চার প্রজন্ম ধরে সুবাস ছড়িয়ে যাচ্ছে বরিশালের ফকির চান বেকারি
শহরের চকবাজার মোড়ে গেলেই একটা সুন্দর গন্ধ নাকে ছুঁয়ে যাবে। এখানে একটি বড় সিনেমা হল থাকায় এক সময় এলাকাটি বিউটি সিনেমা হল লেন নামেও পরিচিত ছিল। এর পাশেই রয়েছে ১১০ বছরের পুরোনো ফকির চান বেকারি।
প্রায় চার প্রজন্ম ধরে এই বেকারির ব্যবসা চলছে। এটি বরিশালের প্রাচীনতম বেকারি। প্রায় ৮০ ফুট লম্বা, আঠারো ফুট চওড়া এই বেকারিটি ৩ দশমিক ৩ শতাংশ জমিতে অবস্থিত। এক সময় টিনের ঘর হলেও এখন তা দোতলা ভবন।
এই প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ১১০ বছর ধরে রুটি ও বিস্কুট তৈরি করে আসছে বলে জানান এর প্রধান কারিগর শাহ আলম।
তিনি জানান, তার বাবা হাসান আলী মিস্ত্রীও এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। তিনি ৮ বছর বয়স থেকে কাজ করছেন। বর্তমানে তিনি সমস্ত বেকারি আইটেম তৈরির প্রধান কুকার। তিনি জানান, পাউরুটি ছাড়াও মিষ্টি, নোনতা ও টোস্ট এই তিন ক্যাটাগরির ১৫ ধরনের বিস্কুট তৈরি হয় এখানে। এ ছাড়া ফ্রুটস, মালটোভা ও প্লেইন তিন ধরনের কেক এবং বিশেষ ধরনের চানাচুর ও পেস্ট্রি তৈরি করা হয়। ২২ ফুট লম্বা চুলার আগুনে সকাল-বিকাল এই সুস্বাদু বেকারি আইটেমগুলো তৈরি করা হয়।
শাহ আলম জানান, তার বাবাও এই বেকারিতে বিস্কুট তৈরি করতেন। তিনি তার বাবার কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের বিস্কুট আইটেম শিখেছিলেন।
শাহ আলম বলেন, যখন ফকির চাঁন বেকারি স্থাপিত হয় তখন আর কোনো বেকারি ছিল না, তখন আর্য্য বেকারি প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময় ফকির চাঁন বেকারিতে প্রচুর পরিমাণে পাউরুটি ও রুটি বিক্রি হতো। তবে বর্তমানে বিস্কুটের বিক্রি অনেক বেড়ে গেছে। আগে ২৫ কেজি বিস্কুট বিক্রি হলেও এখন তা ৬০ কেজি পর্যন্ত। একইভাবে চানাচুর যা আগে ৩০ কেজি ছিল, এখন তা ৪৫ কেজি। তবে মানুষের খাদ্যাভ্যাসের কারণে রুটি বিক্রি আগের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। আগে ৪০০ পিস রুটি বিক্রি হলেও এখন তা নেমে এসেছে দেড়শ পিসে।
ফকির চান বেকারির আসল মালিক ফকির চান একজন সুগন্ধি ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি ভাগ্যের সন্ধানে সুগন্ধি বিক্রি করতে দিল্লি থেকে ঢাকায় আসেন এবং এর মালিকের মতে ঢাকার কেরানীগঞ্জে বসবাস করতেন।
বর্তমান ফকির চাঁন বেকারির দেখাশোনা করছেন এর চতুর্থ প্রজন্ম আহমদুল্লাহ রাকিব।
তিনি বলেন, তিনি ঢাকায় থাকেন। তার সব চাচার ছেলে ঢাকার ইস্কাটনে মোটর গাড়ির খুচরা যন্ত্রাংশের ব্যবসা করেন।
তিনি নিজেই বরিশালে ব্যবসা দেখাশোনা করেন। তিনি প্রতি ১৫ দিন অন্তর ঢাকা থেকে বরিশালে আসেন এবং ব্যবসা তদারকি করেন।
রাকিব বলেন, চার প্রজন্ম আগে ফকির চান ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে বেকারি সামগ্রী সরবরাহ করতেন। সে সময় এসব কিনে সরবরাহ করতেন। পরে তারা একটি বেকারি স্থাপন করে এসব সামগ্রী সরবরাহের অনুরোধ করলে তিনি বরিশালে তিন শতাংশ জমিতে এই কারখানা স্থাপন করেন। ব্রিটিশ সরকারও তাকে এই জমি লিজ দেয়। ১৯১২ থেকে ১৯১৫ সালের মধ্যে বরিশাল শহরের দক্ষিণ চকবাজার এলাকায় এই বেকারিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পরপরই এর সুনাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
রাকিব বলেন, 'আমাদের সুনামের মূল কারণ হলো তারা পণ্য তৈরিতে এক নম্বর জিনিস ব্যবহার করেন। এমনকি তারা বিস্কুট তৈরিতেও ঘি ব্যবহার করে। এই কারণে আমাদের তৈরি বেকারি আইটেমগুলো সুস্বাদু হয়।'
বেকারি কর্মীরা জানান, এখানে যেসব বিস্কুট পাওয়া যায় তার মধ্যে রয়েছে ওভালটিন বিস্কুট, সেমাই বিস্কুট, ঢালাই বিস্কুট, কসমস বিস্কুট, বাদামি বিস্কুট, বিস্কুট, চান টোস্ট, নলি টোস্ট ইত্যাদি। একবার ওভেনে রাখলে ১০ মিনিটের মধ্যে বিস্কুট তৈরি হয়ে যাবে। তারা প্রতিদিন অন্তত ৬০ কেজি বিস্কুট তৈরি করেন। প্রতিদিনের বিস্কুট বিক্রি হয় প্রতিদিন। এ ছাড়া এই একটি চুলায় তৈরি হয় ১৫০ পিস রুটি, ৪৫ কেজি চানাচুর।
বেকারি কর্মী ইউনুস জানান, মাসিক ১১ হাজার টাকা বেতনে চার বছর ধরে এখানে কাজ করছেন। সাধারণত, রুটি এবং বিস্কুট সকালে এবং বিকেলে চুলা থেকে বের করা হয়। রাতে সাধারণত কোনো কাজ থাকে না।
কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, ১১০ বছরের পুরোনো কাঠের বাটিতে মালামাল রাখা হচ্ছে। চারদিকে বিস্কুট-কেক। কেউ চুলা থেকে বিস্কুট তুলছেন, কেউ টিনের বয়ামে ভরছেন, কেউ বিস্কুট কাটছেন। চারদিকে ব্যস্ততা আর বিস্কুটের নানা রকমের গন্ধ।
শাহ আলম নামে এক পুরোনো বেকারি প্রস্তুতকারক বলেন, 'কিছু বিস্কুটে ওভালটাইন দেওয়া হয়। এসব কারণে আলাদা একটা সুগন্ধ ছড়ায়। তবে কিছু বিস্কুটে ফুড গ্রেড সেন্ট ব্যবহার করা হয়।'
৫০ বছর ধরে তোতা মিয়া এই প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন।
তিনি বলেন, এখানে কারখানার শ্রমিক ও দোকানের শ্রমিকসহ ১৮ জন কাজ করছেন এবং এই প্রতিষ্ঠানে কাজের জন্য কমপক্ষে ১২ ধরনের লাইসেন্সের প্রয়োজন হয়। এসব কারণে তাদের খরচ অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু তারা মান কমাতে চান না। তাদের রুটি বানানোর এক ঘণ্টার মধ্যেই সব বিক্রি হয়ে যায়। অন্যান্য পণ্য তৈরি করার পরে। এটি দ্রুততম সময়ে বিক্রি হয়, তাদের আলাদা ব্রাঞ্চ নেই।
দোকানের মালিক আহমাদুল্লাহ রাকিব বলেন, 'আমাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের কোনো ইচ্ছে নেই। তাহলে পণ্যের গুণগত মান ধরে রাখতে পারব না। শুধুব্যবসা নয়, পূর্ব পুরুষের সুনাম ধরে রাখাই আমাদের প্রচেষ্টা।'
Comments