চারুকলার সেন্টু ও তার সঙ্গী পশুপাখিরা

চারুকলার সেন্টু
ছবি: জান্নাতুল বুশরা

ঢাকা। এই শহরের একটা নিজস্ব শব্দ আছে। সেই শব্দে মিশে আছে কোলাহল, ব্যস্ততা আর প্রচুর ধুলোবালি। তবে একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে শহরের কোণায় কোণায় লুকিয়ে আছে এক দণ্ড নীরবতা আর শান্তি। ক্ষণিকের এই নিস্তব্ধ মুহূর্তগুলো ঠিক যেন কোনো না বলা কবিতা! কী? বুঝতে পারছেন না? তাহলে বুঝিয়ে বলছি।

চারুকলার প্রাচীরের ঠিক বাইরে, ধুলোমাখা পলিথিনে ঢাকা এক ছাউনির নিচে রয়েছে এমনই এক নীরবতা। সেখানে একজন মানুষের চারপাশ ঘিরে থাকে পাখি, কাঠবিড়ালি, বিড়াল আর মাঝে মাঝে দু-একটি সাহসী ইঁদুর। মানুষটির নাম মোহাম্মদ কামাল হোসেন সেন্টু। তাকে চেনার উপায় হলো তিনি মধ্যবয়সী, সাধারণ পোশাক পরে থাকেন কিন্তু তার মত হাস্যোজ্জ্বল মুখ সম্ভবত ঢাকার কোনো মানুষের মাঝেই আপনি পাবেন না।

কখনো এই পথে হেঁটে গেলে আপনি হয়তো তাকে খেয়ালই করবেন না। তিনি অন্যদের মতো চিৎকার করে ডাকাডাকি করেন না, হাত নেড়ে নজর কাড়ার চেষ্টাও করেন না। ফুটপাতের ধারে তার ছোট্ট দোকানটি নানা রকম ছোট ছোট জিনিসে সাজানো। কালো সুতোয় বাঁধানো লকেট, হাতে বানানো আংটি, হাতে বোনা ব্রেসলেট ইত্যাদি। ভীষণ সুন্দর সব জিনিস। তবে আজ আমরা তার দোকানের গল্প নয়, বলব তার গল্প, তার মমতা আর ভালোবাসার গল্প। কারণ গল্পের উপাদান তার দোকানে ঝোলানো পণ্য নয়, সত্যিকারের জীবন্ত কিছু প্রাণ।

প্রতিদিন ক্ষুদ্র পা আর ডানাওয়ালা কিছু অতিথি এসে হাজির হয় তার কাছে। একদিনও বাদ যায় না কিন্তু! গাছ থেকে ছুটে আসে কাঠবিড়ালি, পাশে এসে বসে চড়ুই, দূরে বসে শালিক গান গায়, আর ফুটপাতের ফাঁক-ফোঁকর থেকে মুখ বাড়ায় লাজুক ইঁদুর। শুধু একটা রুটির প্যাকেট হাতে নিয়ে একটু শব্দ করলেই এই ছোট্ট প্রাণগুলো ছুটে আসে তার স্নেহের ডাকে।

তিনি বলেন, 'আমি আমার ঘর চালানোর জন্য ব্যবসা করি। কিন্তু এই প্রাণীগুলোকে খাওয়াই নিজের জন্য।'

সবাই আজকাল নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, তবে সেন্টু কিন্তু তার এই প্রিয় বন্ধুদের একদিনের জন্যেও ভোলেন না। এই শহরের কংক্রিটের দালানগুলো যেমন চারপাশের সবুজ কেড়ে নিচ্ছে, তেমনি মানুষের মমত্বকেও কেড়ে নিচ্ছে। এসব কিছুর মাঝেও সেন্টু হাতে এক বোতল পানি, আর পকেটে কিছু শুকনো খাবারের টুকরো নিয়ে এই শহরের ছোট প্রাণগুলোর জন্য অপেক্ষা করেন।

এই জায়গায় পৌঁছানো সেন্টুর জন্য সহজ ছিল না। ঢাকাতেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা তার। জীবনের শুরু থেকেই সংগ্রাম ছিল সঙ্গী। ২০০০ সালের দিকে তার ছিল ছোট্ট একটা স্টেশনারির দোকান। তারও আগে, হাজারীবাগের ট্যানারিতে কাজ করতেন, যেখানে বাতাসেই ছিল তীব্র বিষ। সায়েন্স ল্যাবের পাশে খেলনা বিক্রি করেছেন, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে গ্যাস সিলিন্ডার ভরেছেন। কখনো ধানমন্ডি, ফার্মগেট আর সায়েন্স ল্যাবে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে আর চোখে স্বপ্ন নিয়ে ঘুঙুর বিক্রি করেছেন।

'সব করেছি, আমার পরিবার- স্ত্রী আর দুই ছেলেমেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে', বলেন সেন্টু।

কিন্তু কিছুই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। জীবন বারবার হোঁচট খেয়েছে, চাকরি হারিয়েছেন একের পর এক- পুরোনো রসিদের মতো মুছে গেছে রং। তবু সেন্টু তার মমতা হারাননি। তিনি এখনো দাঁড়িয়ে আছেন এবং এই সত্যটাই তাকে প্রতিদিন নতুন করে বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয়!

গত ১২-১৩ বছর ধরে চারুকলার সামনের রাস্তায় ছোট্ট এক গয়নার স্টল নিয়ে বসেন সেন্টু। স্টলটা খুব সাধারণ, চোখে না-ও পড়তে পারে। কিন্তু তার দোকানের প্রতিটি পেন্ডেন্ট যেন নিজের একটা করে গল্প বয়ে বেড়ায়। কোনোটা অলংকরণে ভরপুর, কোনোটা যেন হারিয়ে যাওয়া কোনো রূপকথার অংশ।

'সবকিছুরই একটা মানে আছে', বলেন সেন্টু। 'আমি শুধু জিনিস বিক্রি করি না, আমি গল্পও বিক্রি করি।'

তবে মানুষকে তার গল্পটাই বেশি টানে। কষ্ট নয়, তার মমতার গল্প- একটা পাখি খুঁড়িয়ে হেঁটে এলে যেভাবে তিনি হাঁটু গেড়ে বসেন, বা রেলিংয়ে বসে কাঠবাদাম খাওয়া কাঠবিড়ালির দিকে যেভাবে হাসিমুখে তাকিয়ে থাকেন।

পথচারীরা মাঝে মাঝে ছবি তোলেন, জিজ্ঞেস করেন নানা কথা। কিন্তু জনপ্রিয় হওয়া তার লক্ষ্য ছিল না কখনো।

'প্রাণীরা কথা বলতে পারে না, কিন্তু তারা অনুভব করতে পারে। সেটাই তো অনেক',  বলেন তিনি।

তার চারপাশে কোনো পুরস্কার বা প্রশংসাপত্র নেই। তিনি খুব সাধারণ একজন মানুষও হয়ে কোনো কিছুর আশা না করেই তার মমতার বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন চারপাশে।

অনুবাদ করেছেন সৈয়দা সুবাহ আলম

 

Comments

The Daily Star  | English

Is the govt backing the wrongdoers?

BNP acting Chairman Tarique Rahman yesterday questioned whether the government is being lenient on the killers of a scrap trader in front of Mitford hospital due to what he said its silent support for such incidents of mob violence.

6h ago