সবাইকে অহেতুক অবিশ্বাস-সন্দেহের সমস্যা প্যারানইয়া, সমাধান কী

প্যারানইয়া
ছবি: সংগৃহীত

প্যারানইয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু মানসিক রোগের লক্ষণ, যেটি অনেকেই অনুধাবন করতে পারেন না। প্যারানইয়া সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকার কারণে মানসিক স্বাস্থ্য হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।

প্যারানইয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ

প্যারানইয়া কী

অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন বলেন, প্যারানইয়া সরাসরি কোনো রোগ নয়, এটি কোনো না কোনো রোগের উপসর্গ। প্যারানইয়া বা প্যারানয়েড সিম্পটম বা উপসর্গ বিশেষ করে সাইকোসিস গ্রুপের রোগগুলোতে থাকে।

সাইকোসিস একক কোনো রোগ নয়। কতগুলো রোগের সমষ্টিকে সাইকোসিস গ্রুপ বলা হয়। যেমন- সিজোফ্রেনিয়া, ডিলিউশনাল ডিজঅর্ডার, মুড ডিজঅর্ডার, প্যারানয়েড পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার ইত্যাদি। এই সাইকোসিসে প্যারানইয়া বা প্যারানয়েড ডিলিউশন থাকতে পারে। বিশেষ করে সিজোফ্রেনিয়া ও ডিলিউশনাল ডিজঅর্ডারে বেশি থাকে।

প্যারানইয়ার বৈশিষ্ট্য

১. প্যারানইয়া বা প্যারানয়েড উপসর্গের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আক্রান্তরা সবসময় অন্যকে অবিশ্বাস করেন।

২. অহেতুক সন্দেহ করেন।

৩. তিনি ভাবেন, অন্যরা তার ক্ষতি করতে চায়।

৪. অন্যেরা তার পেছনে অনুসরণ করেন, তাকে পর্যবেক্ষণ করেন, তাকে ক্যামেরা দিয়ে দেখেন, তার কথা রেকর্ড করেন।

৫. কাউকে তিনি বিশ্বাস করেন না, সন্দেহ করেন, যার ফলে কথাবার্তায় সহজেই অন্যের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হয়ে ওঠেন এবং তর্কে জড়িয়ে পড়েন।

৬. তিনি বিশ্বাস করেন সারা বিশ্ব, তার চারপাশ তার জন্য হুমকি।

৭. কোনো ধরনের সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। যে কোনো কথা বা সমালোচনা তিনি মনে করেন, তাকে ইঙ্গিত করে এবং তাকে উদ্দেশ্য করেই করা হচ্ছে।

৮. সবসময় মনে করেন, তার অনুপস্থিতি সবাই তাকে নিয়ে কথা বলেন ও সমালোচনা করেন।

৯.  সবাই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন বলে ভাবেন।

এই ধরনের বৈশিষ্ট্যগুলো মূলত সাইকোসিস গ্রুপের রোগগুলোতে থাকে। একইসঙ্গে তিনি যা বিশ্বাস করেন, ভ্রান্ত ও অমূলক যেসব সন্দেহ করেন, এটার বিপক্ষে যত প্রমাণই দেওয়া হোক না কেনো সেসব প্রমাণ তিনি গ্রহণ করবেন না। তিনি তার অবস্থানে অনঢ় থাকেন।

কেন হয়

অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন বলেন, মস্তিষ্কের কিছু নিউরোট্রান্সমিটার আছে। মস্তিষ্কে ডোপামিন জাতীয় নিউরোট্রান্সমিটারের তারতম্যের কারণে, ভারসাম্যহীনতার কারণে সাইকোসিস রোগ হয় এবং সাইকোসিস রোগের কারণে মানুষের চিন্তায় জায়গায় এই ধরনের বৈকল্য দেখা যায়।

এটি এক ধরনের থট ডিজঅর্ডার, ডিলিউশনাল থট বা ভ্রান্ত বিশ্বাস। এতে আক্রান্তরা অন্যকে অবিশ্বাস করেন, তার আন্তঃব্যক্তিক সংবেদনশীলতা নষ্ট হয়, তিনি মনে করেন অন্যরা তাকে নিয়ে সমালোচনা করছেন, তার ক্ষতি করতে চান। তিনি কোনো ধরনের সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না, তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন সবাই এই বিষয়গুলো বা ভ্রান্ত বিশ্বাসে তিনি অনঢ় থাকে।

এগুলোর জৈব-রাসায়নিক কারণ হিসেবে দেখা যায় মস্তিষ্কে ডোপামিনের ঘাটতি, ভারসাম্যহীনতার কারণে হয়।

এ ছাড়া মনোসামাজিক কিছু হাইপোথিসিস আছে যা সরাসরি কারণ নয়। যেমন- শৈশবের কোনো ট্রমা, বুলিং, শিশু নির্যাতন, আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং ছোটবেলা থেকে যদি দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপের মধ্যে কেউ থাকেন, তাহলে প্যারানইয়া বা প্যারানয়েড উপসর্গ দেখা দিতে পারে।

আরেকটি কারণেও প্যারানইয়া দেখা যায়, সেটি হচ্ছে প্যারানয়েড পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার যদি থাকে। সিজোফ্রেনিয়া, ডিলিউশনাল ডিজঅর্ডারের মতো প্যারানয়েড পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারেও এটি দেখা যায়।

চিকিৎসা

মনে রাখতে হবে, প্যারানইয়া কোনো রোগ নয়, রোগের উপসর্গ। সাইকোসিস গ্রুপের যে রোগগুলো আছে, যেমন- সিজোফ্রেনিয়া, ডিলিউশনাল ডিজঅর্ডার, মুড ডিজঅর্ডার, প্যারানয়েড পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার এই রোগগুলোর অন্যতম প্রধান উপসর্গ হচ্ছে প্যারানইয়া।

তাই চিকিৎসার জন্য আগে রোগটি শনাক্ত করতে হবে। জ্বর যেমন টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু কিংবা কোভিডের লক্ষণ, তেমনি প্যারানইয়া চার থেকে পাঁচটি সাইকোসিস রোগের লক্ষন। সুতরাং প্রথমে রোগ শনাক্ত করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হবে।

যদি সিজোফ্রেনিয়া হয় তাহলে এক ধরণের ওষুধ দিতে হবে, আবার ডিলিউশনাল ডিজঅর্ডারে আরেক ধরনের ওষুধ দিতে হবে। প্যারানয়েড পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারে ওষুধের পাশাপাশি কাউন্সিলিংয়ের গুরুত্ব অনেক বেশি।

মূলত প্যারানইয়া কোন রোগের কারণে হচ্ছে সেটি নির্ণয় করা জরুরি। সে অনুযায়ী ওষুধ ও প্রয়োজনে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে চিকিৎসা দিতে হবে রোগীকে।

প্রতিরোধ

অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন বলেন, প্যারানইয়া প্রতিরোধযোগ্য নয়, এটি এমন একটি সমস্যা যা জিনগতভাবে পূর্বনির্ধারিত থাকে। প্রতিরোধের চেয়ে চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। প্যারানইয়া সম্পর্কে সচেতনতা জরুরি। কারণ যত দ্রুত এটি শনাক্ত করা সম্ভব হবে এবং রোগীকে চিকিৎসার আওতায় আনা যাবে চিকিৎসার ফলাফলও ভালো হবে। প্যারানইয়ার যে বৈশিষ্ট্য এগুলো নিয়ে হাসাহাসি না করা, বুলিং না করা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ না করা বরং এটি যে রোগের অংশ সেই সর্ম্পকে সচেতনতা জরুরি। কারো মধ্যে প্যারানইয়ার লক্ষণ দেখা দিলে বুঝতে হবে, এটি কোনো সাইকোসিস গ্রুপের রোগের লক্ষণ হতে পারে। তাই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

 

 

Comments

The Daily Star  | English

CA likely to announce election date within 4-5 days: Mostafa Jamal

He made the remarks after a meeting between Prof Yunus and leaders of 12 political parties at the state guesthouse Jamuna

1h ago