হালদা ভ্যালি টি লাউঞ্জ: ঢাকায় চা প্রেমীদের স্বর্গ

হালদা ভ্যালি টি লাউঞ্জে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে ওয়েলকাম ড্রিংক পেয়ে তাদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলাম। আমার সামনেই ছিল একটি চাওয়ান, যা এশিয়ান টি বোল নামেও পরিচিত। এর ভেতরে ছিল হালকা জলপাই সবুজ রঙের চায়ের কুড়ি ও পাতা ভিজিয়ে রাখা মিশ্রণ। আর পাশেই একটি কাচের জারে ছিল কমলা ও লেবুর খোসা দেওয়া ডিটক্স ওয়াটার। পরিবেশনের এই ছোট ছোট শৈল্পিক ছোঁয়া ক্যাফের পরিবেশকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছিল।
আমি অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম ঢাকায় একটি টি লাউঞ্জ থাকলে খুব ভালো হতো। হালদা ভ্যালি একেবারে আমার কল্পনার সঙ্গে মিলে গিয়েছে। একটি টি লাউঞ্জ যেমন হওয়া দরকার হালদা ভ্যালি ঠিক সেভাবেই সাজানো হয়েছে।

হালদা ভ্যালি চা ঢাকার পাঠকদের কাছে পরিচিত নাম। তবে তাদের ক্যাফে সম্পর্কে অনেকেই জানেন না। হালদা ভ্যালি টি লাউঞ্জের ঠিকানা- ওয়াইএন সেন্টার, ৬/এ রোড ১১৩, ঢাকা। এই ক্যাফেতে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার নারায়ণহাটে অবস্থিত তাদের নিজস্ব চা বাগান থেকে সংগ্রহ করা চা পাতা ব্যবহার করা হয়। ঠিক এ কারণেই ক্যাফেটি বিশেষ পরিচয়ের দাবিদার।
প্রায় ৫০০ হেক্টর জমির উপর গড়ে ওঠা তাদের চা বাগানটি খাগড়াছড়ি ও সীতাকুণ্ডের পাহাড়ি অঞ্চলের মাঝে বিস্তৃত। তাদের চায়ের বিভিন্ন ধরন রয়েছে এবং চায়ের গুণগত মান বিশ্বের নামীদামী চা বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার সামর্থ্য রাখে। তাদের গ্রিন টির গাঢ় সবুজ চ্যাপ্টা পাতা, হোয়াইট টির সূক্ষ্ম কচি সবুজ-রুপালি পাতা, ব্ল্যাক টির পরিষ্কার বাদামী দানা অথবা বিখ্যাত ওলং টির ফুলেল সুবাস- সবকিছুই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ও তাদের কঠোর পরিশ্রমের ফল। এভাবেই এই চা-বাগান বাংলাদেশের অন্যতম সেরা চা উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে।

সম্প্রতি এই টি লাউঞ্জে পিঠা উৎসব আয়োজন করা হয়েছিল। যেখানে ছিল ভাপা পিঠা, শুঁটকি, সরিষা ও পুদিনার চাটনির সঙ্গে চিতই পিঠার বাহারি স্বাদ, গুড় আর নারকেল কোড়া ভর্তি নরম তুলতুলে পাটিসাপটা, নারকেল পুলি, খেজুরের রস, হাঁসের মাংসের সঙ্গে চালের রুটি এবং বাঙালির শীতের শেষ পাতের অবিচ্ছেদ্য মিষ্টান্ন— সুস্বাদু পায়েশ।
হালদা ভ্যালি ফুড অ্যান্ড বেভারেজের ডিরেক্টর অব অপারেশন ড. লাবিবা ইয়াসমিন বলেন, 'এটি পরীক্ষামূলকভাবে আয়োজন করা হয়েছিল এবার। আমি মূলত আমাদের বিদ্যমান মেনুতে একটু অন্যরকম বৈচিত্র্য যোগ করতে চেয়েছিলাম। পিঠা বানানোর জন্য একটি লাইভ স্টেশন রেখেছিলাম, যা ভীষণ প্রাণবন্ত আমেজ নিয়ে এসেছিল।'
অর্ডার অনুযায়ী পিঠাগুলো সরাসরি বানিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, যার ফলে স্বাদ ছিল একদম খাঁটি। পুরান ঢাকার চক থেকে চালের গুঁড়ো ও নারকেল সংগ্রহ করা হয়েছিল, তবে খেজুরের রস ও গুড় বিশেষভাবে যশোর থেকে আনা হয়েছিল। এই উৎসবের একমাত্র অসুবিধা ছিল এটি যথেষ্ট প্রচার পায়নি, যার ফলে ঢাকার বাসিন্দারা বিষয়টি সম্পর্কে খুব একটা জানতেন না।
প্রচারের দিক দিয়ে হালদা ভ্যালি এখনো অনেক পিছিয়ে থাকলেও তাদের ছুটির দিনের সকালের না্রমতার কোন তুলনা হয় না। তাদের শেফরা কনটিনেন্টাল ও মোগলাই রান্নায় বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষিত। স্যাম্পল টেস্টিং করার পর প্রয়োজন হলে লাবিবা ইয়াসমিন রেসিপিতে নিজের স্পর্শ যোগ করেন।
তিনি বলেন, 'আমাদের ব্রেকফাস্ট মেনুর পায়া একেবারে গেম চেঞ্জার। এটি আমি বাসায় যেভাবে রান্না করি, সেই একই রেসিপি। আমাদের রেজালা খাঁটি ঢাকাই শাহি রেসিপি, যেখানে আমি গ্রেট করা মাওয়া, পোস্তদানা ও কাঠবাদাম যোগ করেছি—যা আমার মায়ের কাছ থেকে শেখা। তবে আমি শেফকে টমেটো পিউরি যোগ করতে নিষেধ করেছি, কারণ এটি খাবারটিকে এক ধরনের ভারতীয় স্বাদ দেয়। এই ছোট ছোট পরিবর্তন ও ভিন্নতা আমাদের ছুটির দিনের ব্রেকফাস্টকে জনপ্রিয় করে তুলেছে।'
এই সব ঐতিহ্যবাহী দেশি খাবারের সঙ্গে রাজকীয়ভাবে চা পান করার মজাই আলাদা—শাহি, মসলা, মালাই বা মোগলাই চায়ের স্বাদে মন ভরে যায় একধরনের উষ্ণ প্রশান্তিতে। তারা শুধু নিজেদের বাগানের চা-পাতাই ব্যবহার করে। তাই প্রতিটি কাপেই মেলে তাদের প্রিয় গোল্ডেন আইব্রো ব্ল্যাক টির অনন্য স্বাদ।
তবে ড্রাগন ওয়েল গ্রিন টির সাহায্যে তৈরি মরোক্কান মিন্ট টি তাদের অন্যতম জনপ্রিয় পানীয়। তাদের এরাবিয়ান চা মেনুও বেশ জনপ্রিয়, বিশেষ করে ইজিপশিয়ান কেরকিদেহ টি, যাতে গোলাপের পাপড়ি যোগ করা হয়। তাই ব্যস্ত ও ক্লান্তিকর এই সপ্তাহের শেষে এখানে এক কাপ আরামদায়ক চা উপভোগ করতে ভুলবেন না!
অনুবাদ করেছেন সৈয়দা সুবাহ আলম
Comments