সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওভারশেয়ারিংয়ের আগে যা ভেবে দেখা উচিত

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম
ছবি: সংগৃহীত

আমাদের নিত্যদিনের যোগাযোগের, নিজের জীবনের সুখ-দুঃখ, ছোট থেকে বড় সব অর্জন, এলোমেলো ভাবনাসহ অনেক কিছুই এখন চলে এসেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাঝে। কিন্তু 'শেয়ারিং' ও 'ওভারশেয়ারিং'য়ের মধ্যকার সূক্ষ্ম সীমারেখা নির্ধারণ করতে আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। অন্তত কিছু ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওভারশেয়ারিং নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

 

সম্পর্কের ক্ষেত্রে

যেকোনো সম্পর্ক, বিশেষ করে রোমান্টিক সম্পর্ক আমাদের জীবনের বিশেষ জায়গা জুড়ে থাকে। এমনকি আজকালকার সময়ে তো সামাজিক মাধ্যমে সম্পর্ক নিয়ে কতবার পোস্ট করা হলো কিংবা আদৌ হলো কি না, তা নিয়েও ঝামেলা সৃষ্টির সুযোগ থাকে। তাই উভয় পক্ষই চেষ্টা করে, সেইসঙ্গে উপভোগও করে নিজেদের সম্পর্কের বিষয়ে বারংবার ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে জানান দিতে।

কিন্তু এই জানান দেওয়া বা আনন্দের বিষয়গুলো ভাগ করে নেওয়ার বিষয়টি যেন অতি মাত্রায় ব্যক্তিগত না হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে। মানুষ তার অফলাইন জীবনে যেমন, অনেক ক্ষেত্রেই সামাজিক মাধ্যমে এর একটা ভিন্ন উপস্থাপন ঘটে থাকে। সমাজবিজ্ঞানী বেন অ্যাগার তার বই 'ওভারশেয়ারিং: প্রেজেন্টেশন অফ সেলফ ইন দ্য ইন্টারনেট এইজ' বইয়ে বলেছেন যে, অনেকে সামনাসামনি যোগাযোগ বা ফোন কলের চাইতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের মতামত, অনুভূতি এমনকি অনেক সংবেদনশীল বিষয়েও বেশি স্পষ্ট বার্তা দেন। কিন্তু এই অতিপ্রকাশের বিষয়টি অন্যদের জন্য কিছুটা বিরক্তির জন্ম দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে।

বন্ধুত্বের ব্যাকরণ

বন্ধুত্বকে জীবনে অন্যতম সহজ সম্পর্কগুলোর একটি মনে করা হলেও বড় হওয়ার সঙ্গে আমরা বুঝতে শুরু করি, এর মধ্যেও রয়েছে যথেষ্ট জটিলতা। তাই বন্ধুত্বেও নিজেকে মাত্রাছাড়া আচরণে থামিয়ে রাখাটা যেন নিজের প্রতিই নিজের কর্তব্য। বন্ধুত্বের মধ্যকার সীমানাও যাতে তথ্যের বাড়তি আদান-প্রদানের কারণে নষ্ট না হয়ে যায়, সে বিষয়ে চোখ-কান খোলা রাখা জরুরি।

সকালে-বিকালে কী খেয়েছি, কোথায় গিয়েছি এমন '২৪ ঘণ্টার আপডেট' দেওয়া বন্ধুত্বগুলো আপাতদৃষ্টিতে খুব কাছের মনে হলেও কোথাও না কোথাও তা এক ধরনের বোঝার মতো মনে হয়। ম্যাসেজের উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না, তবু দিতে হচ্ছে। কারণ আগের যোগাযোগটায় সবকিছু বলার একটা অভ্যেস আনা হয়েছিল। এ যেন আরোপিত এক দায়বদ্ধতার জন্ম।

যার ফলে যেটুকু দৃঢ় বন্ধন বন্ধুত্বে ছিল, তাও শিথিল হতে শুরু করে। অপরপক্ষে যে বন্ধুদের সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমে এত যোগাযোগ করা হয় না, মাঝেমাঝে দেখা হয়, সুন্দর আড্ডা হয়, সাধারণ খোঁজখবর নেওয়া হয়, তাদের সঙ্গে সম্পর্কটা এত ঠুনকো মনে হয় না। বন্ধুত্ব আছে মানেই সব বলতে হবে, এই চাপটা আমাদের মধ্যে সামাজিক মাধ্যম আসার আগে এত ছিল কি না, সেটিও ভেবে দেখার বিষয়। কারণ আগে 'শেয়ারিং' বা 'ওভারশেয়ারিং'য়ের এই ক্ষেত্রটাই ছিল না, তাই সম্ভাবনা বা আশঙ্কা থেকে দূরে থাকা যেত। কিন্তু এখন বন্ধুত্বের ব্যাকরণে এই সংযোজনটি বন্ধুত্বকেও অনেকাংশে বিপদের মুখে ফেলে দিয়েছে।

নিজের দুঃখ নিজের কাছেই

মানুষের জীবনে সুখ-দুঃখ পালাক্রমে আসে। এই চক্র থেকে মুক্তির উপায় এ জীবনে নেই। নিজের আনন্দ, বেদনা সবই আমরা আপনজনদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়ে একটু হালকা হতে ভালোবাসি, এতেও কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা তখন শুরু হয়, যখন সামাজিক মাধ্যমের বদৌলতে বন্ধু তালিকায় থাকা হাজারো ভার্চুয়াল বন্ধুদের সঙ্গে দিনরাত আমরা ছোটখাটো সব সমস্যা, আফসোস, দুঃখের বিষয় পোস্ট, কমেন্ট, স্টোরি ইত্যাদির মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে থাকি।

নিউজফিডে পালাক্রমে বারবার এ ধরনের বার্তা দেখে আমাদের নিয়ে মানুষের মনে একটি দুঃখী চেহারা তৈরি হয়। এই আচরণের ইংরেজিতে একটি গালভরা নামও আছে 'স্যাডফিশিং'।

এর মাধ্যমে অন্যের সহানুভূতি নেওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। এটি একইসঙ্গে নিজের জন্যও ক্ষতিকর। ২০২৩ সালে 'সোশ্যাল মিডিয়া স্যাডফিশিং' জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, যে ব্যক্তিরা এমন আচরণ করেন, তাদের মধ্যে মানসিক উদ্বেগ, বিষণ্নতার মতো মানসিক সমস্যা জন্ম নেয়।

আমাদের সবার নিউজফিডেই অন্তত এমন একজন রয়েছে, যাকে নিয়ে আমাদের মনে হয় 'ও তো সারাক্ষণ দুঃখী দুঃখী পোস্ট শেয়ার দেয়' কিংবা 'ওর ফেসবুকে এত দুঃখ!' এতে করে এমন অসংবেদনশীল বিদ্রূপের পাশাপাশি একটি বাজে প্রভাব পড়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়।

কারণ যখন দিনের পর দিন কেউ শুধু দুঃখের কথাই বলে, তখন সামনাসামনিও খুব একটা ভালো প্রতিক্রিয়া আসে না। আর এ তো পর্দার পেছনে থাকা একটি মানুষের গল্প। অন্যদের বিরক্তি তৈরি হওয়া অত্যন্ত সহজাত বিষয় হয়ে ওঠে। কারণ সামাজিক মাধ্যমে মানুষের দুঃখ দেখে সবসময় যে সত্যিকার সহানুভূতি তৈরি হবে বা সেই মানুষের জন্য কিছু করার প্রবণতা আসবে, এমন পরিমাণ কমই। শেষমেশ বাস্তবে যাদের সঙ্গে প্রকৃত সম্পর্ক বা বন্ধন রয়েছে, তারাই পাশে থাকে। সামাজিক মাধ্যম খুব একটা কাজে লাগেও না। বরং ওভারশেয়ারিংয়ের ফলে মানুষের কাছে একটি নেতিবাচক চেহারা তৈরি হয়, যার ফলে পরেও সেই প্রভাব থেকে যায়।

মাত্রাতিরিক্ত কিছুই ভালো নয়, এমনকি মনের কথা খুলে বলাও নয়। ওভারশেয়ারিংয়ের ফলে ব্যক্তিজীবনে এই সমস্যাগুলোর পাশাপাশি নিজের ও অন্যের গোপনীয়তা লঙ্ঘনের মতো ঘটনার আশঙ্কাও থেকে যায়।

 

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

4h ago