বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার—এক মানসিক অসহায়ত্বের নাম

মানব মস্তিষ্কের নিউরনের অলিতে গলিতে বাস করে নানা অজানা রহস্য। কখনো কখনো মনে হয় নক্ষত্ররাজির চাইতেও বেশি মারপ্যাঁচ এতে। কোনটা স্বাভাবিক, কোনটা নয়– তা আমাদেরকে এক অসীম আপেক্ষিকতায় ছুঁড়ে ফেলে। স্বাভাবিকতা-অস্বাভাবিকতার অনেক সংজ্ঞায়ন আছে মনোবিজ্ঞানেও। যা কিছু 'স্বাভাবিক' নয়, তাকে ফেলা হয় ডিজঅর্ডারের কাতারে। বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার মানবমনের এমনই এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি, আক্রান্ত ব্যক্তিকে যা অসহায় করে তোলে।

জগৎসংসারে অনেকেই অনেককে ছেড়ে চলে যায়। কখনো তা পরিস্থিতির স্বার্থে, কখনো নিছক ইচ্ছার কারণে। এই ছেড়ে যাওয়াটাকে অনেকেই প্রথমে কষ্ট পেয়ে তারপরে মেনে নেন, সহজ-স্বাভাবিকভাবে জীবনে এগিয়ে যান। তবে অনেকে সেটা পারেন না। তাদের মনে সবসময় ভর করে থাকে প্রিয়জনদের ছেড়ে যাবার ভয় বা 'অ্যাবান্ডনমেন্ট ইস্যু' – যা কিনা বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারের অন্যতম উপসর্গ। অসহায় অবস্থায় ডুবন্ত মানুষ নাকি খড়কুটোকেও আঁকড়ে ধরে। এ ডিজঅর্ডারে ভোগা মানুষগুলোর জন্য একথা আরও বেশি সত্যি। এ ধরনের মানুষকে আবেগ এতটাই কাবু করে রাখে যে সম্পর্কে ফাটলের ভয়ে জড়সড় হয়ে যান। এই সমস্যায় ভোগা লোকজন সবসময় কিছু না কিছু আঁকড়ে রাখতে চান। নিরাপত্তার অভাববোধ তাদেরকে স্বস্তিতে থাকতে দেয় না।

এই ডিজঅর্ডারের শিকার মানুষগুলো প্রায়ই 'সেলফ ইমেজ' সমস্যাতেও ভোগেন। যতই যোগ্যতা, প্রতিভা ও দক্ষতা থাকুক না কেন, সময়ে সময়ে তাদের নিজের অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ অর্থহীন মনে হয়। অনুভূতির সঙ্গে লড়াই করে জীবন চালিয়ে নেওয়া দুঃসহ হয়ে দাঁড়ায়। অস্তিত্ব সংকট এ ডিজঅর্ডারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

মনের এসব ওঠানামার প্রভাব পড়ে জীবনে থাকা সম্পর্কগুলোর উপরও। নিজের ভেতরে থাকা নিরাপত্তার অভাববোধ অনেক সময় অন্য মানুষের ওপর প্রত্যাশা বাড়িয়ে তোলে এবং সেই মানুষটিকে নিজের ধারণামতো না মনে হলে তারা হোঁচট খান। অনেকসময় অনিয়ন্ত্রিত রাগের মধ্যে প্রকাশ ঘটে মনে চেপে রাখা অশান্তির। অনেক সময় তারা নিজেকে সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারেন না। তাদের মনে হয়, কোনোভাবেই তারা আরেকজনকে তাদের মনের অবস্থা বোঝাতে পারছেন না। এতে তৈরি হওয়া বাড়তি মানসিক চাপ তাদেরকে আরও অশান্ত করে তোলে। কারও ওপর নির্ভর না করতে পারার ফলে অনেক মানুষের সঙ্গে যুক্ত থেকেও তারা নিজেদের একা অনুভব করেন।

সাধারণত ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে এই ডিজঅর্ডার দেখা যায়। বড় হয়ে ওঠার এই বয়সটাতেই মানুষ নতুন অনেক পরিস্থিতি, অনুভূতির সম্মুখীন হন। হুট করে অনেক দায়িত্বও বেড়ে যায়। দায়িত্ব সামলাতে না পারার ভয় থেকেও বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার তৈরি হতে পারে।

বাস্তবে থেকেও অবাস্তবের সঙ্গে নিত্য বসবাস করেন এই ডিজঅর্ডারে ভোগা মানুষগুলো। চারপাশে সবকিছু থাকার পরও এক অসীম শূন্যতার অনুভূতি তাদেরকে গ্রাস করে ফেলে। শূন্যতার এ চক্র থেকে মুক্তি পাবার জন্য মন আকুপাকু করলেও কোনো পথের হদিস মেলে না। নিজের মনের গোলকধাঁধাতেই ঘুরপাক খেতে থাকেন তারা।

তবে সময়ের সঙ্গে অধিকাংশ মানুষ নিজেকে সামাল দিতে শেখে, ডিজঅর্ডারের মাত্রাও সে হিসেবে কমে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সবার ক্ষেত্রে বিষয়টি একই মাত্রা বা গতিতে তৈরি বা শেষ হয় না। তাই এসব বিষয়কে 'মনের ভুল' বা 'সময়ের সঙ্গে ঠিক হয়ে যাবে' ধরনের কথা না বলে গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত।

মানসিক স্বাস্থ্য কোনো অংশে শারীরিক সুস্থতার চেয়ে কম গুরুত্ব রাখে না। তাই নিজের বা কাছের কারো মধ্যে এই উপসর্গগুলো নজরে পড়লে, বিশেষত তা যদি মাত্রায় অনেক বেশি হয়– তাহলে অবশ্যই মনোরোগ চিকিৎসকের শরণপন্ন হওয়া উচিত। বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজঅর্ডারের চূড়ান্ত মাত্রায় অনেকে মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে নিজের ক্ষতি করতেও পিছপা হন না। অনেকের মধ্যে আত্মঘাতী প্রবণতা থাকে– এ নিয়েও সতর্ক থাকা জরুরি। নিয়মিত কাউন্সেলিং এবং থেরাপি গ্রহণ করলে এই ডিজঅর্ডারের ভয়াবহতা থেকে দূরে থাকা সম্ভব। প্রয়োজন সচেতনতা ও চেষ্টা চালিয়ে যাবার মনোভাব।

বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার নিয়ে আরও ধারণা পেতে পাঠক উইনোনা রাইডার অভিনীত 'গার্ল, ইন্টেরাপ্টেড' সিনেমাটি দেখতে পারেন।

তথ্যসূত্র–

১. https://cutt.ly/x4ziFo5.

২. https://cutt.ly/N4ziLY4

৩. https://my.clevelandclinic.org/health/diseases/9762-borderline-personality-disorder-bpd

Comments

The Daily Star  | English

Ending impunity for crimes against journalists

Though the signals are mixed we still hope that the media in Bangladesh will see a new dawn.

10h ago