত। তাঁর আবেগী প্রাঞ্জল ভাষায় রয়েছে যুদ্ধ-জুলুম-সংঘাতের কথা এবং প্রিয়-বিচ্ছেদের বিষাদ-সুর। তাঁর সাহিত্য মানুষের প্রতি বিশ্বাস ও মূল্যবোধের স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ।

২০১১ সাল থেকে আরববিশ্বে বয়ে যায় বিপ্লবের ঝড়, যা 'আরব বসন্ত' নামে অভিহিত। বিদ্রোহের সময় ইসলামপন্থীরা উপস্থিত থাকলেও, তারা এর দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করেনি। মূলত এটি সরকারবিরোধী বিক্ষোভ, বিদ্রোহ ও সশস্ত্র বিদ্রোহের একটি ধারাবাহিকতা। দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক স্থবিরতার প্রতিক্রিয়া হিসাবে তিউনিসিয়ায় শুরু বিক্ষোভ আরও পাঁচটি দেশে (লিবিয়া, মিশর, ইয়েমেন, সিরিয়া ও বাহরাইন) ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৮-এর শেষাবধি আলজেরিয়া, জর্ডান, সুদান, ইরাক, লেবাননেও ঘটে বিদ্রোহ ও প্রতিবাদী আন্দোলন—সবই আরব বসন্তের ধারাবাহিকতা। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর-আফ্রিকা জুড়ে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের ফলে বহু শিল্পী-সাহিত্যিকের জন্ম হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন কবি আমাল দুনকুল (১৯৪০) মিশরীয় নবযুগের কবিতায় বিশিষ্ট হয়ে ওঠেন। আনোয়ার সাদাত সরকারের বিরুদ্ধে তিনি দৃঢ় অবস্থান নেন। সাহিত্যপত্র 'মাওয়াকিফ'-এর মাধ্যমে আদোনিস আরবি সাহিত্যে যুগান্তর ঘটান। বিশ্বের দাঙ্গাবাজ মোড়লদের বিরুদ্ধে তাঁর কণ্ঠস্বর সবসময়ই বাঁধভাঙা বিপ্লবের : আতঙ্ক/একটা স্বপ্ন/ওরা এল নগ্ন/তছনছ করে ঢুকল বাড়িতে/খুঁড়ল গর্ত/পুঁতে ফেলল শিশুদের আর চলে গেল…/…'মাটিকে তারা বানিয়েছে মরুভূমি, আর তার নাম দিয়েছে শান্তি!'

সবচেয়ে খারাপ সময়েও তৈরি হতে পারে উৎকৃষ্ট সাহিত্য। নির্মম শাসকের অধীনেও তৈরি হতে পারে উচ্চমানের সাহিত্য। তবে সতর্কবার্তা হচ্ছে—নিয়ন্ত্রণ-প্রবণ শাসকরা সাহিত্যকেও ব্যবহার করতে চায়। কিন্তু যে-সাহিত্য অরাজক-স্বৈরাচারী শাসকের পক্ষে কথা বলে, তা হয়ে যায় ক্লিশে, কালে মানুষ আবর্জনায় ছুঁড়ে দেয়। বিশ্বব্যাপী প্রতিরোধের কবি মাহমুদ দারবিশ স্পষ্ট ভাষায় বলেন, 'আমি কবিতা লিখছি অর্থাৎ আমি এখন মরছি আর যেন কবিতার প্রথাবদ্ধ তত্ত্ব ও নীতি-নিয়ম বিদায় নিচ্ছে। যেন খঞ্জর স্পষ্ট হয়ে উঠছে। যেন উন্মোচিত হচ্ছে প্রতীক ও রূপক: গণমানুষই সেই পাখি—সুসংবদ্ধ নীতি ও ছন্দের নাম, যাদের এখন নাম দেয়া হয় 'হত্যাকারী'।" সততা ও মুক্তি কার জন্য? সে তো মজলুমের পক্ষে কথা বলে। যেমন মাহমুদ দারবিশের 'ফিলিস্তিনের একজন প্রেমিক' কবিতা: তার চোখজোড়া ফিলিস্তিন/তার নাম ফিলিস্তিন/তার পোশাক আর তার দুঃখগুলো ফিলিস্তিন/তার মাথায় বাঁধা রুমাল, তার পা জোড়া আর তার শরীর ফিলিস্তিন/তার কথা তার নীরবতা ফিলিস্তিন/তার কণ্ঠ ফিলিস্তিন/ তার জন্ম এবং তার মৃত্যু ফিলিস্তিন।

বিপ্লব-পরবর্তী সাহিত্য সংস্কৃতির বড় অর্জন—নিজেদের দিকে, জন্মভূমি, মাটি ও মানুষের কাছে ফেরা। শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীর কাছে এটাই বিপ্লবের ফসল। মুক্তির দর্পণ হিসেবে শিল্প-সংস্কৃতি গণমানুষের অধিকারের প্রশ্নে দ্বিধাহীন। তবে বিপ্লবী জোশ একদিন ফুরিয়ে যেতে থাকে। নানা ষড়যন্ত্র ও স্বার্থবাহী মহলের উৎপাতে বিপ্লব নামক গোলাপের পাপড়ি শুকিয়ে যেতে পারে। তাকে ধরে রাখতে হয় শত-সহস্র চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে। লিও ট্রটস্কির ভাষায়,  'মানুষ হবে অফুরান শক্তিশালী, জ্ঞানী এবং সূক্ষ্ম, তার শরীর হবে আরো সুবিন্যস্ত, তার চলন হবে আরো ছন্দময়, তার কণ্ঠ আরো সুমধুর…', বিপ্লব তাই জটিল বিষয়। বিপ্লবের সংস্কৃতি জনজীবনে প্রবহমান রাখা স্বাধীনতা রক্ষার মতোই কঠিন। আল মাহমুদের 'জেলগেটে দেখা' কবিতার এমন ভাবনা যদি সার্থক হয়, তবেই বিপ্লবের মানে আসে—

আমাদের শহর নিশ্চয়ই এখন ভিখিরিতে ভরে গেছে।/সারাদিন ভিক্ষুকের স্রোত সামাল দিতে হয়।/আমি কতবার তোমাকে বলেছি, দেখো/মুষ্টি ভিক্ষায় দারিদ্র্য দূর হয় না।/এর অন্য ব্যবস্থা দরকার, দরকার সামাজিক ন্যায়ের। 

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda departs for London

The air ambulance ferrying the former prime minister departed from Hazrat Shahjalal International Airport at 11:47pm

8h ago