সিন্দুরিয়া: ঢাকার কাছাকাছি এক জীববৈচিত্র্যের স্বর্গ

ঢাকা শহরের কোলাহল আর ধুলাবালি থেকে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার দূরে এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বে রয়েছে খুব সুন্দর একটি গ্রাম, যেটি সম্পর্কে শহরের বেশিরভাগ মানুষই জানে না। ছিমছাম সুন্দর এই গ্রামটির নাম সিন্দুরিয়া।
ধলেশ্বরী নদীর তীরে অবস্থিত এবং সাভারের পাথালিয়া ইউনিয়নের গেরুয়া এলাকায় বংশী নদীর সঙ্গে যুক্ত এই সিন্দুরিয়া শুধু একটি মনোরম গ্রামই নয়, এটি ঐতিহ্য ও ইতিহাসে গড়ে ওঠা সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যময় একটি অপূর্ব পরিবেশ।

এর মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে আপনি প্রাণ খুঁজে পাবেন। এখানে প্রতি বছরের বন্যা প্রকৃতিকে তরতাজা করে তোলে। এখানে এখনো বিভিন্ন আঞ্চলিক ও লোকজ চর্চা তাদের সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রেখেছে আর এই জায়গাটি হয়ে উঠেছে বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। ঢাকার সবচেয়ে দূষিত নদীগুলোর একটির এত কাছে হওয়া সত্ত্বেও, এখানকার প্লাবনভূমিগুলো এখনও আশ্চর্যজনকভাবে প্রাণবন্ত।
বন্যার আশীর্বাদে প্রাণ
প্রতি বর্ষায়, সিন্দুরিয়া ও আশেপাশের মিরেরটেক অঞ্চল বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়, যা জমিকে নবজীবন দান করে। বন্যার পানি এখানে রেখে যায় উর্বর পলিমাটি ও জৈব উপাদান, যা দেশি ঘাস, ফসল এবং জলাভূমির উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে তোলে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আমির হোসেন ভূঁইয়া বলেন, `সিন্দুরিয়া তুলনামূলকভাবে দুর্গম এবং ভারী শিল্পকারখানা থেকে মুক্ত হওয়ায়, এখানকার নদীর পানি স্বচ্ছ থাকে। কিন্তু যখন ধলেশ্বরী নদী সাভার ও ঢাকার দিকে প্রবাহিত হয়, তখন এটি শিল্পবর্জ্য, পয়ঃনিষ্কাশন ও শহুরে বর্জ্যের কারণে ঘোলা ও বিষাক্ত হয়ে পড়ে।'
মূলত বন্যার পানি সিন্দুরিয়ার জলাভূমিকে একটি মৌসুমি স্বর্গে পরিণত করেছে।
বন্যপ্রাণীর এক অভয়াশ্রম
ঝোপঝাড়ে ভরা তৃণভূমি থেকে শুরু করে নিঃশব্দ নারকেল বাগান– সিন্দুরিয়া ধীরে ধীরে পাখি ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর জন্য এক অভয়াশ্রমে রূপ নিচ্ছে। মাঠ পর্যবেক্ষণ ও গবেষণায় দেখা গেছে, এখানে রয়েছে সাইবেরিয়ান রুবিথ্রোট, সাইবেরিয়ান স্টোনচ্যাট, ওয়াটারকক, বায়া ওয়েভার, ব্ল্যাক-ব্রেস্টেড ওয়েভার, চেস্টনাট-হেডেড মুনিয়া, ত্রিবর্ণ মুনিয়া, ইন্ডিয়ান সিলভারবিল, ময়না, কালো ফিঙে, চিতল ঘুঘু, ছোট পানকৌড়ি, ছোট বক, ছোট সরালি, সাদা-গলা মাছরাঙা, ব্রোঞ্জ-ডানা জাকানা এবং পেজেন্ট-টেইলড জাকানার মতো অসংখ্য পাখির প্রজাতি। খাদ্যের প্রাচুর্য ও নিরাপদ আবাসস্থলের কারণে এরা এখানে খায়, বাসা বাঁধে ও প্রজনন করে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ও প্রকৃতি সংরক্ষক অরিত্র সাত্তার সিন্দুরিয়ায় ১২টি স্তন্যপায়ী প্রাণীর অস্তিত্ব নথিভুক্ত করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে বড় ভারতীয় গন্ধগোকুল, ছোট গন্ধগোকুল, সাধারণ গন্ধগোকুল, সোনা শিয়াল, বন বিড়াল, মেছো বিড়াল, বড় ধনী ইঁদুর এবং ঘরের ইঁদুর।
তিনি ১৫টি সরীসৃপ প্রজাতিও শনাক্ত করেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মোনোকল্ড কোবরা, স্পেকটাকলড কোবরা, ব্যান্ডেড ক্রেইট, ছোট কালো ক্রেইট, ইন্দো-চাইনিজ র্যাট স্নেক, পেইন্টেড কিলব্যাক, চেকার্ড কিলব্যাক এবং স্মুথ-স্কেলড ওয়াটার স্নেক।
অরিত্র সাত্তার বলেন, 'এখানকার জীববৈচিত্র্য গ্রামবাসীদের ঐতিহ্যবাহী জীবনযাত্রার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এমনকি ঘরের আবর্জনাও এই প্রতিবেশে জৈব পুষ্টি উপাদান যোগ করে।'
এই গ্রামের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি হলো নারকেল গাছের বাগান, যা কয়েক দশক আগে গ্রামবাসীরা তৈরি করেছিলেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব গাছ এখন প্রাকৃতিকভাবে পাখিদের বাসা বানানোর উপযোগী হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে মুনিয়া এবং বাবুই পাখিদের জন্য।
অরিত্র বলেন, 'মাত্র ৪০০ মিটার জায়গায় আমরা ৩০০ এর বেশি বাসা পেয়েছি, এমনকি কিছু গাছে ৫০টা পর্যন্ত বাসা ছিল। এখন এই নারকেল বাগানগুলো চুপচাপ পাখিপ্রেমী, অপেশাদার ফটোগ্রাফার আর কৌতূহলী ভ্রমণকারীদের আকর্ষণ করছে।'
ঢাকার পর্যটক শারমিন রহমান বলেন, 'পাখির ডাক, নরম হাওয়া আর চিকচিকে পানির আভা- এই সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল যেন অন্য এক জগতে চলে এসেছি।'
ভবিষ্যতের আশঙ্কা
সিন্দুরিয়ার শান্ত পরিবেশ বর্তমানে ব্যাহত হচ্ছে। এখানকার বেশিরভাগ বাসিন্দা কৃষি এবং ছোট পরিসরের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এসব ব্যবসার মধ্যে আছে মুদির দোকান, সবজির স্টল, আর মাছের ব্যবসা। কৃষিকাজে স্থানীয়রা মূলত ধান, মৌসুমি সবজি ও সরিষার চাষ করেন।
এছাড়াও, একাংশ মানুষ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন পদে কর্মরত এবং কেউ কেউ তৈরি পোশাক শিল্পেও কাজ করছেন। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রেস্তোরাঁ, পোলট্রি খামার এবং অবকাঠামোর দ্রুত সম্প্রসারণের কারণে জলাবদ্ধ ও প্লাবনভূমি ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এসব উন্নয়নের ফলে প্লাস্টিক, রাসায়নিক, তেল, ধাতব আবর্জনা, রেস্তোরাঁ ও নির্মাণবর্জ্য নির্গত হচ্ছে, যা মাটি ও জলজ পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে।
অধ্যাপক ভূঁইয়া বলেন, 'প্লাস্টিক জমে থাকার কারণে প্লাবনভূমির মাটি তার উর্বরতা হারাচ্ছে। রাসায়নিকগুলো ঠিকমতো ছড়াতে পারছে না, আর পানির উপরিভাগে তেলের স্তর জমে অক্সিজেন প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।'
এসব নানাবিধ কারণে নারকেল গাছগুলো মরে যাচ্ছে।
যদি এই গাছগুলো একেবারে হারিয়ে যায়, তাহলে পাখিরাও চলে যাবে। যার ফলে একটির পর একটি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়ে পরিবেশগত ভারসাম্য ভেঙে পড়বে।
তিনি আরও বলেন, 'এই ধরনের পরিবর্তন এখানকার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে গড়ে ওঠা জীববৈচিত্র্য ও সূক্ষ্ম বাস্তুতন্ত্রকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এমনকি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জলাভূমিগুলোও এখন ঝুঁকির মধ্যে। কারণ এই বাস্তুতন্ত্রগুলো জলপ্রবাহের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত। তাই সিন্দুরিয়ার সমভূমি ভরাট করা হলে পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও জলাবদ্ধতা তৈরি হতে পারে।'
পর্যটন নানা অসুবিধাও ডেকে আনছে। অতিরিক্ত মানুষ চলাফেরা, ময়লা-আবর্জনা ও শব্দ দূষণ ইতিমধ্যেই বন্যপ্রাণীদের বিরক্ত করছে। গত দুই বছরে সংরক্ষণকর্মী অরিত্র সাত্তার সিন্দুরিয়া ও মিরেরটেকের এই বার্ষিক বন্যা সমভূমির গুরুত্ব খেয়াল করেছেন। এই সমভূমিগুলো তলানিতে থাকা পদার্থ ধরে রাখে এবং দূষণকারী উপাদানগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে দেয়, ফলে তা জীববৈচিত্র্যের জন্য সহনীয় হয়ে ওঠে। শুকনো মৌসুমে মাটিতে ফাটল ধরলে সেখানে অক্সিজেনের প্রবাহ বেড়ে যায়, যার ফলে মিথেন ও কার্বন মনোক্সাইডের উৎপাদন সীমিত থাকে। এই বন্যা সমভূমিগুলো উর্বর ভূমির জন্ম দেয়, যা কীটপতঙ্গ ও শস্যভোজী পাখিদের খাদ্য জোগান দেয়। এমনকি ধামরাইয়ের মতো দূষিত এলাকাগুলোর কাছেও জলজ ও স্থলজ বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে সংযোগ রক্ষা হয়। তবে এই সূক্ষ্ম ভারসাম্য এখন হুমকির মুখে। কারণ দ্রুত নগরায়ণ, রেস্টুরেন্টের প্লাস্টিক, কাগজ ও খাবারের বর্জ্য, মোটরবাইকের ধোঁয়া, মুরগির খামার, অতিরিক্ত মাছ ধরা, নৌকা চলাচল ও জমি ভরাট। এই সবকিছু মিলিয়ে এই বাস্তুতন্ত্রের পরিবেশগত স্থিতিশীলতা ও দূষণ সহ্যক্ষমতার উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করছে।
আশার আলো কি যথেষ্ট?
স্থানীয় উদ্যোগে একটুখানি আশার আলো দেখা যাচ্ছে। এলাকার বাসিন্দারা এবং তরুণ সংরক্ষণকর্মীরা এগিয়ে আসছেন। তবে তা কি যথেষ্ট? অরিত্র এবং তার দল গ্রামে গ্রামে গিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য প্রচার শুরু করেছেন। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে, এমনকি দোকানদারদেরও বোঝাচ্ছেন।
৬৫ বছর বয়সী সাইফুল ইসলাম বলেন, 'আমি যখন নতুন করে আমার ঘর বানাই, তখন দুটো নারকেল গাছ কেটে ফেলি। আমি জানতাম না এগুলো এত উপকারী। জানলে হয়তো কাটতাম না।'
৩৫ বছর আগে তার পরিবার গাছগুলো লাগিয়েছিল। গত ১৬ বছরের বেশি সময় ধরে প্রতি বছর ফাল্গুন, ভাদ্র আর আষাঢ় মাসে শত শত বাবুই পাখি বাসা বাঁধতে ওই গাছে ফিরে আসে।
সাইফুল আরও জানান, এক সময় এই এলাকায় মাত্র ছয়টি পরিবার ছিল। এখন নতুন নতুন বসতি গড়ে উঠছে । এর মধ্যে বেশিরভাগই পরিকল্পনাহীনভাবে – যা বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংসে ভূমিকা রাখছে।
সিন্দুরিয়ার ২৪ বছর বয়সী বাসিন্দা শেখ আবদুল কাদের বলেন, 'সিন্দুরিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাদের সবার মনে আনন্দ এনে দেয়। আমরা এখানে বড় হয়েছি — এই খোলা মাঠ, নদীর পাড়, পরিবেশ সাভারে আর কোথাও এমন সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। আগে খুব বেশি মানুষ আসত না, কিন্তু রাস্তার উন্নতির ফলে এখন অনেকেই আসছে। দোকানপাটও গড়ে উঠছে। একদিক থেকে ভালোই লাগে, কারণ আগে এলাকাটা অনেকটাই নির্জন ছিল। কিন্তু মাঝে মাঝে অতিরিক্ত ভিড় আমাদের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে যায়, আর পরিবেশটাও যেন ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে।'
কিছু ব্যবসায়ীও ব্যাপারটিকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখছেন।
স্থানীয় একটি রেস্টুরেন্ট চালানো জসিম বলেন, 'মানুষ সৌন্দর্যের টানেই আসে। যদি আমরা এটাকে নষ্ট করি, তাহলে আমাদের ব্যবসাও শেষ। আমরা সাহায্য করতে চাই । কিন্তু সঠিক দিকনির্দেশনা দরকার।'
এই ধরনের স্থানীয় উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও, বিশেষজ্ঞরা একমত যে এগুলো যথেষ্ট নয়। তাদের মতে, প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা, কঠোর পরিবেশগত নিয়মকানুন এবং সম্প্রদায়ভিত্তিক সংরক্ষণ মডেল এখন খুবই জরুরি। এসব ছাড়া, সিন্দুরিয়ার পরিবেশব্যবস্থার ধ্বংস একসময় স্থায়ী রূপ নিতে পারে।
অনুবাদ করেছেন সৈয়দা সুবাহ আলম
Comments