কফির নেশাকে ক্যারিয়ারে পরিণত করে বারিস্তা হবেন যেভাবে
ধরুন, আপনি কফিপ্রেমী। মনে করুন, শুধু আয়েশ করে উপভোগ করাই নয়, কীভাবে এক কাপ চমৎকার কফি তৈরি করতে হয় সে বিষয়েও দক্ষ হয়ে উঠছেন আপনি। নিখুঁত লাতে তৈরির কলাকৌশলটা ধরে ফেলছেন এবং বিশ্বজুড়ে কফি বিনের যে জটিল বৈচিত্র্য আছে তা বোঝার মতো বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠছেন। অর্থাৎ হয়ে উঠছেন একজন প্রশিক্ষিত বারিস্তা। দারুণ বিষয়, তাই না?
বিশেষ করে যারা বিদেশে লেখাপড়া করতে চান তাদের জন্য এটি হতে পারে লাভজনক ক্যারিয়ার। দক্ষ বারিস্তার চাহিদা এখন অনেক বেশি। তাই বারিস্তা প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম হতে পারে সফল ক্যারিয়ারে প্রবেশ দুয়ার।
নাভিদ হাসান একজন রন্ধন বিশেষজ্ঞ এবং উদ্যোক্তা। কফির প্রতি ভালোবাসা কীভাবে তাকে বিশ্বজুড়ে পরিচিত করেছে, সে গল্পই বলছিলেন আমাদের।
নাভিদ বলেন, 'আমি সবসময়ই কফি শিল্পে কাজ করতে চেয়েছিলাম। এর ধারাবাহিকতায় এসসিএ (স্পেশালিটি কফি অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকা) সনদ অর্জন করি। এটি বেশ দীর্ঘ প্রক্রিয়া। পড়াশোনা করতে হয় এবং সনদ পাওয়ার জন্য পরীক্ষা দিতে হয়।'
ভারত, চীন, সিঙ্গাপুর, নেপাল ও ইতালির কফি বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে কয়েক বছর প্রশিক্ষণ নেওয়া ও গবেষণার পর ২০২০ সালে ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় নাভিদ শুরু করেন কফি রোস্টার্স।
এই উদ্যোগ শুরু আগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করেছেন নাভিদ। কখনও কখনও টানা ৩৪ ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছেন পর্যালোচনা আর গবেষণার কাজে।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে নাভিদ বলেন, 'ভালো স্বাদের কফি পেতে হলে বেশ কিছু জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যার মধ্যে দেখতে হয় কফির আর্দ্রতা, জানতে হয় কফি বিনের উৎপত্তির স্থান। বিনের ঘনত্ব সম্পর্কে জ্ঞান প্রয়োজন এবং স্বাদের প্রোফাইল করাও জানতে হয়।'
বিশ্বের বড় বড় ক্যাফেগুলো গ্রাহকের কাপে বিশেষায়িত স্বাদের কফি তুলে দেয়। এর জন্য কাজ করেন প্রশিক্ষিত বারিস্তারা, যারা সঠিক স্বাদের কফি তৈরিতে পারদর্শী। এই বারিস্তাদের দেখেই ঢাকায় দক্ষ বারিস্তা প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজনের অনুপ্রেরণা পান নাভিদ।
তিনি বলেন, 'এটা কেবল আমাদের বারিস্তাদের জন্যই নয়, কফি শিল্পে প্রবেশ করতে চান এমন যে কারও জন্য এই আয়োজন। কফির জন্য বিশেষায়িত ক্যাফেতে অত্যন্ত সূক্ষ্ম কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হয়। যার পুরোটাই অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান নির্ভর। সাধারণত এসব ক্যাফেতে তারাই কাজ করেন যাদের মনে কফির প্রতি ভালোবাসা প্রগাঢ় এবং যেসব পণ্য ব্যবহার করা হয় সেগুলোও সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন।'
বারিস্তা প্রশিক্ষণ কোর্সটির পরিসর বেশ ব্যাপক। সেখানে কফি বিন রোস্ট করার মূল ১০টি বৈশিষ্ট্য শেখানোর পাশাপাশি স্বাদের প্রোফাইলিং করতেও শেখানো হয়।
নাভিদ বলেন, 'কফি টেস্টিং আপনার ঘ্রাণশক্তির ওপর নির্ভর করে। ঘ্রাণশক্তি দিয়েই মূল কাজটি করতে হয়। কফি অত্যন্ত জটিল পদার্থ, যার ভেতরে থাকে ৮০০ এর বেশি উদ্বায়ী রাসায়নিক। এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আপনার কফি সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা অন্য স্তরে পৌঁছে যায়, কারণ একজন যে কফি ব্যবহার করা হচ্ছে তার পেছনের জটিল গল্প এবং স্বাদের প্রোফাইল সম্পর্কে একজন বারিস্তাকে অবশ্যই জানতে হবে।'
কী শিখবেন
কফি শিল্পে যে চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ রয়েছে তার জন্য আপনাকে সঠিকভাবে প্রস্তুত করে তুলবে এই পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণ।
ছয় দিনের প্রশিক্ষণের শুরু হয় কফির মৌলিক বিষয়গুলো শেখার মধ্য দিয়ে, যার মধ্যে প্রথমেই রয়েছে রোস্টেড কফি বিনের ১০টি বৈশিষ্ট্য বোঝা। কফি তৈরিতে বিশেষজ্ঞ হতে হলে এই মূল বিষয়টি আপনাকে ভালোভাবে শিখতেই হবে।
ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় দেখা যায় আসল জাদু। প্রতিটি কাপে কফির গুণমান নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রশিক্ষণার্থীরা অনুশীলন করেন কীভাবে এসপ্রেসো নিষ্কাশন করতে হয় এবং কীভাবে প্রতিটি কাপ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ভরতে হয়।
কফিভেদে দুধ ফোটানোর মধ্যেও যে সূক্ষ্ম পার্থক্য থাকে তা শেখানো হয়, জানানো হয় লাতে তৈরির কলাকৌশল। এ দুটি কাজই একাধারে শিল্প ও বিজ্ঞানের মেলবন্ধন।
প্রশিক্ষণে বিকল্প পানীয় তৈরির প্রক্রিয়া এবং সিঙ্গেল অরিজিন এসপ্রেসো তৈরিও শেখানো হয়। প্রশিক্ষণার্থীদের বিভিন্ন ধরনের কফি তৈরির কৌশল শেখানো হয় যেমন অ্যারোপ্রেস, কেমেক্স এবং ভি-সিক্সটি।
সিঙ্গেল অরিজিন এসপ্রেসো তৈরির ক্ষেত্রে কফি বিনের উৎপত্তি বা স্বাদের প্রোফাইল কীভাবে কফির স্বাদে বৈচিত্র্য তৈরি করে, তাও প্রশিক্ষণার্থীদের বোঝানো হয়।
এসবের পাশাপাশি প্রশিক্ষণে শেখানো হয় একজন বারিস্তা হয়ে ওঠার ব্যবসায়িক দিকটিও। কফি তৈরির সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণ, গ্রাহকসেবা এবং ক্যাফে ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় খুঁটিনাটিও এই প্রশিক্ষণের অংশ। প্রশিক্ষণ কোর্সটির লক্ষ্য হলো ভালো বারিস্তা তৈরি করা, যারা কফির ব্যবসায় ইতিবাচক অবদান রাখতে সক্ষম হবেন এবং ভালো মানের কফি তৈরি করতে শিখবেন।
কফি তৈরিতে পারদর্শী করার পাশাপাশি এই কোর্সটি পরিবেশ সচেতনতার ওপরও জোর দেয়। কফি রোস্টোর্সে প্লাস্টিকের বদলে কাঁচের বোতলে পানি পরিবেশন করা হয়। যার মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই পদ্ধতি ব্যবহারে উৎসাহিত করা হয়।
নাভিদ বলেন, 'আমরা মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে চাই। যেন মানুষ তার কাজের ফলাফল সম্পর্কে আরও সচেতন হয়। আমরা চাই, কফি চেইন যেন কৃষক, উৎপাদক, বারিস্তা ও গ্রাহকদের ওপর ইতিবাচক প্রভাব রাখে।'
প্রশিক্ষণটি নিয়ে অনেক শিক্ষার্থীই উপকৃত হয়েছেন। বিশেষ করে দেশের বাইরে লেখাপড়া করতে গিয়ে বিভিন্ন ক্যাফেতে খণ্ডকালীন চাকরি পাওয়া সহজ হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে নাভিদ বলেন, 'আমাদের বহু শিক্ষার্থী এই প্রশিক্ষণ নিয়ে বাইরে পড়তে গেছেন এবং পশ্চিমা বিশ্বে কফি শিল্প অনেক বিস্তৃত হওয়ায় সেখানে তাদের কাজ পেতে সুবিধা হয়েছে।'
এমনকি এই কোর্স সম্পন্ন করা অনেক দক্ষ বারিস্তা মধ্যপ্রাচ্যে কাজের সুযোগ পেয়েছেন।
তাই, আপনি যদি ঢাকায় বসবাস করে থাকেন এবং প্রথাগত লেখাপড়ার বাইরে চমৎকার কোনো কাজ শিখতে চান তাহলে বারিস্তা কোর্সটি করতে পারেন। এই প্রশিক্ষণ কেবল আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকেই ঋদ্ধ করবে না, বিশ্বজুড়ে আকর্ষণীয় পেশা বেছে নেওয়ারও সুযোগ সৃষ্টি করবে।
আপনি যদি একজন কফি সমঝদার হয়ে থাকেন কিংবা বিদেশে পড়াশোনা করতে ইচ্ছুক হন, তাহলে এই বারিস্তা প্রশিক্ষণ কোর্সের মাধ্যমে আপনার সামনে খুলে যেতে পারে সম্ভাবনার দুয়ার। হতে পারে আপনিই হয়ে উঠবেন ঢাকার কফি জগতের পরবর্তী তারকা!
অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ
Comments