অ্যান্টার্কটিকার ‘পেঙ্গুইন পোস্ট অফিস’ চালাচ্ছেন যে নারীরা
বিশ্বের সবচেয়ে দুর্গম পোস্ট অফিসটি পরিচালনার জন্য এই বছর শুধু নারীদের নিয়ে গঠিত দলটি যখন অ্যান্টার্কটিকার গৌডিয়ার দ্বীপে পৌঁছায়, তখন ডাকটিকিটের চেয়েও বেশি দরকারি জিনিসটি ছিল বেলচা। কারণ তাদের থাকার জন্য নির্ধারিত বাড়িটি তখন গত ডিসেম্বরের টনকে টন তুষারের নিচে ঢাকা।
যুক্তরাজ্য থেকে প্রায় ৮ হাজার মাইল উড়োজাহাজ এবং জাহাজে ভ্রমণ করে পোর্ট লকরয় বৈজ্ঞানিক ঘাঁটিতে পৌঁছেই অবশ্য তারা ব্রিটেনের রয়্যাল নেভি দলকে সেখানে পায়। নৌসেনারা তাদের বাড়িটি খননের জন্য সেখানে উপস্থিত ছিল।
৪ সদস্যের দলের সবচেয়ে কম বয়সী সদস্য ২৩ বছর বয়সী পোস্টমাস্টার ক্লেয়ার ব্যালানটাইনকে অবশ্য এই বরফের স্তূপ চমকে দেয়নি। বরং সবার আগে যা তাকে প্রচণ্ড বিস্মিত করেছিল সেটি হলো পেঙ্গুইন। তার ভাষায়, 'যেদিকে তাকাই, সেদিকেই পেঙ্গুইন।'
অ্যান্টার্কটিকার পশ্চিমে এই ফুটবল মাঠের সমান ছোট্ট দ্বীপে এক হাজারেরও বেশি জেন্টু পেঙ্গুইন বাস। ১৯৪৪ সালে অ্যান্টার্কটিকায় যুক্তরাজ্যের প্রথম স্থায়ী ঘাঁটি স্থাপনের পর থেকেই এটি যেন অভিযাত্রী, বিজ্ঞানী ও গবেষকদের জন্য এক স্বর্গরাজ্য। আর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পর্যটকদেরও আকর্ষণের এক কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে জায়গাটি।
পোস্ট অফিসের পাশাপাশি একটি জাদুঘর এবং গিফট শপও রয়েছে। ২০২২-২৩ মৌসুমে, ২০০টিরও বেশি জাহাজের প্রায় ১৬ হাজার পর্যটক এসেছিলেন এখানে। আর তাই গৌডিয়ার দ্বীপ হয়ে উঠেছে এই হিমায়িত মহাদেশের সবচেয়ে ব্যস্ত স্থানগুলোর একটি।
প্রতি বছরের নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত, যা কি না দক্ষিণ গোলার্ধের গ্রীষ্মকাল, এই ডাকঘর পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি দল নির্বাচন করা হয়। কোভিড-পরবর্তী প্রথম মৌসুমে প্রায় ৪ হাজার মানুষ এই ডাকঘরে কাজের জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সুযোগ পান কেবল ৪ জন। তারা হলেন ক্লেয়ার ব্যালানটাইন, বেইজ লিডার লুসি ব্রুজোন, ওয়াইল্ডলাইফ মনিটর মাইরি হিল্টন এবং শপ ম্যানেজার নাটালি করবেট।
তাদের অনেক কাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল পেঙ্গুইন গণনা, যা এই পেঙ্গুইন কলোনিতে জেন্টু প্রজাতির পেঙ্গুইনের প্রজননের ওপর কয়েক দশকব্যাপী চালানো গবেষণার অংশ।
'গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসবাস'
হাজার হাজার প্রার্থীকে পেছনে ফেলে পাওয়া এই কাজটি কিন্তু খুব একটা আরামদায়ক নয়। একটি বেডরুম শেয়ার করেই ৫ মাস এই ৪ জনকে একসঙ্গে থাকতে হয়েছে। নেই কোনো পানির কল, নেই ইন্টারনেটও। সঙ্গে আবার অবসরও নেই, প্রতি ২ সপ্তাহে মাত্র ১ দিন ছুটি।
ইউকে অ্যান্টার্কটিক হেরিটেজ ট্রাস্টের ফিল্ড অপারেশনসের সমন্বয়ক ভিকি ইঙ্গলিসের মতে, 'এই ছোট্ট জায়গায় একদম গা ঘেঁষে থাকতে হবে। কোথাও যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।'
আর এসবের সঙ্গে চারদিকেই পেঙ্গুইন সৃষ্ট তীব্র দুর্গন্ধ।
ইঙ্গলিস বলেন, 'মৌসুমের একটি নির্দিষ্ট সময়ে তুষার চলে যায় এবং এরপর যা থাকে তা কাদা নয় - সেগুলো সব গুয়ানো।'
গুয়ানো হলো সামুদ্রিক পাখির মল। আর এই দ্বীপে এর কোনো অভাব নেই।
পরিদর্শনকারী ক্রুজ জাহাজগুলো থেকে যা আসে তার বাইরে সব খাবারই মূলত টিনজাত খাবার। এই জাহাজগুলো সাধারণত ২০০ যাত্রী বহন করার মতো ছোটখাট জাহাজ, সুবিশাল কোনো জাহাজ নয়। তবে এই জাহাজগুলোতেও গরম পানিতে আরামে গোসলের সুযোগ ঠিকই পেয়ে যান ডাকঘরের কর্মীরা।
অবসরের ফাঁকে ২০২৩ এর দল তাদের ব্লগে দিনটির বর্ণনা করছিল এমন করে, 'দিনের অনেকটা সময়ই আমরা ঘুমিয়ে কাটাই। এবার দ্বীপটি একবার খুব ধীরে হেঁটে হেঁটে চক্কর মারতে যাব। যেন চারপাশের সবকিছুর সঙ্গে মিশে যেতে পারি। ছোট ছোট এমন সব জিনিস যা হয়ত সচরাচর আলাদা করে চোখেই পড়ত না। এই যেমন শ্যাওলা, স্টারফিশ, লিম্পেট, ক্রিল। আমরা ছবিও তুলি, বই পড়ি, নিজেরা কথাবার্তা বলি- অনেকটা যেন পুরনো দিনে এই ঘাঁটিতে যারা থাকতেন তাদের মতোই।'
`প্রফুল্লতাই সবচেয়ে বড় যোগ্যতা'
প্রার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া নিয়ে ট্রাস্টের সিইও ক্যামিলা নিকোল বলেন, 'এমন কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম আমাদের নেই যা আমরা অনুসরণ করতে পারি। বরং এখানে একটি দল হিসাবে একসঙ্গে কাজ করার ক্ষমতাকে মূল্যায়ন করা হয়। সবসময় উৎফুল্ল থাকতে পারে, জীবনের ভালো দিকটি খুঁজে পায় এবং দ্রুত সমস্যার সমাধান করতে পারে এমন মানুষদের এখানে ভালোমতো টিকে থাকার সম্ভাবনা বেশি।'
এই পোস্টিংয়ে যা নেই তা হলো- আরাম।
নিকোল বলেন, 'অ্যান্টার্কটিকার মতো জায়গা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এত বিশাল একটা অঞ্চল, এত আদিম আর বাতাস এত অবিশ্বাস্য রকমের পরিষ্কার। আচমকা আপনার নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হবে। এখানে শক্তি আছে, প্রকৃতি আছে। পরিবেশ আমাদের তুলনায় অনেক বিশাল। আমি এত দূরে এসেছি একটা দায়িত্ববোধ থেকে।'
সম্প্রতি ২০২৩-২৪ মৌসুমের জন্য নিয়োগ শেষ হয়েছে এবং নিয়োগপ্রাপ্তদের নতুন ব্যাচ এই বছরের শেষ দিকে যাত্রা শুরু করবে।
নিকোল বলেন, 'নতুন দলটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক গবেষণার ধারা অব্যাহত রাখবে। আমরা অ্যান্টার্কটিক ইতিহাসের এমন একটি সময়ের গল্প বলছি যা খুব কমই বলা হয়, কিন্তু আমরা যা নিয়ে আজ ভয় পাই তার সবই এখানে আছে।'
'অ্যান্টার্কটিকায় জলবায়ু বিজ্ঞান নিয়ে কাজ এখানেই সর্বপ্রথম শুরু হয়। এখান থেকেই নানা অজানাকে জানি, যা নিয়ে আমাদের করার আছে অনেক কিছু', যোগ করেন তিনি।
১৯৮৫ সালে ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক সার্ভের এক জুনিয়র গবেষক অ্যান্টার্কটিকার ওজোন স্তরে গর্ত আবিষ্কার করেছিলেন। যার সুদুরপ্রসারী ফলাফল মন্ট্রিল প্রোটোকল এবং সব দেশ একসঙ্গে সিএফসি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত।
পর্যটকের ঢল
নিকোল উল্লেখ করেছেন, সম্প্রতি জেন্টু পেঙ্গুইনের প্রজনন সফলতায় কিছুটা ভাটা পড়েছে। তবে তিনি বলেন, 'এর কারণ খুব সরল নয়। যদিও জলবায়ু পরিবর্তন সম্ভবত সবচেয়ে বড় কারণ, তবে এরসঙ্গে বেশি মানুষের আনাগোনাও কোনো কারণ কি না তাও সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করা প্রয়োজন।'
গত কয়েক দশকে অ্যান্টার্কটিকার পর্যটন উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। কিন্তু নিকোল তাৎক্ষণিকভাবে উল্লেখ করেন যে, অ্যান্টার্কটিকা সমভূমি এখনও বিশাল বড় এক এলাকা, যা কি না যুক্তরাজ্যের থেকেও বড়।
তিনি বলেন, 'পর্যটনের ওপর আইনগত কোনো বাধা নেই, তবে জায়গাটি অত্যন্ত কঠোরভাবে আইএএটিও (ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব আন্টার্কটিকা ট্যুর অপারেটরস) এবং অ্যান্টার্কটিক ট্রিটির মাধ্যমে পরিচালিত হয়।'
মেরু অঞ্চলে জাহাজের চলার সক্ষমতা, বর্জ্য ও পানি ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে জৈব নিরাপত্তা; সবকিছুর জন্যই রয়েছে আইনি ধারা। নিকোল বলেছেন, 'এই নিয়ন্ত্রিত খাতটির জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আমরা এই বছর আরও মানুষ আশা করছি।'
Comments