ঢাকার রাস্তাগুলোকে বর্ণিল করে তোলা পথশিল্পীদের গল্প

পথশিল্পী
ছবি: শাহরিয়ার কবির হিমেল

ব্যস্ত এই শহরে বাস করে আর্ট গ্যালারিতে গিয়ে ছবির প্রদর্শনী দেখার জন্য সময় বের করা আমাদের অনেকের কাছেই বিলাসিতা। তবে এমন যদি হয়, শিল্পকর্মগুলোই আপনার অফিস যাওয়ার পথে কিংবা প্রাতঃভ্রমণের পথের পাশে এসে হাজির হয়? হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন।

ঢাকায় এমন কিছু শিল্পী আছেন যাদের সৃষ্টিকর্মগুলো কোনো গ্যালারির চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সেগুলো মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়। এই স্বাপ্নিক শিল্পীরা আমাদের শহরের ফুটপাতগুলোকে ক্যানভাসে এবং রাস্তার কোণগুলিকে গ্যালারিতে পরিণত করেছেন। এই পদক্ষেপ হয়তো খুব ছোট কিন্তু আদতে অসামান্য বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে। আসুন, এবার শুনি তাদের গল্প।

পথের বাঁকে বাঁকে

প্রথম যার গল্প দিয়ে শুরু করব, তার নাম নাজির হোসেন। যিনি 'টাইগার নাজির' নামেই বেশি পরিচিত। তিনি একজন স্বশিক্ষিত পটুয়া বা পটচিত্রশিল্পী। নিজের পটচিত্রগুলোয় বাঘের ছবি আঁকার মাধ্যমে তিনি এই নামে পরিচিতি পেয়েছেন। নাজির হোসেনকে দেখতে পাবেন শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের বাইরে। হাতে রং-তুলি আর সামনে রঙিন ক্যানভাস, সব মিলিয়ে দূর থেকে দৃশ্যটিকে জীবন্ত ক্যানভাস বলে মনে হয়। আপনার যদি ভাগ্য ভালো হয় আর যদি যথাযথ সময়ে সেখানে যেতে পারেন তাহলে হয়তো দড়িতে ঝোলানো অবস্থায় দেখতে পাবেন তার আঁকা নতুন ছবিগুলো।

নাজির হোসেনের প্রতিভা প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় ২০১৫ সালে। সেসময় তার শক্তিশালী চিত্রকর্ম বান্টোরা কুন বা বাংলার বাঘ বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যকার ব্যবসায়ীর সম্পর্কন্নোয়ন কর্মসূচির ম্যাসকট হিসেবে নির্বাচিত হয়। প্রথমবারের মতো ছবির হাটের উন্মুক্ত আর্ট গ্যালারিতে নিজের পটচিত্রের প্রদর্শনী করেন তিনি।

অ্যালেক্সিস ক্রাসিলোভস্কি ও শামীম আখতার রচিত 'টুকি দ্য টাইগার' নামের উপন্যাসেও নাজির এঁকেছেন রঙিন ও প্রাণবন্ত সব ছবি।

এতসব অর্জনের পরেও নাজির হোসেন অত্যন্ত বিনয়ী, সবসময় থাকেন মাটির কাছাকাছি। যেখানেই যান না কেন, তার কপালে বাঁধা থাকে বাংলাদেশের পতাকা। তার অনুপ্রেরণা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'মায়ের হাতে সেলাই করা নকশী কাঁথাই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। তিনি তার সুই-সুতোর ফোঁড়ে যে গল্পগুলো ফুটিয়ে তুলতেন, সেগুলোই আমার শিল্পকে অনুপ্রাণিত করেছে।'

নাজির হোসেন রাস্তায় বসে ছবি আঁকতে পছন্দ করেন। তার মানে এই নয় যে, তার অন্য কোথাও আঁকার সুযোগ নেই। বরং এর পেছনে তার সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। তিনি বলেন, 'রাস্তা আমাকে মানুষের সঙ্গে সংযুক্ত রাখতে সাহায্য করে। শিল্প মানেই কেবল গ্যালারিতে প্রদর্শনের জন্য আঁকা নয়। বরং এটি তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যারা হয়তো কখনোই গ্যালারিতে পা রাখতে পারে না। আমার শিল্প পথচলতি মানুষকে কিছুটা বিরতি নিতে এবং সে সম্পর্কে কিছু অনুভব করতে বা ভাবতে সাহায্য করে।'

বাতাসে ভেসে বেড়ানো সুর

নাজির হোসেনের কাছ থেকে কয়েক পা এগোলেই চারুকলার বাইরে দেখতে পাবেন বংশীবাদক মো. লাল মিয়াকে। যিনি প্রায় ৪০ বছর ধরে বাঁশি তৈরি করে চলেছেন, বাজাচ্ছেনও। পথের ধারে তাকে বাঁশি বাজাতে দেখে অনেক পথচারীই কৌতূহলী হয়ে কিছু সময়ের জন্য দাঁড়িয়ে যান এবং তার বাঁশির প্রশংসা করেন।

লাল মিয়াকে বাঁশি বাজতে দেখে তার সঙ্গে কথা বলার লোভ সামলাতে পারিনি। কিন্তু আমি সেভাবে কথা শুরু করার আগেই তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলেন, 'আপনি কি এই প্রথম আমাকে খেয়াল করলেন?' আমি উত্তর দিলাম, 'হ্যাঁ'।

জবাবে তিনি যা বললেন তা শুনে আমি রীতিমতো বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। তিনি বলেন, 'আপনি এখানে পাঁচ বছরেরও বেশি সময় পড়ালেখা করেছেন, অথচ আমাকে একবারও খেয়াল করেননি। এটাই বাংলাদেশে একজন পথশিল্পীর জীবন। কিছু সংখ্যক মানুষই কেবল আমাদের প্রশংসা করেন। এর পাশাপাশি আমাদের আবেগই আমাদের এগিয়ে নিয়ে যায়।'

লাল মিয়ার কথাগুলো আমাকে অপরাধবোধে ফেলে দেয়। তার কথা শুনে মনে পড়ে গেল ঢাকার রবীন্দ্র সরোবরে দেখা হওয়া একটি পরিবারের কথা। যেখানে বাবা-মেয়ে মিলে চমৎকার সুরে ভাটিয়ারি গান গাইতেন। আর তাদের হৃদয়গ্রাহী পরিবেশনা শুনতে ভিড় করতেন সরোবরে বেড়াতে আসা মানুষেরা। তবে এখন আর তাদের সেখানে পাওয়া যায় না। সম্ভবত তারাও ঢাকার রাজপথে টিকে থাকার যুদ্ধে পিছিয়ে পড়ে হারিয়ে গিয়েছেন।

লুকিং গ্লাস দিয়ে দেখা

এই শহরের পথে আরেকজন নিবেদিতপ্রাণ শিল্পীর দেখা মিলবে। তার নাম মোহাম্মদ হিরু। ভাঁড়ের পোশাকে যিনি বায়োস্কোপ দেখান। যদিও গরমকালে কিছুদিনের জন্য সাধারণ পোশাকেই তার দেখা মেলে, তবে যে ঋতুই হোক না কেন তার রঙিন ঝলমলে টুপি দেখলেই তাকে চিনতে পারবেন আপনি।

সাধারণত প্রতিদিন বিকাল ৫টার দিকে ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডের আনাম র‌্যাংগস প্লাজার কাছে দেখা মিলবে মোহাম্মদ হিরুর। যেখানে তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন তার হাতে তৈরি বায়োস্কোপ যন্ত্রটি নিয়ে। আপনি যখন তার বায়োস্কোপের ছোট ছিদ্র দিয়ে ভেতরে উঁকি দেবেন, তখন তিনি গানে গানে আপনাকে ভেতরের দৃশ্যগুলো বর্ণনা করবেন।

যতবারই মোহাম্মদ হিরুকে জিজ্ঞেস করেছি, তিনি বলেছেন, 'এই বায়োস্কোপটি আমার স্বপ্নের বাক্স। আমি একেবারে শূন্য থেকে এটি তৈরি করেছি। কেউ আমাকে এ বিষয়ে শিক্ষা দেয়নি। প্রথমবার বগুড়ায় গ্রামের একটি মেলায় একজনের কাছে বায়োস্কোপ যন্ত্র দেখি। তখনই ঠিক করে ফেলি যে, এই যন্ত্র আমি তৈরি করব। সেসময় আমি নিতান্তই শিশু ছিলাম। সেই ছোটবেলায় দেখা স্বপ্ন আমি পূরণ করেছি, আমি এখন আমার স্বপ্ন নিয়েই বেঁচে আছি।'

আমাদের অতি পরিচিত মোহাম্মদ হিরুকেও তার স্বপ্নের পথে চলার জন্য নানা ঘাতপ্রতিঘাত পেরোতে হয়েছে। তারপরেও যেহেতু বায়োস্কোপ দেখানো তার নেশা, তাই সেই নেশার টানেই তিনি এটিকে এখনও পেশা হিসেবে টিকিয়ে রাখতে পেরেছেন।

আমার জন্য মোহাম্মদ হিরু পথশিল্পের সৌন্দর্য এবং অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে টিকে থাকার জীবন্ত উদাহরণ। সব ধরনের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে আলোকবর্তিকা হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমার মনটা ভরে যায়।

তুলির আঁচড়ে পথ চলা

এবার কথা বলব একজন খণ্ডকালীন পথশিল্পী মোহাম্মদ ফজর আলীর বিষয়ে। যিনি পড়ালেখা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগে। প্রায়ই তাকে দেখা যায় ক্যানভাস আর তুলি নিয়ে ব্যস্ত অবস্থায় চারপাশের দৃশ্য্কে ফুটিয়ে তুলতে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার কিংবা কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, যে জায়গাতেই দেখা যাক না কেন, কেবল দেখবেন তিনি নিবিষ্ট মনে প্রতিকৃতি আঁকছেন বা স্কেচ করছেন।

শিল্পের প্রতি এই ভালোবাসারও কিছু ক্ষতিকর দিক রয়েছে বলে মনে করেন ফজর।

তিনি বলেন, 'অন্যদের কাছ থেকে ছবি আঁকার বিষয়ে যে প্রবল অনাগ্রহের সম্মুখীন হই আমি, তা মাঝে মাঝে আমাকে হতাশায় ডুবিয়ে দেয়। একবার আমার আঁকা একটি স্কেচের দাম শুনে একজন গ্রাহক ভীষণ অপমান করেছিলেন। তার মতে, ছবি প্রিন্ট করে নিলে তা ভালো রেজুলেশনেও যেমন পাওয়া যেত, তেমনি দামও কম পড়ত।'

ফজরের এই কথাগুলো দিয়ে শিল্পীদের সংগ্রামের চিত্র স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। যারা নিজেদের সমস্ত শক্তি-সত্তা দিয়ে শিল্পকর্ম তৈরি করেন কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই কাজের যথাযথ স্বীকৃতি পান না।

এইসব শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে এটুকু বুঝেছি যে, আমাদের সমাজে শিল্প বা শিল্পীর যথাযথ কদর নেই, প্রশংসা করা তো অনেক দূরের বিষয়। আর যখন সেই শিল্পী বা শিল্প হয় পথের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তখন তো সেটিকে অপ্রয়োজনীয় বা অযৌক্তিক হিসেবেই দেখা হয় বেশিরভাগ সময়।

তবে লাল মিয়া, হিরু মিয়া বা টাইগার নাজিরের মতো মানুষেরা এখনও আমাদের চারপাশেই আছেন, যারা তাদের নিজেদের আবেগ নিয়ে বেঁচে আছেন এবং সংস্কৃতির একটি অংশকে টিকিয়ে রাখতে নিজেদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করছেন।

তাই পরের বার যখন আপনি আশপাশে কোথাও থেকে বাঁশির নরম সুর ভেসে আসতে শুনবেন কিংবা কোথাও পটচিত্র আঁকতে দেখবেন; কিছুসময়ের জন্য সেখানে দাঁড়ান। শুনুন, দেখুন। কারণ প্রতিটি সুর কিংবা তুলির প্রতিটি আঁচড়ের পেছনে রয়েছে একটি টিকে থাকার গল্প। সেই গল্পটি বোঝার চেষ্টা করুন।

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

 

Comments

The Daily Star  | English

BDR carnage rooted in 'long-term plot', says investigation commission

It was abetted by intelligence failures, gross negligence, and the involvement of several political figures, according to the commission chief

29m ago