শিঙাড়ায় বাদাম পছন্দ নাকি নয়?
চায়ের আড্ডা জমজমাট করে তুলতে পিরামিড আকৃতির, তিনকোনা এই নাশতাটি বাঙালির জন্য এক অন্যরকম আবেগ। হোক তা সকালবেলা রাস্তার পাশের চায়ের দোকান কিংবা সন্ধ্যের অবকাশে পরিবারের সবার সঙ্গে চা খাওয়ার সময়। খুব সুন্দর করে মোড়ানো শিঙাড়ার ঠোঙা খুলতে গেলে একইসঙ্গে চুলায় চায়ের জল বসানো চাই, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু যখন এই নিখুঁত বুনটের খাবারটির স্বাদ জিভে গিয়ে ঠেকে, তখনই আসে মতভেদ, দল ভাগাভাগি! শিঙাড়ার ভাঁজে ভাঁজে থাকা বাদামগুলো কি আপনার অতি উৎসাহী জিভকে বিরক্ত করছে? নাকি স্বাদের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছেন আপনি?
রন্ধনশৈলীর জগতে, দ্বন্দ্ব-সংঘাতে থাকা পুরজাতীয় খাবারের মধ্যে শিঙাড়ায় বাদামের চল নিয়ে বেশ ঝুটঝামেলা দেখা যায়। কারো কারো জন্য মিষ্টি, কুড়মুড়ে বাদামের স্বাদ ঝাল ঝাল আলুর সঙ্গে একদম মানিয়ে যায়। এতে করে প্রতিটি কামড়েই যেন পরিতৃপ্তির জোগান মেলে। কিন্তু যারা এই বিপরীতমুখী স্বাদের অতটা ভক্ত নন, তাদের জন্য আবার এ এক অমার্জনীয় সংযুক্তি! তাদের মতে, শিঙাড়ার মতো এত সুস্বাদু খাবারে বাদামের কোনো স্থান নেই।
দশকের পর দশক ধরে জনমনে এই বিতর্ক ঝড় তুলেছে এবং বহু ভোটাভুটি আর স্বাদ পরীক্ষার পরও এ প্রশ্নের কোনো ঠিকঠাক উত্তর পাওয়া যায়নি। তাই আমরা এ বিষয়ে বেশ কিছু মানুষের কাছে জানতে চেয়েছি, যাতে করে এই প্রশ্নের জটিলতা সম্পর্কে আরও ভালো করে বোঝা যায়।
ইয়াস্তাফা আলম একজন সমসাময়িক ফুড ব্লগার। 'টিম পিনাট'র পক্ষ থেকে তিনি বলেন, 'শিঙাড়ার ঝাল ঝাল ভাবের সঙ্গে একটুখানি মেটে-মিষ্টি সুরটা ভালো খেলে যায়। আমার জন্য তো এ অনুভূতি স্বর্গীয়। ভাজা বাদামের কুড়মুড়ে স্বাদের সঙ্গে যখন শিঙাড়ার চাঙা করা পুর মিলেমিশে যায়, তখন তো প্রতি কামড়ের মধ্য দিয়ে যেন স্বাদের রোলার কোস্টার বয়ে যায়।'
খাদ্য ও পুষ্টিবিদ্যায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী রুবানা তাসনিম ভাষ্য, 'শিঙাড়া খেতে হবে চায়ের সঙ্গে এবং এর আসলে কোনো আদর্শ রেসিপি নেই। শিঙাড়া তৈরির সময় পুর হিসেবে আমি তো যা ইচ্ছা তাই দিয়ে থাকি।'
তিনি আরও বলেন, 'বাদামের নিজস্ব কিছু পুষ্টিগুণ রয়েছে। তাই আমি ফুলকপি কিংবা মটরশুঁটির মতো অন্যান্য মৌসুমি সবজির সঙ্গে বাদাম ব্যবহার করি। আর হ্যাঁ, এমন পুর খেতে আমার খুব ভালো লাগে।'
কিন্তু আজ তো বসেছে শিঙাড়া নিয়ে তর্কের সভা! তাই মুদ্রার ওপিঠে কী আছে, তাও দেখে নেওয়া যাক। বাদামবিরোধী দলের সদস্যরা বিশ্বাস করেন, বাদামের জায়গা শিঙাড়ার মধ্যে কোনোভাবেই নয়।
শিঙাড়া ভক্ত তাহসিন বিভা ঘোষণা দেন, 'এ যেন বিরিয়ানিতে এক টুকরো এলাচে কামড় পড়া। আলু, পেঁয়াজ ও অন্যান্য সুস্বাদু মশলার মধ্যে বাদাম একেবারেই বেমানান।' তার এবং তার দলের অন্যদের জন্য বাদামের মেটে স্বাদ আর কুড়মুড়ে ভাবটা শিঙাড়ার ঝাল ঝাল আমেজের সঙ্গে একেবারেই মানায় না।
অনেকের মতে, শিঙাড়ার আদি শেকড়টা গাঁথা আছে মধ্য এশিয়ায়, যেখানে শিঙাড়ার পুরগুলো সাধারণত খুব সাধারণ কিন্তু সুস্বাদু হয়।
সাদিক বলেন, 'শিঙাড়ার মধ্যে সবটাই ভারসাম্যের বিষয় এবং এতে বাদাম দিলে ভারসাম্য একেবারেই বিগড়ে যায়।'
স্বাদের সংবেদনশীলতা নিয়েও তিনি বাদামের বিপক্ষে, 'শিঙাড়া খেতে গিয়ে দাঁতের মধ্যে এক টুকরো ভাজা বাদাম বেমানান। দুই ধরনের খাবারের মধ্যে ঝামেলা হয় এবং স্বাদও ভালো হয় না।'
এখন আসা যাক কিছু আদর্শবাদীর কাছে, যারা মনে করেন এই বাদাম বিতর্কের মধ্যে এত দলাদলির কিছু নেই!
স্বঘোষিত খাদ্য বিশারদ আহনাফ জারিফ প্রশ্ন তোলেন, 'যার যা ভালো লাগে, তা খেতে সমস্যা কোথায়? শিঙাড়ার মতো বহুমুখী খাবার আর হয় না। তাই মানুষজন তাদের ইচ্ছেমতো পুর ভরে দেয় এতে। ঝুরো কলিজা থেকে শুরু করে মৌসুমি সবজি, সবকিছুই যেন এতে সুন্দর করে মানিয়ে যায়। তাই এতে বাদাম যোগ করাটাও মানুষের নিজস্ব পছন্দ, শিঙাড়াকে নিজের স্বাদের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার আরেকটা উপায়।'
তাহলে কী বলা যায়? বাদামের স্থান কি শিঙাড়ার মধ্যে সত্যিই রয়েছে? এর উত্তর অবশ্য নির্ভর করে উত্তরদাতার ওপর। যে পক্ষের তর্ক-বিতর্কেই আপনি নিজেকে খুঁজে পান না কেন, শিঙাড়াপ্রেমীদের জগতে এর মধ্যে থাকা পুরগুলো নিয়ে কিন্তু অনেকেই বেশ উৎসাহী। অনেকসময় হয়তো শিঙাড়ার ভেতরের পুর কিংবা নাম নিয়ে আমরা একমত হই না। কিন্তু বাদামভক্ত হোক বা বাদামকে একেবারেই আশেপাশে ঘেঁষতে না দেওয়া কেউ হোক শিঙাড়ার প্রতি প্রেম চিরন্তন।
অনুবাদ করেছেন অনিন্দিতা চৌধুরী
Comments