নারকীয় জুলাইয়ের মানসিক অভিঘাত

ছবি: এমরান হোসেন/ডেইলি স্টার

জুলাই অভ্যুত্থানের নৃশংসতার চিত্রগুলো বারবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসেছে। বুক পেতে মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়া সাইদ, সাঁজোয়া যান থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় ফেলে দেওয়া ইয়ামীন, রিকশার পা-দানিতে থাকা নাফিজ, গুলিবিদ্ধ ফাইয়াজকে রিকশায় নিয়ে যাওয়া উৎকণ্ঠিত সহযোদ্ধা—এই দৃশ্যগুলো জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া বীভৎস নিষ্ঠুরতার কিছু খণ্ডচিত্র মাত্র, যেগুলো আমাদের শিউরে তুলেছে বারবার।

এ ছাড়াও নাম না জানা ভদ্রলোকের বুকে গুলি লেগে স্রোতের মতো রক্তপাত, একজন আহত ব্যক্তিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার সময় খুব কাছ থেকে সশস্ত্র বাহিনীর গুলি করার দৃশ্য, ছত্রভঙ্গ সাধারণ মানুষের মধ্যে একজনের হঠাৎ মাথায় গুলি লেগে লুটিয়ে পড়ার দৃশ্য আমাদের সামনে এসেছে। ৫ আগস্ট সকালে যাত্রাবাড়ীতে সড়ক বিভাজিকার আড়ালে গুটিসুটি হয়ে প্রাণ বাঁচাতে চাওয়া নিরস্ত্র মানুষগুলোর ওপর সশস্ত্র পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালানোর ফলে একজনের ওপর আরেকজনের মৃতদেহ পড়ে থাকার দৃশ্য ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।

ওই একই দিনে চানখারপুল এলাকায় সশস্ত্র বাহিনীর একজন আন্দোলনকারীদের দিকে নিশানা ঠিক করে গুলি চালাচ্ছেন, খুব ধীরস্থিরভাবে। পাশ থেকে তাকে গুলির ম্যাগাজিন সরবরাহ করা হচ্ছে। অপর দিকে আন্দোলনকারীদের মধ্যে একজন লুটিয়ে পড়লে তাকে এক বা দুজন সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু তারা ছত্রভঙ্গ হচ্ছেন না। এই দৃশ্যের অনুরণন শোনা গিয়েছিল তৎকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কথোপকথনে 'স্যার, একজনকে মারলে, একজনই পড়ে, বাকিরা সরে না। এটাই সবচেয়ে আতঙ্ক এবং দুশ্চিন্তার বিষয়।'

এরকম আরও অজস্র নির্মম হত্যার উদাহরণ টানা যেতে পারে। বাড়ির ছাদে খেলতে থাকা রিয়া গোপ, বাইরের গোলাগুলি থেকে নিরাপদে থাকার জন্য জানালা বন্ধ করতে যাওয়া সমীরের মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার মতো ঘটনাগুলো আমাদের ইন্দ্রিয়কে যেন অবশ করে দিচ্ছিল। নিজ দেশের নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর সশস্ত্র বাহিনীর এবং সরকার দলীয় পেটোয়া বাহিনীর অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ সাধারণ নাগকরিকদের বিপন্ন করে তুলেছিল ভীষণভাবে।

দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে আবার সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা ছাড়া আর কোনো পথ অবশিষ্ট থাকে না। তখন হয় দেয়াল ঘেঁষে অন্তিম পরিণতিকে বরণ করে নিতে হবে, অথবা সামনে এগিয়ে গিয়ে নিশ্চিত পরিণতির কথা জেনেও মরিয়াভাবে প্রতিরোধের চেষ্টা করতে হবে। আমাদের বাস্তবতা দাঁড়িয়েছিল ঠিক সেরকমই।

সেই পরিস্থিতিতে আমাদের মতো অজস্র সাধারণ, কারো সাতে পাঁচে না থাকা মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। প্রিয়জন, ভালোবাসায় ঘেরা গৃহকোণ, সব ছেড়ে রাজপথ আমাদের গন্তব্য হয়েছিল। এই পথটি কারোর জন্যই খুব সহজ ছিল না। অন্তত আমি ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি, নিজের গণ্ডিতে জ্ঞানত অন্যায়ের সঙ্গে, অসততার সঙ্গে নিজেকে না জড়ালেও, কখনো চলমান অনাচার, বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ করিনি। ঘৃণা ছিল, বিরক্তি ছিল, কিন্তু এখানে আমার মতো ছাপোষা মানুষের করণীয় কিছু আছে বলে কখনো চিন্তায় আসেনি।

সেই আমি ১৮ তারিখ রাস্তায় বের হয়ে যে দৃশ্য দেখলাম, তা আমার এই পর্যন্ত যাপন করা জীবনের বাস্তবতার ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিল। স্কুল, কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা, ওদের সঙ্গে অভিভাবকরা আছেন। মাকে ছেলে বাড়ি ফিরে যেতে বলছে, মা অনড়। এই মানুষগুলোর ওপর আক্রমণ করছে পুলিশ আর পেটোয়া বাহিনী। হাতে রামদা, বড় লাঠি, পিস্তল। টিয়ারশেল তো আছেই। অন্যদিকে নিরস্ত্র মানুষগুলোর সম্বল ইট পাটকেল, কিছু গাছের ভাঙা ডাল আর মায়ের ওড়না ছিড়ে বানানো কাপড়ের টুকরো, টিয়ারশেল থেকে বাঁচার জন্য।

টিয়ারশেলের জ্বলুনি কমাতে ধোঁয়া করতে হয়, এই প্রথম জানলাম। রাস্তার আশপাশের দোকানের মালিক, কর্মচারীরা আন্দোলনকারীদের জন্য পানি এগিয়ে দিচ্ছিলেন, কাগজ আর বাতিল জিনিসপত্র বের করে দিচ্ছিলেন পুড়িয়ে ধোঁয়া করার জন্য। আমরা ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে ছুটে বেড়াচ্ছিলাম ধানমন্ডির রাস্তা আর লালমাটিয়ার অলিগলি ধরে। আমার জীবনে এমন অভিজ্ঞতা প্রথম। ধানমন্ডি ২৭ এর মোড়ে যেতেই আমাদের বন্ধু রিন্টু ওর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে বলেছিল, 'সাবন্তী, দেখতে পাচ্ছ, কত মেয়েরা এসেছে? একটা আন্দোলন সফল বা দীর্ঘস্থায়ী হবে কি না তা মেয়েদের অংশগ্রহণ থেকে বোঝা যায়।' এই কথাটা পরে বারবার আমাকে আশা জুগিয়েছে।

পিতম ছবি তুলে চলছিল অনবরত। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কোনো সাংবাদিককে চোখে পড়েনি। প্রিন্ট মিডিয়ার অনেকে ছিলেন। ওভারব্রিজের ওপর, ভেস্ট আর হেলমেট পরে।

একটি স্কুলপড়ুয়া মেয়ে মাথায় আঘাত পেয়ে রক্ত ঝরছিল, ওকে রিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। বাসায় ফিরে এসে হতবিহ্বল লাগছিল। শল্যচিকিৎসার কাজ করেছি, পোড়া রোগীর চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। তাই আমার স্নায়ু রক্ত, আহত শরীর দেখে বিচলিত হয় না। কিন্তু সেদিনের অভিজ্ঞতাগুলো আমি সহজভাবে নিতে পারছিলাম না। বুঝতে পারছিলাম, এই সম্মুখ সমরে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখার দক্ষতা আমার নেই। কিন্তু কিছু একটা করতেই হবে। এরপর পিতম ও আমাদের কাছের আরও কয়েকজন মিলে আবার বের হলেন। তখন পিতমের দিকে গুলি চালিয়েছিল পেটোয়া বাহিনী, ভিডিও করছিল বলে। সরে যাওয়ায় গুলি গায়ে লাগেনি।

তার কিছুক্ষণের মধ্যেই ফাইয়াজের মৃত্যুর খবর এলো। এরমধ্যে পিতমরা ফিরেছে। আমি সত্যিই বুঝতে পারছিলাম না কী করা উচিত। এরপর বিবৃতি লেখা, কারফিউর মধ্যে সাংবাদিক আশরাফ কায়সার, অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান, আলোকচিত্রী শহীদুল আলমদের সঙ্গে দেখা করে বিবৃতিতে সম্মতি নেওয়া, কথা বলা। পরে প্রেসক্লাবের সামনে মা, ছেলেসহ প্রতিবাদ সমাবেশে যাওয়া।

এতকিছু বলছি, কারণ আমি খুব শান্তিপ্রিয়, ঘরকুনো মানুষ। এই কাজগুলো করার কল্পনাও আমি কোনোদিন করিনি। এরপর পর্যায়ক্রমে মিটিং, মিছিল রাজপথে স্লোগান দেওয়া, জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও পিতম যা করছে তাতে ওর পাশে থাকা এগুলো করে গেছি সম্ভাব্য পরিণতির কথা জেনেই। সব নৃসংশতা যেন আরও শক্তভাবে যা করে যাচ্ছি, সেটা করে যাওয়ার রসদ জুগিয়েছে। ভয় পাইনি তেমনটা বলব না, ভেঙে পড়িনি তেমনটাও বলব না। পুরো পরিস্থিতিটার কোনোভাবেই ব্যাখা করতে পারতাম না। শুধু জানতাম, এই অন্যায় চলতে পারে না।

ফলাফল আমাদের হাতে নেই, কিন্তু সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিবাদ করে যেতে হবে। নাহলে বেঁচে থাকা অর্থহীন। লেখার শুরুতে উল্লেখ করা ভিডিও ফুটেজ বা স্থিরচিত্রগুলো পর্যায়ক্রমে সামনে এসেছে। এত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরার মাধ্যমে আমি যেই বিষয়টিতে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি সেটি হলো, সুদীর্ঘ জুলাইয়ের বীভৎসতা আমাদের মানসিক অবস্থাকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। মানসিক চাপ, অবসাদ, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসওর্ডার এই ধরনের বিপর্যয় এর খুব সাধারণ পরিণতি।

জুলাই অভ্যুত্থানের মাঝে আমাদের একটা পোষা কুকুর মারা গেছে। ও অসুস্থ ছিল। ওর জীবনের শেষ সময়টায় যত্ন আর ভালোবাসা দেওয়াই আমাদের উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে ও বেশ সুস্থ হয়ে উঠছিল। আমাদের সঙ্গে ও ছয় মাস ছিল। ওর মৃত্যু আমাকে যতটা দুঃখ দেওয়ার কথা ছিল , তেমনটা আমি অনুভব করিনি। আমার মনে হচ্ছিল ও তো আদর যত্নে জীবনের শেষ সময়টা পার করেছে, কিন্তু আমাদের বাচ্চারা, অসংখ্য নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ বিনা অপরাধে, নির্মমভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছেন। নিজের এই ধরনের প্রতিক্রিয়া আমি আগে কখনো অনুভব করিনি। পোষা প্রাণীরা আমার ভীষণ ভালোবাসার। প্রাণের সঙ্গে প্রাণের মিথস্ক্রিয়ার যে অপার আনন্দ ওদের মাধ্যমে অনুভব করি, তা অমূল্য আমার জন্য। ওদের হারানোর বেদনা শৈশব থেকেই খুব তীব্রভাবে অনুভব করে এসেছি।

এবার সেই তীব্রতায় দুঃখ না অনুভব করে আমি শিউরে উঠেছিলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম একটা মৃত্যুকে আরেকটা মৃত্যুর সঙ্গে তুলনা করছি। আমি এভাবে ভাবতাম না, এই আমাকে আমি চিনতে পারছিলাম না। অর্থাৎ প্রতিনিয়ত নৃশংসতার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার ফলে আমার সংবেদনশীলতার মাত্রা বদলে যাচ্ছে।

মিরপুরে বুকে গুলি লেগে স্রোতের মতো রক্তের ধারা নেমে আসছিল এক ভদ্রলোকের বুক বেয়ে। তার পরিচয় আমি জানি না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ভিডিও ফুটেজ দেখার পর আমার মনে হয়েছিল, রক্ত দেখে ভয় না পাওয়া আমি বদলে গেছি। শিড়দাঁড়া বেয়ে যেন শীতল স্রোত বইছিল। ভদ্রলোক মারা গেছেন, মন্তব্য থেকে জানতে পেরেছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল আর কোনোদিন আমি রক্তপাতকে ভয় না পেয়ে আহত শরীরকে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করতে পারব না। আমার ব্যক্তিত্বের ভিত যেন নাড়িয়ে দিয়েছিল ওই দৃশ্যটা।

জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালীন দমন, পীড়ন, নৃশংসতা আমাদের মনন ও অনুভবকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে। ঘুম না হওয়া, ক্ষুধা কমে যাওয়া, অস্থিরতা, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার মতো বিষয়গুলো অনেকেরই হয়েছে এবং এগুলো মনের গভীরে যে ক্ষত, তার বাহ্যিক প্রকাশ মাত্র।

যুদ্ধ চলাকালীন এবং পরবর্তী মানসিক পরিবর্তন ও সেই বাস্তবতা অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টের মতো বইতে খুব নিপুণভাবে চিত্রিত হয়েছে। মাত্রার ভিন্নতা থাকলেও, সেরকম পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই কিন্তু আমরা গেছি । তাই মনে রাখা জরুরি যে, আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ কোনো না কোনোভাবে মানসিক আঘাতের মধ্যে দিয়ে গেছেন। এই বিষয়গুলোর সুদূরপ্রসারী প্রভাব এড়াতে হলে বিষয়গুলো নিয়ে সচেতনতা তৈরির কোনো বিকল্প নেই।

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে পেশাগতভাবে যারা কাজ করেন, তাদের এগিয়ে আসা খুব প্রয়োজন। তাদের ভূমিকা এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক স্বাস্থ্য আমাদের দেশে একটি অবহেলিত বিষয় এবং এই বিষয়ে অনেক নেতিবাচক মনোভাবও জনমনে রয়েছে। এই রক্তাক্ত অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে মানসিক স্বাস্থ্য অবহেলিত থাকলে তা দীর্ঘমেয়াদে দেশের একটা বড় জনগোষ্ঠীর জন্য ক্ষতিকর প্রভাব বয়ে আনবে।

তাই জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের পুনর্বাসনের পাশাপাশি নাগরিকদের মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্বর সাথে বিবেচনা করে সেই অনুযায়ী সহায়তা প্রদানের বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা এখন সময়ের দাবি।

 

Comments

The Daily Star  | English

What's causing the unrest among factory workers?

Kalpona Akter, labour rights activist and president of Bangladesh Garment and Industrial Workers Federation, talks to Monorom Polok of The Daily Star about the recent ready-made garments (RMG) workers’ unrest.

8h ago