শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যকে অবহেলা নয়

শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন
ছবি: ইউনিসেফ

বছর তিনেক আগে রাজধানীর নামকরা একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত সুমাইয়া (ছদ্মনাম)। প্রতি ক্লাসে ভালো ফল করায় মেধাবী হিসেবে সুনাম ছিল তার। তবে করোনাকালে জেএসসি পরীক্ষা বাতিল হলে ভেঙে পড়ে সে। ভেবেছিল এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল করবে। কিন্তু গত বছর অনুষ্ঠিত সেই পরীক্ষার ফল আশানুরূপ না পাওয়ায় পরিবারের সদস্যদের কটুক্তিতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে সে। 

সুমাইয়া সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলে, 'পরিবারের সবার আশা ছিল আমি পরীক্ষায় ভালো ফল করব। কিন্তু এসএসসিতে এ প্লাস না পাওয়ায় বাবা-মা  আমাকে এমনভাবে কথা শুনিয়েছে যে এরপর আমি ভালোভাবে কারো সঙ্গে কথাও বলতে পারতাম না।'

সুমাইয়ার বাবা-মা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।

গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের করা একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ৮ মাসে ৩৬১ জন শিক্ষার্থী নানা কারণে আত্মহত্যা করেছে। এর অন্যতম কারণ ছিল একাডেমিক চাপ। সমীক্ষায় দেখা যায়, আত্মহত্যাকারী শিশুদের মধ্যে স্কুলগামী শিক্ষার্থীর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি, যা মোট সংখ্যার ৪৬.৮ শতাংশ। সমীক্ষায় একাডেমিক চাপ ছাড়াও বেশ কয়েকটি কারণকে দায়ী করা হয়। যেমন- পারিবারিক সমস্যা, প্রেমঘটিত কারণ, পারিবারিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, মানসিক অস্থিতিশীলতা প্রভৃতি।

২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত আঁচল ফাউন্ডেশনের পৃথক আরেকটি সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, ২০২২ সালে স্কুল ও সমমান পর্যায়ে ৩৪০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। বয়স অনুসারে যারা সবাই শিশু।

২০২২ সালের জানুয়ারিতে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) প্রকাশিত 'বাংলাদেশ শিশু পরিস্থিতি ২০২১' এ বলা হয়, ২০২১ সালে দেশে ৭৮ জন শিশু আত্মহত্যা করেছিল। ২০২২ এবং ২০২১ সালের করা পৃথক দুটি সংস্থার জরিপের তথ্যানুযায়ী দেখা যায়, এক বছরের ব্যবধানে দেশে স্কুলগামী শিশুদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে চারগুণেরও বেশি।

কেন এই বয়সী শিশুদের মধ্যে এ সমস্যা দেখা দিচ্ছে জানতে চাইলে শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দীন আহমদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই বয়সটি ভীষণ স্পর্শকাতর। এই বয়সে শিশুরা বেশি আবেগপ্রবণ হয়। যেকোনো চাপই তাদের মানসিক বিকাশকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।'

তিনি বলেন, 'কেবল একাডেমিক চাপই নয়, শিশুদের জন্য যেকোনো চাপ তাদের মানসিক বিকাশকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে, যা শিশুর ব্যক্তিত্বের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। শিশুদের বিষণ্ণতাসহ নানা ধরনের মনস্তাত্মিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে। পড়াশোনা বা কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে যদি শিশুর ওপর অতিরিক্ত চাপ বা বলপ্রয়োগ করা হয় তবে তা শিশুর মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করে। যার ফলে শিশুর মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠে না। তখন শিশু উদ্বিগ্ন মানুষে পরিণত হয়।'

রাজধানীর ধানমন্ডির একটি স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে সন্দ্বীপ (ছদ্মনাম)। বছর দুয়েক আগে পারিবারিক টানাপোড়েনের এক পর্যায়ে তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়। পরে বাবা-মা দুজনই বিয়ে করে আলাদা সংসার শুরু করলেও কোথাও ঠাঁই হয়নি সন্দ্বীপের। ফলে সে নানা-নানির কাছেই থাকছে।

সন্দ্বীপের নানি বলেন, 'আগে সে বেশ প্রাণচঞ্চল ছিল। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরেই হুট করে রেগে যায়। একা একা থাকতে পছন্দ করে। কিছুতেই কারো কথা শুনতে চায় না। আগের চেয়ে অনেক বেশি একরোখাও হয়ে গেছে।'

ডা. হেলাল উদ্দীন আহমদ বলেন, 'ব্রোকেন ফ্যামিলি তথা ভেঙে যাওয়া পরিবারের শিশুরা প্রধানত বিষণ্ণতাসহ নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়। এক্ষেত্রে বাবা-মাকে সন্তানের কথা মাথায় রেখে পরিপূর্ণ যত্নবান হয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে। বিচ্ছেদ কেবল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হয়, সন্তানের ক্ষেত্রে নয়। তাই সন্তানের সুরক্ষার কথা মাথায় রাখতে হবে। অন্যথায় শিশুদের ক্ষেত্রে এটি ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।'

মানসিক স্বাস্থ্যের বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে পরবর্তী জীবনেও

১৮ বছর বয়সের আগে শৈশবকালীন বিরূপ অভিজ্ঞতা পরবর্তী জীবনে প্রাপ্তবয়স্কদের মানসিক স্বাস্থ্যেও প্রভাব ফেলে বলে জানাচ্ছে একটি গবেষণা। 

২০২২ সালের এপ্রিল মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগ থেকে প্রকাশিত 'The impacts of benevolent and adverse childhood experiences on adult's mental health: A cross sectional study.' শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়, প্রতিকূল শৈশব অভিজ্ঞতা শিশুর পরবর্তী প্রাপ্তবয়স্ক জীবনেও প্রভাব রাখে। দীর্ঘমেয়াদে যদি শৈশবকালে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নজর দেওয়া হয় তবে সেই ইতিবাচক অভিজ্ঞতাও পরে মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে।

গবেষণাটিতে আরও দেখা গেছে, যারা শৈশবে বিরূপ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে, পরে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তাদের দুর্বল মানসিক স্বাস্থ্যের (বিষণ্ণতা, দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ) সঙ্গে এর গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক পাওয়া গেছে।

গবেষণাটিতে বলা হয়, মানসিকভাবে সুস্থ রাখার জন্য শৈশবকালেই শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নের পাশাপাশি শিশুর ওপর সব ধরনের সহিংসতা বন্ধ করতে হবে এবং শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের অনুকুল পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

গবেষণার বিষয়ে জানতে চাইলে গবেষণাটির গবেষণা সহযোগী ডা. কামরুন নাহার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের সমাজে শিশুদের শারীরিক সমস্যা যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, মানসিক স্বাস্থ্য ততটা নয়। এটি শিশুর পরবর্তী জীবনে ভীষণ প্রভাব ফেলে। এক্ষেত্রে আমাদের উচিত পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা। একদিকে পারিবারিকভাবে যেমন এখানে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তেমনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্কুল-কলেজ থেকেও শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের পর্যবেক্ষণ জরুরি। এক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়ানো একান্ত প্রয়োজন।'

শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এস এম আবুল কালাম আজাদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নিয়মিত শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। বাবা-মায়ের উচিত নিয়মিত সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করা, যদি শিশুর মধ্যে বিষণ্ণতা বা উদ্বিগ্ন মনোভাব দেখা যায় তবে খোলাখুলি কথা বলা। এরপরও শিশু যদি মনস্তাত্মিক সমস্যায় ভোগে তবে  বাবা-মাকে দ্রুত মনোবিদের শরণাপন্ন হতে হবে।'

প্রয়োজন সুষ্ঠু মানসিক স্বাস্থ্যের শিক্ষা

শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে মানসিক স্বাস্থ্যের শিক্ষাও বিশেষভাবে প্রয়োজন বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আরিফা রহমান।

ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাতেও শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি দেখা উচিত। কারণ শিশুর মনোজগৎ প্রতিনিয়তই পরিবর্তিত হয়। প্রতিটি স্কুলেই শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতনতামূলক মনোভাব রাখা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে স্কুলভিত্তিক প্রশিক্ষণও হওয়া উচিত। স্কুলের শিক্ষক এবং কর্মচারীদেরও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত, যেন তারা শিশুদের সঙ্গে সবসময় সংবেদনশীল আচরণ করেন। একইসঙ্গে শিশুদেরও শেখানো উচিত, যেন প্রতিকূল পরিস্থিতি তারা কাটিয়ে উঠতে পারে।'

তিনি আরও বলেন, 'যারা স্কুলে পাঠদানের সঙ্গে সম্পৃক্ত, নিয়মিতভাবে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিও দেখা উচিত। বাবা-মাকে বুঝতে হবে, পরীক্ষার ভালো ফলাফলের চেয়ে মানসিক স্বাস্থ্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ।'

Comments

The Daily Star  | English
rohingya-migration

Persecuted by Arakan Army, Rohingyas fleeing to Bangladesh

Amid escalating violence in Myanmar’s Rakhine State, Rohingyas are trespassing into Bangladesh every day, crossing the border allegedly to escape the brutality of Myanmar’s rebel group, the Arakan Army (AA).

37m ago