‘সবার মানসিক স্বাস্থ্য ও ভালো থাকাটাই হোক বৈশ্বিক অগ্রাধিকার’

আজ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। ১৯৯২ সাল থেকে প্রতিবছর ১০ অক্টোবর দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য- 'সবার মানসিক স্বাস্থ্য ও ভালো থাকাটাই হোক বৈশ্বিক অগ্রাধিকার'।

আজ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। ১৯৯২ সাল থেকে প্রতিবছর ১০ অক্টোবর দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য- 'সবার মানসিক স্বাস্থ্য ও ভালো থাকাটাই হোক বৈশ্বিক অগ্রাধিকার'।

বর্তমানে কোভিড মহামারির প্রকোপ কমে আসলেও তা পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। মহামারিকে কেন্দ্র করে ২০২০ সালের গোড়ার দিকে তৈরি হওয়া বৈশ্বিক অচলাবস্থাসহ নানা প্রতিকূলতার কারণে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও বিষণ্নতাজনিত রোগ বেড়ে গেছে। স্বাস্থ্যব্যবস্থায় যুক্ত হয়েছে বাড়তি বোঝা।

সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে প্রতি লাখ মানুষের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা ২ জনেরও কম। উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে এই সংখ্যা ৬০ জনেরও বেশি। তবে আশার কথা হলো, বিশ্বজুড়ে গড়ে মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। পৃথিবীর স্বাস্থ্যখাতের মোট বাজেটের মাত্র ২ দশমিক ১ ভাগ ব্যয় হয় মানসিক স্বাস্থ্যসেবায়। এ কারণেই এই খাতের সন্তোষজনক অগ্রগতি তেমন দেখা যায় না।

বিশ্বে শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষের বাস নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। একইভাবে যাদের মানসিক রোগ আছে, তাদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি লোক এসব দেশের বাসিন্দা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০৩০ সাল নাগাদ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে বিষণ্নতা ব্যাপক আকার নেবে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৮-২০১৯ এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক (১৮ বছরের বেশি) মানুষের মধ্যে ১৮ শতাংশের বেশি কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত এবং ১২ দশমিক ৬ শতাংশ কিশোর-কিশোরীর (৭-১৭ বয়সী) মধ্যে মানসিক রোগ শনাক্ত করা গেছে।

দেশে নারীদের মধ্যে প্রতি ৫ জনে ১ জন মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। মানসিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আসছেন না ৯১ শতাংশের বেশি মানুষ। অন্যদিকে পুরুষদের মধ্যে মানসিক রোগ নিয়ে বেশি সংস্কার ও নেতিবাচক ধারণা দেখা যায়। এমনকি সমস্যাগ্রস্ত কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য সেবার আওতায় আসার হার ২ শতাংশেরও কম।

মানসিক স্বাস্থ্যে স্টিগমা বা প্রচলিত কুসংস্কার হলো সমাজের অগ্রহণযোগ্যতা বা মানসিক সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির প্রতি পরিবার ও সমাজের হেয় মনোভাব। সমস্যার সমাধান বা সহযোগিতার পরিবর্তে আক্রান্ত ব্যক্তি যে বিপরীত আচরণ পাচ্ছেন, তা বৈষম্য তৈরির প্রাথমিক কারণ। তবে গবেষণার তথ্য বলছে, চিকিৎসার আওতায় আসা দেশের বেশিরভাগ অর্থাৎ ৭২ শতাংশের বেশি মানুষ তাদের আত্মীয়-স্বজনের পরামর্শে এই সেবার শরণাপন্ন হচ্ছেন।

মূলত স্টিগমা ভাঙতে পরিবার, প্রতিবেশী ও আশেপাশের মানুষের সঙ্গে নিজেদের কাজ করে যেতে হবে। নিজের যে কোনো মানসিক রোগ বা সমস্যায় দ্রুত পরামর্শ নেয়াই ব্যক্তির আত্মবিশ্বাসের পরিচয় দেয়। সমস্যার সমাধানে পরামর্শ নিয়ে যত দ্রুত কাজ শুরু করা যাবে, স্বাভাবিক জীবনযাপন তত বেশি সহজ ও সরল হতে থাকবে।

মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাপারটি আমাদের কাছে পরিষ্কার হওয়াটা বাঞ্ছনীয়। যেমন- আমরা প্রতিদিন দাঁত ব্রাশ করি; দাঁতে কোনো সমস্যা না থাকলেও। কারণ আমরা জানি, ব্রাশ না করলে মুখের ভেতরে গুরুতর সমস্যা দেখা দিতে পারে। কাজটি নিয়মিত করি, কারণ এ ব্যাপারে আমি ও আমরা সচেতন। তেমনি রূপচর্চা থেকে শুরু করে সময়মতো খাওয়া কিংবা ঘুমের মতো প্রতিটি কাজে আমাদের একটা রুটিন থাকে, যা আমরা মেনে চলার চেষ্টা করি। আমরা সচেতন বলেই কাজটি নিয়মিত হয়ে থাকে। ঠিক তেমনি মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতনতাই আমাদের সুস্থ ও সুন্দর মনের অধিকারী করতে পারে।

মানসিক স্বাস্থ্য বলতে আমরা আমাদের ভাল মানসিক অবস্থা, আবেগ-অনুভূতি, চিন্তা-ভাবনা, সমস্যা সমাধান বা মোকাবিলার সক্ষমতা, সামাজিক সম্পর্ক ও জীবন সম্পর্কে আমাদের বোধগম্যতাকে বুঝিয়ে থাকি। আর মানসিক রোগ বা সমস্যা বলতে বোঝায়, ব্যক্তির মনের এমন সংকটাপন্ন অবস্থা, যা তার চিন্তা, অনুভূতি, আচরণ ও পারস্পারিক সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

আসলে স্বাস্থ্য এমন কোন বিষয় নয় যে, ইচ্ছেমত একে ভালো-মন্দে পরিণত করা যায়। কেউ হয়তো সারাজীবন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী থাকেন, কেউ হয়তো দুর্বলই থাকেন। কিংবা কারও কারও ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় থাকে। অনেক বড় রোগ থেকেও ব্যক্তি তাড়াতাড়ি সেরে উঠতে পারেন। কেউ হয়তো দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক সমস্যায় পড়েন। অনেকেই হয়তো মাঝামাঝি অবস্থায় থাকেন, কালেভদ্রে অসুখে পড়েন। মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও তেমনটি হয়ে থাকে।

জীবনের পরিক্রমায় আমরা অনেক সমস্যার সম্মুখীন হই। জীবনের বেশিরভাগ বিষয় ইতিবাচক থাকলে আমরা আমাদের ভাল মানসিক অবস্থা উপভোগ করি। প্রিয়জনের বিয়োগ, আর্থিক বা সম্পর্কের টানাপোড়েনের মতো বিষয়গুলো আমাদের কিছুটা ঝাঁকুনি দেয়; যা আমরা অভিজ্ঞতা বা দক্ষতা দিয়ে মোকাবিলা করি। তবে কখনও কখনও জীবন সংগ্রামের এমন একটা পর্যায়ে আমরা পৌঁছে যাই, সেখানে কোন কূলকিনারা দেখতে পাওয়া যায় না। এমন মানসিক দুর্দশা থেকে আমাদের বেরুতে হলে ধরতে হবে অভিজ্ঞ হাত। সে সময়ের প্রচেষ্টা আমাদের মানসিক রোগগ্রস্ত হওয়া থেকে পরিত্রাণ দেয়। মানসিক রোগে আক্রান্ত মানুষও যথাযথ পরিচর্যার মাধ্যমে ভাল মানসিক অবস্থা উপভোগ করতে সক্ষম হন।

অনেকে মানসিকভাবে খারাপ বোধ করতে পারেন, যা গুরুতর মানসিক সমস্যা নয়। অনেকে দুর্বল মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারী, কিন্তু তা মানসিক রোগ নয়। মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো সমস্যা বুঝতে পারা এবং সচেতনতার সঙ্গে তা মোকাবিলা করা। সুন্দর মানসিক স্বাস্থ্য মানেই শতভাগ আত্মবিশ্বাসী থাকা বা পুরোপুরি সুখী থাকা এমন নয়। বরং জীবনের নানা প্রতিকূলতা স্বত্ত্বেও তা মানিয়ে চলার সক্ষমতার আরেক নাম সুন্দর মানসিক স্বাস্থ্য।

দেশের বিপুল জনগোষ্ঠী মানসিক স্বাস্থ্যসেবার বাইরে থাকার কারণে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিকভাবে স্টিগমা দূরীকরণে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। স্টিগমা দূর করতে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে পারি। দেশের সকল নাগরিকের মানসিক স্বাস্থ্য ও ভালো থাকা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ইতিবাচক কৌশল যুক্ত করতে পারি। এক্ষেত্রে উদ্যোগ নিতে হবে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে।

ব্যক্তিগত উদ্যোগ

আমাদের একেকজনের পেশা একেক ধরনের। নিজেকে ভালো রাখার পন্থাগুলো জেনে সে অনুযায়ী অনুশীলনের মাধ্যমে আমি সমৃদ্ধ জীবন-যাপন করতে পারি। আমরা প্রতিদিনের রুটিনে কিছু সুনির্দিষ্ট কাজ যোগ করতে পারি, যা আমাদের সুস্থতা দেবে। যেমন: হাঁটা, রিলাক্সেশন, শখের কাজ, বেড়াতে যাওয়া, মজার কথা বলা ও শোনা, কৃতজ্ঞ থাকা, অন্যকে সাহায্য করা, নতুন কিছু জানা, নতুন কিছু পাওয়ার চেষ্টা করা, নিজ সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হওয়া, ইতিবাচক চিন্তার চর্চা ইত্যাদি।

পারিবারিক ও সামাজিক উদ্যোগ

কয়েক মাস পরপর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মশালা বা প্রচারণা চালানো যেতে পারে। পাড়া-মহল্লায় ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট এবং ওয়েলবিয়িং ভলান্টিয়ার কার্যক্রম চালু করা যেতে পারে। পারিবারিকভাবে প্রতি মাসে অন্তত একবার মানসিক স্বাস্থ্য ফোরামের আয়োজন করা যেতে পারে।

রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ

বিভিন্ন অফিসে বাধ্যতামূলক মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক ছুটি প্রদান, কর্মশালা আয়োজন, ওয়েলবিয়িং ম্যানেজার বা ভলান্টিয়ার থাকা, মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী তৈরিতে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও সুপারভিশন প্রদান, বার্ন আউট ম্যানেজমেন্টে কর্মীদের উৎসাহ প্রদান, স্কুল-কলেজে নিয়মিত সচেতনতা বিষয়ক কর্মশালা চালু, মানসিক স্বাস্থ্যখাতে পর্যাপ্ত বাজেট প্রদান ইত্যাদি।

এছাড়া দেশের আনাচে-কানাচে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা পৌঁছে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ইতিবাচক ব্যবহারে আরও সচেতন হতে হবে। এভাবে নিয়মিত ভার্চুয়াল ও সরাসরি কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে সুন্দর আগামী গড়তে সক্ষম হবো।

লেখক: ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, লাইফস্প্রিং

Comments

The Daily Star  | English

Houses for homeless: A project destined to fall into ruin

At least a dozen homes built for the homeless and landless on a river island in Bogura’s Sariakandi upazila have been devoured by the Jamuna while dozens of others are under threat of being lost.

5h ago