অবসরজীবনের চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে যেভাবে আনন্দে থাকবেন

চাকরি থেকে অবসর
ছবি: এআই/ স্টার

কিছুদিন আগেই এক বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। যার বাবা বেশ কয়েক বছর হলো সরকারি চাকরি থেকে অবসরে গেছেন। দীর্ঘ সময় প্রতাপের সঙ্গে চাকরি করেছেন। অফিসে যার সুনামই ছিল সমস্যা সমাধানকারী হিসেবে।

সেই বন্ধুটি বলছিল, `যে বাবা অফিসের সবার সমস্যা সমাধান করতেন এখন তিনি বাসায় আমাদের সবার জন্য নানা ধরনের সমস্যা তৈরি করছেন। কে কখন ফিরল, কোন তরকারি ফ্রিজে নষ্ট হচ্ছে, কার অফিস থেকে ফিরতে দেরি হচ্ছে সব কিছুর হিসাব রাখতে শুরু করেছেন।'

কথা বলে জানতে পারলাম, অবসরের পর বাড়িতেই আছেন বন্ধুর বাবা। যেহেতু তার এখন আর কোনো দাপ্তরিক কাজ নেই। তাই তিনি এবার বাড়ির নানা কাজে মনোযোগী হচ্ছেন। কিন্তু যেহেতু এসব বিষয়ে তিনি কখনও নাক গলাননি বা সবাই সবার মতো জীবন গুছিয়ে নিয়েছে, তাই তার এই অনুপ্রবেশ বাড়ির বাকি বাসিন্দাদের নিয়মিত জীবনকে সংকটে ফেলেছে। ফলে নিয়মিতই ছেলে-ছেলের স্ত্রী, মেয়ে এবং নিজের স্ত্রীর সঙ্গে তার মন কষাকষি চলছে। মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে চিৎকারও করে ফেলছেন তিনি।

আমাদের দেশের বেশিরভাগ চাকরিজীবী অবসরের পর সত্যিকার অর্থেই অবসর সময় কাটান। দীর্ঘ সময় কর্মব্যস্ত থাকার পর যখন তারা কর্মহীন হয়ে পড়েন তখন তাদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কেউ সংসারের খুঁটিনাটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, কেউ হঠাৎ করে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বিবাদে জড়ান আবার কেউ কেউ এই নিস্তরঙ্গ অবসর মেনে নিতে না পেরে হতাশায় ভোগেন।

অথচ টানা চাকরির পর এই অবসর হওয়ার কথা ছিল উপভোগ্য, যেমনটি আমরা বিভিন্ন সিনেমা-নাটকে দেখেছি।

ব্যস্ত কর্মজীবনে সুযোগ পেলেই অনেকে ভাবেন অবসরে গেলে সঙ্গীকে নিয়ে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে পড়বেন, কিংবা নাতি-নাতনিসহ পরিবারের সবাইকে নিয়ে সুন্দর সময় কাটাবেন। অনেকের ইচ্ছা থাকে বন্ধুদের সঙ্গে বিরামহীন আড্ডা দেবেন, বাড়ির পেছনের খালি অংশে সবজি চাষ করবেন কিংবা পুকুরে মাছ চাষ করবেন। কিন্তু সত্যিকার অবসর যখন মেলে, তখন বয়সের কারণে হোক আর পারিপার্শ্বিক না কারণে হোক এসব ভাবনা বাস্তবে আর রূপ নেয় না। অবসর সময়টুকুও তখন বেশ দীর্ঘ মনে হয়।

বাইরে থেকে দেখে মনে হয়, অবসরে যাওয়া ব্যক্তিটি হয়তো ভালোই আছেন। রোজ সকালে তৈরি হয়ে বের হওয়ার তাড়া নেই, অফিসের রাজনীতির শিকার হতে হচ্ছে না, নিয়মিত খাওয়া দাওয়া করতে পারছেন, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে পারছেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি এক ধরনের আত্মপরিচয়ের সংকটে ভুগছেন।

সারাজীবন পিয়ন, চাপরাশি নিয়ে চলা মানুষটিকে যখন নিজের সব কাজ নিজেকেই করতে হয়, তখন তা তার জন্য এক ধরনের মানসিক যন্ত্রণা বটে। আবার যিনি কাজ করতে পছন্দ করতেন, নিজের চাকরি বা কাজকে ভালোবাসতেন; তার জন্যও সেসব ছেড়ে বসে থাকা কঠিন। ফলে দেখা যায়, মুক্ত বা স্বচ্ছন্দ্য বোধ করার চেয়ে তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন, তার চারপাশের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করতে শুরু করেন। এদের মধ্যে অনেকেই উদ্বেগ ও ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনের মতো সমস্যায়ও ভুগতে শুরু করেন।

অবসর জীবনের চ্যালেঞ্জ

সাধারণত অবসরে যাওয়ার পর মানুষ যেসব সমস্যার মধ্যে পড়েন তার মধ্যে অন্যতম হলো আর্থিক সীমাবদ্ধতা। কারণ আপনি যত ভাতাই পান না কেন, তা প্রতি মাসের বেতনের মতো হবে না। নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে আপনাকে চলতে হবে। ফলে আর্থিক স্বাধীনতা কমে যাওয়া এক ধরনের উদ্বেগ তৈরি করে।

আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো পরিচয় সংকট। অবসরে যাওয়ার পর থেকে আপনি আর সচিব নন, প্রধান শিক্ষক নন, ডিজাইনার কিংবা বিক্রয়কর্মী নন। মোটকথা সরাসরি পরিচয় দেওয়ার মতো কোনও পরিচয় যখন থাকে না, তখন স্বাভাবিকভাবেই মানুষ হতাশায় ভোগেন।

দীর্ঘদিন সহকর্মীদের সঙ্গে ব্যস্ত সময় কাটানোর পর হঠাৎ করে একলা হয়ে যাওয়া এক ধরনের মানসিক চাপ তৈরি করে। ডেডলাইন নেই, মিটিং নেই, একের পর এক টেলিফোন নেই, কারও জরুরি প্রয়োজনে সাড়া দিতে হচ্ছে না, কাজপাগল মানুষের জন্য এটা এক ধরনের শাস্তিও বটে।

যে মানুষটি একদিন আগেও কোনো না কোনো কর্মপরিসরের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যক্তি ছিলেন, তিনি অবসরে গিয়ে নিজেবে অপ্রয়োজনীয় বোধ করতে শুরু করেন। যা তার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য নেতিবাচক হিসেবে ধরা দেয়।

অবসরের পরও থাকুন সক্রিয়

এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং সুস্থ থাকতে অবসরের পর সক্রিয় থাকার কোনো বিকল্প নেই। আর কীভাবে সক্রিয় থাকবেন বা কোনো উপায়ে কাজের মধ্যে থাকবেন সেটি নির্ভর করছে প্রত্যেকের নিজের ওপর।

আপনি চাইলে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কারও মেন্টর বা কাউন্সেলর হিসেবে কাজ করতে পারেন। অর্থাৎ দীর্ঘদিন যে পেশায় ছিলেন, যে কাজে আপনার অভিজ্ঞতা আছে সেই অভিজ্ঞতা আপনি ভাগ করে নিতে পারেন। নবীন পেশাজীবীদের জন্য হতে পারেন মেন্টর। এতে আপনি আগের পেশার কাছাকাছিও থাকলেন আবার নতুন একটি ক্যারিয়ারও তৈরি করতে পারলেন।

যদি আর্থিক সংকট না থাকে তাহলে যুক্ত হতে পারেন সামাজিক কাজে। সেটা হতে পারে আশপাশের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়ানো, তাদের জীবন মান উন্নয়নে সহায়তা করা, তরুণদের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি, প্রতিবেশি শিশুদের নিয়ে গল্পের আসর বা যেকোনো কিছু।

চাইলে নিজের নাতি-নাতনিকে পড়ানোর কাজটি নিজের কাঁধে তুলে নিতে পারেন। কিংবা তাদের সঙ্গে স্কুলে যাওয়া-আসা করতে পারেন। নতুন প্রজন্মের সঙ্গে এই সংযোগ আপনার সামনে খুলে দেবে নতুন দিগন্ত। এতে আপনার সময় যেমন ভালো কাটবে তেমনি একাকিত্ব ঘিরে ধরার সময় পাবে না।

পাশাপাশি নিজের বই পড়ার অভ্যাসটিও ফিরিয়ে আনতে পারেন। ছোট্ট একটি বুক ল্যাম্প কিনে নিন, বুকশেলফ থেকে নামিয়ে নিন প্রিয় কোনো বই বা সময়ের অভাবে পড়তে না পারা বইটি। তারপর রোজ রাতে ঘুমানোর আগে অন্তত আধঘণ্টা বই পড়ুন। অভ্যাস ফিরে এলে দিনের বেলাতেও বই আপনাকে চমৎকারভাবে সঙ্গ দেবে।

অবসর জীবনে চাইলে আপনি নতুন কোনো দক্ষতা শিখতে পারেন। হয়তো সারাজীবন আপনি অ্যাকাউন্টসের মতো কঠিন জায়গায় কাজ করেছেন, কিন্তু ইচ্ছা ছিল শিল্পী হওয়ার। তো অবসরেই সে সুযোগ বেছে নিতে পারেন। চাইলে শিখতে পারেন ছবি আঁকা কিংবা অন্য যা ইচ্ছা। নিজের যে শখটি এতদিন ব্যস্ততার কারণে পূরণ করতে পারেননি, অবসরই কিন্তু তা পূরণের শ্রেষ্ঠ সময়।

নতুন জীবনে নতুন নতুন বন্ধুও খুঁজে নিতে পারেন। যেহেতু এখন অবসর, তাই আপনার মতো সমমনা অবসরপ্রাপ্তদের খুঁজে বের করুন। তাদের সঙ্গে সময় কাটান, হাঁটতে যান, ঘুরতে যান। নিজেদের মনের কথা খুলে বলুন। বয়সী এই বন্ধুরাও আপনার জীবনে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিতে পারেন।

চাইলে অবসর জীবনে নিজেকে বাগানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। বাড়ির আশপাশে তো বটেই ছাদবাগান করে আয়ও করা সম্ভব। এছাড়া সমাজহিতৈষী চিন্তা থাকলে এলাকার মানুষকে নিয়ে গাছ লাগানো কর্মসূচিও বাস্তবায়ন করতে পারেন।

অবসরের পর নিজের স্ত্রী বা স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে যেতে পারেন নতুন দেশ। সেটা সম্ভব না হলেও ঘুরে দেখুন বাংলাদেশ। এতদিনের ব্যস্ততায় সঙ্গীকে যে সময় দিতে পারেননি, অবসরে তা পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করা যেতে পারে।

এসবের পাশাপাশি চাইলে ছোট কোনো ব্যবসা বা উদ্যোগও শুরু করতে পারেন। নিজের অভিজ্ঞতা ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা মিলিয়ে পারিবারিকভাবেও ব্যবসা শুরু করা যেতে পারে। এতে আপনার সময়ও ভালো কাটবে, পাশাপাশি নিয়মিত আয়ের উৎসও তৈরি হবে।

অবসরে নিজেকে চিনুন, নিজেকে ভাঙুন

কর্মজীবনে মানুষের যে রুটিন থাকে, স্বাভাবিকভাবেই অবসরে তা থাকে না। এতদিন কাজের প্রয়োজনে যেসব ক্ষতিকর অভ্যাস গড়ে তুলেছিলেন যেমন সকালে খালি পেটে চা পান করা কিংবা রাত জেগে কাজ করা, সেসব অভ্যাস ত্যাগ করুন।

সুস্থ থাকতে নিজের খারাপ অভ্যাসগুলো ত্যাগ করুন। নিয়মিত সকালে বা বিকালে হাঁটার অভ্যাস করুন। সময়মতো ঘুম থেকে ওঠা ও ঘুমাতে যাওয়ার অভ্যাস করুন। বাইরের খাবার, অতিরিক্ত তেল-মশলাদার খাবার, ধূমপান ছেড়ে দিন। স্বাস্থ্যকর অভ্যাস যেমন গ্রিন টি পান করুন, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাবার খান। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন, বিশেষ করে ডায়াবেটিস থাকলে কঠোন নিয়মের মধ্যে চলতে চেষ্টা করুন। এতে আপনার শরীর সুস্থ থাকবে, মন ভালো থাকবে এবং পরিবারের সদস্যরাও আপনাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়বেন না।

পরিবর্তনকে মেনে নিন

অবসরের পর আপনার জীবনে যেসব পরিবর্তন এসেছে সেগুলোকে যেমন মেনে নিন, তেমনি আপনার পরিবারের সদস্যরা যে জীবনযাপন করছেন সেগুলোও মেনে নিতে শুরু করুন। মেনে নিন যে প্রত্যেকেরই নিজের জীবন যাপনের স্বাধীনতা আছে, পরিবারের সদস্যরা আপনার অধস্তন কর্মী নন যে সবসময় আপনাকে ভয় পেয়ে চলবেন বা আপনার কথায় উঠবস করবেন। তাদের জীবনকে নিজের গতিতে চলতে দিন। আপনি নিজের অবসর ও সময়ের প্রতি মনোযোগ দিন। যেন আপনার অবসরযাপন অন্য কারো জীবনে সংকট সৃষ্টি না করে সেদিকে খেয়াল রাখুন। 

একজন কাজপ্রিয় মানুষের জন্য অবসরজীবন সহজ নয়। সে কারণে অবসরের পরও নিজেকে ব্যস্ত রাখার উপায় খুঁজে নিন। এতে আপনি যেমন ভালো থাকবেন, ভালো থাকবে আপনার চারপাশও।

 

Comments