বোটক্স ও ফিলার কি ত্বকের জন্য নিরাপদ?
ত্বকের সৌন্দর্য ধরে রাখতে বোটক্স ও ফিলার শব্দ দুটি এখন বেশ শোনা যাচ্ছে। তারকাদের পাশাপাশি ত্বকের লাবণ্য ধরে রাখা নিয়ে সচেতন সাধারণ মানুষও এখন বোটক্স ও ফিলারের দিকে আগ্রহী হচ্ছেন। তবে বোটক্স ও ফিলার কতটা নিরাপদ, কীভাবে প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন হয়, কী উপকার পাওয়া যায় ও স্থায়ীত্ব কতদিন এ বিষয়গুলো নিয়ে দেশে সবাই জানেন না এখনও।
এসব নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন নর্দান ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. আসমা তাসনীম খান।
বোটক্স কী
ডা. আসমা তাসনীম বলেন, বোটক্স হচ্ছে পিইরিফাইড প্রোটিন, যা মূলত ব্যাকটেরিয়া থেকে আসে। মুখমণ্ডলে নির্দিষ্ট মাংসপেশী নির্দিষ্ট এক্সপ্রেশনের জন্য ব্যবহৃত হয়। ওই মাংসপেশীকে শিথিল করে দেওয়া হয় বোটক্সের মাধ্যমে।
কপালে ও চোখের পাশে বলিরেখা, যাদের মুখ অনেক বড় বা চওড়া থাকে তাদের মুখ চাপা করার জন্য, গলার বলিরেখা ঠিক করার জন্য সাধারণত যে উপকরণ ব্যবহার করা হয় সেটি বোটক্স। যে মাংসপেশীতে এক্সপ্রেশনের জন্য বলিরেখা হচ্ছে, ওই মাংসপেশী শিথিল করে দেওয়া হয় বোটক্সের মাধ্যমে।
ফিলার কী
ডা. আসমা তাসনীম বলেন, ফিলার হচ্ছে একটা 'সুগার ম্যাটেরিয়াল'। এটা হায়ালুরোনিক অ্যাসিড দিয়ে তৈরি হয়। বিভিন্ন ধরনের 'ফিলার ম্যাটেরিয়াল' আছে। কিন্তু বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় হায়ালুরোনিক অ্যাসিড। হায়ালুরোনিক অ্যাসিড শরীরে প্রাকৃতিকভাবেই তৈরি হয়, একটা নির্দিষ্ট সময় কমে যায় এবং বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস হতে থাকে। যার কারণে মুখমণ্ডলের বিভিন্ন জায়গায় ভলিউম কমে যায়। এর ফলে চোখের নিচে গর্ত হতে থাকে, গালের ভলিউম কমে যায়, নাকের দুই পাশে থাকা স্মাইল লাইন অনেক গভীর হয়ে যায়। এরকম পুরো মুখমণ্ডলেই অনেক ধরনের ভলিউম কমে যায় ও গর্ত হয়। এগুলো হায়ালুরোনিক অ্যাসিড ফিলার দিয়ে ঠিক করা যায়।
পাশাপাশি অনেকেই মুখমণ্ডলের আকৃতি পরিবর্তন করতে চান। যেমন- কেউ নাক শার্প করতে চান, কেউ ভি শেপ চেহারা করতে চান, চোয়ালের রেখা ঠিক করতে চান, কেউ ঠোঁট পাউট করতে চান। এরকম অনেক কাজ করা হয় ফিলারের মাধ্যমে।
বোটক্স ও ফিলার কীভাবে করতে হয়
বোটক্স এক ধরনের পাউডার উপাদান, যা পুরোপুরি সিলড কাঁচের বোতলে খুবই অল্প পরিমাণে থাকে। ত্বকে ব্যবহারের জন্য প্রথমে এটাকে ডায়ালুট করা হয় পর্যাপ্ত পরিমাণ নরমাল স্যালাইন ব্যবহার করে। যিনি বোটক্স করবেন পরীক্ষা করে দেখা হয় তার কী কী লাগবে, কোথায় লাগবে। এরপর ত্বকের যে জায়গায় বোটক্স করা হবে সে জায়গাটি ক্রিম ব্যবহার করে অবশ করে নেওয়া হয়। ইনজেকশনের মাধ্যমে বোটক্স করা হয়। এতে কোনো ব্যথা অনুভূত হয় না।
ফিলার করার সময়ও ত্বকের নির্ধারিত স্থানটি অবশ করে নেওয়া হয়। মুখটা ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিয়ে ইনজেক্ট করা হয়। ফিলারের উপাদান একটি সিলড সিরিঞ্জের মধ্যে থাকে। একটা সিরিঞ্জে ১ এমএল করে থাকে যেটা ত্বকে ব্যবহার করা হয়। আর শরীরে যেটা ব্যবহার করা হয় তাতে ১০ এমএল থাকে, ৩ এমএল থাকে, বিভিন্ন রকম থাকে।
বোটক্স ও ফিলার ত্বকের জন্য নিরাপদ কি না
বোটক্স ও ফিলার করার জন্য যে উপাদান ব্যবহার করা হয় সেটি ত্বকের জন্য নিরাপদ। কিন্তু কার হাতে কাজটি করা হচ্ছে সেটি গুরুত্বপূর্ণ। বোটক্স ও ফিলার যিনি করবেন তিনি কতটা অভিজ্ঞ, প্রশিক্ষিত কি না সেটি দেখতে হবে। বিভিন্ন বিউটি পার্লার বা স্যালনে অনেক সময় বোটক্স ও ফিলার করতে গিয়ে অনেকে ত্বকের ক্ষতি করে ফেলেন।
যে মাংসপেশী শিথিল করার জন্য বোটক্স করতে হচ্ছে সেই মাংসপেশী কোথায় শুরু হচ্ছে, কোথায় শেষ হচ্ছে, কোন জায়গাটাতে আছে সেটা একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ভালো জানবেন। চিকিৎসক ছাড়া অন্যরা করলে সমস্যা হতে পারে।
এ ছাড়া ফিলার ত্বকের কোন স্তরে দিতে হবে সেটি ঠিক করতে পারা গুরুত্বপূর্ণ। কখনো ত্বকের নিচে, কখনো ফ্যাটের মধ্যে, হাড়ের ওপর, মাংসপেশীর নিচে বিভিন্ন জায়গায় বসানোর ব্যাপার থাকে। পাশাপাশি, কোন উপাদান ব্যবহার করে কাজ করা হচ্ছে সেটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এই বিষয়গুলো যদি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়া কেউ অন্য কারো হাতে করতে যাওয়া হয় সেক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে জানান ডা. আসমা তাসনীম।
বোটক্স ও ফিলার কারা করবেন ও কতদিন স্থায়ী হয়
ডা. আসমা তাসনীম বলেন, বোটক্স ও ফিলার যে শুধু কসমেটিক্যাল কারণে করা হয় সেটি নয়, প্রয়োজন অনুযায়ী করা হয়। বয়স বাড়ার পর সবাই করতে পারবেন বোটক্স ও ফিলার। কোনো সমস্যা নেই এতে। প্রয়োজন অনুযায়ী ১৮ বা ২০ বছর বয়স থেকেও বোটক্স ও ফিলার করা যায়।
ভালো মানের প্রোডাক্ট দিয়ে যদি ফিলার করা হয় তাহলে সেটি অনেক ক্ষেত্রে দেড় থেকে দুই বছর স্থায়ী হয়। পরে ব্যক্তি চাইলে রিটাচ করে নিতে পারেন বা নতুন করেও করতে পারেন।
ফিলার বিভিন্ন টাইপের হয়। ত্বকের একেক জায়গায় একেক ধরনের ফিলার ব্যবহার করা হয়। চোখের নিচে, ঠোঁটে পাতলা ফিলার ব্যবহার করা হয়। থিন ফিলার এক থেকে দেড় বছর স্থায়ী হয়। আর থিক ফিলার দেড় থেকে দুই বছর স্থায়ী হয়।
খুব ভালো মানের বোটক্স ৫ থেকে ৬ মাস স্থায়ী হয়। আর মধ্যম মানের বোটক্স ৪ মাস স্থায়ী হয়। তারপর আবার নতুন করে করতে হবে।
বয়সের সঙ্গে প্রত্যেকটা মানুষের চেহারা ও শরীরে পরিবর্তন আসবে এটাই স্বাভাবিক। বোটক্স ও ফিলার একবার করে পরে করা বন্ধ করে দিলে ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এ ধরনের আশঙ্কা অনেকের থাকে। কিন্তু এটা হয় না কখনো।
বোটক্স ও ফিলার করার সর্তকতা
১. অবশ্যই অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে বোটক্স ও ফিলার করতে হবে। অ্যাসথেটিক ডার্মাটোলজিস্ট ছাড়াও যারা এই বিষয়ে অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত তাদের কাছে করতে হবে।
২. বোটক্স ও ফিলারে যে উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে সেটি ভালো কি না নিশ্চিত হতে হবে।
৩. বোটক্স ও ফিলার করার পর ২৪ ঘণ্টা মুখে পানি লাগানো যাবে না। মুখে চাপ দেওয়া যাবে না।
৪. জিম, সুইমিং ৭ দিন বন্ধ থাকবে।
৫. যেকোনো সমস্যা হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
পর্যাপ্ত ঘুম, পানি পান, খাওয়াদাওয়া ঠিক রাখতে হবে। ব্যায়াম করতে হবে। তাহলে এগুলো অনেকদিন স্থায়ী হয়।
বোটক্স ও ফিলারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
বোটক্সে অনেকের অ্যালার্জি থাকে। এজন্য বোটক্স করার আগে অ্যালার্জি আছে কি না সেটি দেখে নিতে হবে। ফিলারে অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া হয় না।
ডা. আসমা তাসনীম বলেন, মুখমণ্ডলের যে অ্যানাটমি অর্থাৎ কোথায় মাংসপেশী আছে, হাড় আছে, নার্ভ আছে, রক্তনালী আছে তা জানতে হবে। এগুলো না জেনে একটা মাংসপেশীতে ইনজেক্ট করতে গিয়ে অন্য মাংসপেশীতে বোটক্স কিংবা ফিলার ইনজেক্ট করে দিলে বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে।
ফিলার জেল ম্যাটারিয়াল। কোনোভাবে যদি এটি ব্লাড ভেসেলে ঢুকে যায় সেক্ষেত্রে বড় ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। তবে এ ধরনের দুর্ঘটনা খুব একটা হয় না।
Comments