সন্তানকে পিরিয়ড বিষয়ে জানাবেন যেভাবে

সন্তানকে পিরিয়ড বিষয়ে জানাবেন যেভাবে
ছবি: সংগৃহীত

পিরিয়ড বা মাসিক নারীদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, ভীষণ এক বাস্তবতার নাম। তারপরও আমাদের দেশের অভিভাবকরা বিষয়টি নিয়ে সন্তানদের সঙ্গে আলোচনা করতে অস্বস্তি বোধ করেন।

আমি নিজেই ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত এ সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। নবম শ্রেণিতে ওঠার পর নিজের পিরিয়ড হলে অকূল পাথারে পড়ি, আর তখনই জানতে পারি এখন থেকে প্রতি মাসে আমার শরীর থেকে বয়ে যাবে রক্তের ধারা। এমনকি এর আগ পর্যন্ত আমি কোনোদিন আমার মায়ের পিরিয়ড সংক্রান্ত সরঞ্জাম চোখে দেখিনি, জানিনি তার ক্র্যাম্প কিংবা মুড সুইং সম্পর্কেও! এমনভাবে সবকিছু লুকিয়ে রাখা হতো আমাদের দুই বোনের কাছ থেকে, যা ভাবলে এখন অবাক লাগে।

প্রাথমিক ধারণা না থাকলে প্রথম পিরিয়ড একজন শিশু বা কিশোরীর জীবনে আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। আর সে কারণেই এটি নিয়ে আলোচনা জরুরি। আমাদের দেশে পাঠ্যবইয়েও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে নারীর স্বাভাবিক শারীরিক এই পরিবর্তনের বিষয়টি, যেন ছেলেশিশু বা কিশোররাও বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন হতে পারে।

ছেলে-মেয়ে সবারই জানা উচিত, পিরিয়ড নারীর জীবনের অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। যা নিয়ে কথা বলা স্বাভাবিক, যা নিয়ে হাসাহাসির কিছু নেই, লুকোছাপারও কিছু নেই। পরিবারগুলোতেও এমন পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন যেখানে মেয়েশিশু বাবা-মা কিংবা ভাইয়ের সঙ্গে তার তলপেটের ব্যথা, তার অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ কিংবা মুড সুইংয়ের বিষয়টি ভাগ করে নিতে পারে।

১৪ বছর বয়সী মেয়ের মা শাহনাজ সুলতানার কাছে জানতে চেয়েছিলাম কীভাবে তিনি তার মেয়ের সঙ্গে পিরিয়ড বিষয়ক আলাপ করেছিলেন।

শাহনাজ বলেন, 'ও বেশ ছোট থাকতেই ধারণা দিতে শুরু করেছিলাম। আর এসব আলোচনা করতাম ওর বাবাসহই। এরপর ক্লাস ফাইভে মেয়ের পিরিয়ড শুরু হলো। যেহেতু সে আগে থেকেই বিষয়টি সম্পর্কে জানে, তাই পুরো বিষয়টা সহজেই হ্যান্ডেল করতে পেরেছিল।'

'এখনও ওর স্যানিটারি ন্যাপকিন লাগলে বা পিরিয়ড সংক্রান্ত কোনো সমস্যা হলে ও খোলাখুলিই আমাদের দুজনের সঙ্গে কথা বলে। পিরিয়ড নিয়ে আমাদের পরিবারে কোনো লুকোছাপা নেই। আমি মনে করি, সব পরিবারেই বিষয়টি নিয়ে কথা বলা খুব স্বাভাবিক হওয়া উচিত, কারণ এটি জীবনের স্বাভাবিক একটি অংশ।'

ব্যাংককর্মী নাজমা আহমেদও বলছিলেন প্রায় একই কথা।

নাজমা বলেন, `আমরা দুই ভাই, দুই বোনের পরিবার ছিলাম। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি পিরিয়ড নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলা রীতিমতো ট্যাবুর মতো ছিল। কারণ ভাইয়েরা শুনে ফেলবে। কিন্তু আমার সন্তান হওয়ার পর সেই ট্যাবু ভেঙেছি। আমার ছেলে তার ছোট বোনের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনে আনে, হট ওয়াটার ব্যাগে গরম পানি ভরে দেয়, বোনের কিছু খেতে ইচ্ছা হচ্ছে কি না জানতে চায়।'

এখন প্রশ্ন হলো, কেন পিরিয়ড নিয়ে খোলাখুলি আলাপ করা জরুরি।

পিরিয়ড কারো কারো জন্য শারীরিক এক ধরনের অস্বস্তি নিয়ে আসে, কারো জন্য প্রচণ্ড ব্যথা। অদ্ভুত ওই সময়ে সন্তানকে মানসিক ও শারীরিক আরাম দিতে তার সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলুন। মাসের ওই কয়েকটা দিন তার বিশেষ যত্ন নিন। তার মানসিক অবস্থার খেয়াল রাখুন।

এতে পিরিয়ডের সময়টুকু কাটানো তার জন্য সহজ হবে। সে জানবে এটায় লজ্জা বা অস্বস্তির কিছু নেই। আবার মেয়ে শিশুর সঙ্গে পিরিয়ড নিয়ে আলোচনা করলে তার সঙ্গে আপনার বন্ধনও শক্তিশালী হবে।

যেভাবে শুরু করতে পারেন

প্রথমেই আপনার সন্তানকে জিজ্ঞেস করুন যে সে পিরিয়ড বা ঋতুস্রাব সম্পর্কে কিছু জানে কি না। তার কোনো বন্ধুর সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না কিংবা বন্ধুদের মধ্যে কারো পিরিয়ড হয়ে গিয়েছে কি না। এতে তার জানা তথ্যও জানতে পারবেন, আবার সে কিছু ভুল জানলে তা শুধরেও দিতে পারবেন।  

সত্য বলুন

পিরিয়ড সম্পর্কে জানাতে সঠিক পরিভাষা ব্যবহার করুন। তাকে শারীরবৃত্তিয় পরিবর্তন সম্পর্কে জানান, বলুন যে পিরিয়ড খুবই সাধারণ একটি শারীরিক বিষয়।

ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে দেওয়া হয়েছে কীভাবে অভিভাবকরা সহজে সন্তানকে পিরিয়ডের কথা বলতে পারেন সে ধারণা।

তাকে বলুন, 'সময়ের সঙ্গে তুমি শিশু থেকে কিশোরী এবং কিশোরী থেকে নারী হবে। তোমার শরীর তাই প্রস্তুত হচ্ছে, যেন সময়মতো তুমি সন্তানের মা হতে পার। আর সেজন্য তোমার ডিম্বাশয় কিছু হরমোন নিঃসরণ করতে শুরু করেছে। যা তোমার গর্ভাশয়ের (যেখানে মায়ের গর্ভে সন্তান থাকে) বাইরে একটি আস্তরণ তৈরি করে, যা মূলত নিষিক্ত ডিমের জন্য প্রস্তুত হয়। কিন্তু যখন সেখানে কোনো ডিম আসে না তখন ওই আস্তরণ ভেঙে পড়ে এবং যোনিপথ দিয়ে তা রক্তের আকারে বের হয়ে যায়। প্রতি মাসেই এখানে গর্ভাশয়ের আস্তরণ থেকে রক্তসহ অন্যান্য উপাদান বের হয়ে যাবে, যেটাই সহজ ভাষায় পিরিয়ড।'

সন্তানকে বার বার বুঝিয়ে বলুন, পিরিয়ড অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়। সাধারণত আট বছর বয়স থেকে ১৬ বছরের মধ্যে যেকোনো সময় এই পরিবর্তন শুরু হয়ে যেতে পারে।

নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিন

পিরিয়ড শুরুর বয়সে মেয়েশিশুর শরীরে আরও কিছু পরিবর্তন আসে। যার মধ্যে রয়েছে হরমোনের প্রভাবে শরীরে লোমের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, বুক স্ফীত ও উরু প্রশস্ত হওয়ার মতো উপসর্গ। সেইসঙ্গে পিরিয়ড যুক্ত হয়ে শিশুকে অনেক সময় অস্বস্তির মধ্যে ফেলতে পারে।

তার অস্বস্তি কাটাতে কথা বলুন, নিজের অভিজ্ঞতা খুলে বলুন। এ সময় মেয়েটির মুড সুইং হতে পারে, সে খিটখিটে হয়ে যেতে পারে। তার সঙ্গে এমন সম্পর্ক গড়ে তুলুন, যেন সে আপনার কাছে স্বস্তি পায়।

তাকে পিরিয়ডকালীন পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে জানান, কীভাবে পরিচ্ছন্নতা মেনে সে এই সময়টুকু কাটাতে পারে তা বোঝান।

সন্তানের বাড়তি যত্ন নিন

পরিবারের কোনো মেয়ে শিশুর পিরিয়ড হলে তার বাড়তি যত্ন নিন। সে যেন পুষ্টিকর খাবার খায় সেদিকে খেয়াল রাখুন। স্যানিটারি ন্যাপকিনসহ তার যা প্রয়োজন তা মেটান। তাকে বলুন, সারাদিন শুয়ে-বসে না থেকে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে। সে যেন খেলাধুলা বন্ধ করে না দেয়।

মেয়ের প্রথম পিরিয়ড এখন অনেক বাবা-মাই উদযাপন করছেন। এক্ষেত্রে বাড়ির সদস্যরা মিলে কেক কাটা যেতে পারে, বাড়িতে ভালো কিছু রান্না করা যেতে পারে, সবাই মিলে একসঙ্গে বসে খাওয়া যেতে পারে। এতে শিশুটির পিরিয়ড ভীতি কেটে যাবে, বিষয়টি যে খুব সাধারণ সেটাও সে বুঝতে পারবে। সে মানসিকভাবে আশ্বস্ত হবে যে, তার পরিবারের যে কারো সঙ্গে পিরিয়ড নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। এতে লুকোচুরির কিছু নেই।

 

Comments

The Daily Star  | English

5 killed as bus hits ambulance on Dhaka-Mawa Expressway

The accident occurred around 11:30am when the bus hit the ambulance parked on the expressway at Nimtola.

2h ago