নবজাতকের যত্নে কুসংস্কার, যে ভুলগুলো করবেন না

নবজাতকের যত্ন
প্রতীকী ছবি

জন্মের পর নবজাতকের মাথার চুল ফেলে দেওয়াসহ প্রচলিত অনেক ধ্যানধারণা ও কুসংস্কার আমাদের দেশে প্রচলিত, যা শিশুর ক্ষতির কারণ। অনেকেই না জেনে অন্যের কথার ওপর ভিত্তি করে কাজগুলো করেন। ঠিক কোন কাজটি করলে শিশুর সঠিক যত্ন নিশ্চিত হবে বোঝেন না তারা।

চলুন নবজাতকের যত্নে কোন কাজটি করা উচিত আর কোনটি উচিত নয় জেনে নিই বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের নবজাতক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. নিশাত জাহানের কাছ থেকে।

নবজাতকের মাথার চুল চেঁছে ফেলা যাবে না

ডা. নিশাত জানান, অনেকেই শিশুর জন্মের পর ছয় দিনে বা তার আগে পরে মাথার চুল চেঁছে ফেলে দেন। এটি করার কোনো দরকার নেই। চুল মাথা ঢেকে রাখে। ফলে চুল ফেলে দিলে বাচ্চার ঠান্ডা লেগে হাইপোথার্মিয়া হয়ে যেতে পারে। রেজার মেশিন বা ব্লেড দিয়ে নবজাতকের চুল চেঁছে ফেলার সময় দুর্ঘটনাবশত কাট ইনজুরিও হতে পারে।

এ ছাড়া মাথার সামনের অংশটায় বাচ্চাদের এক থেকে দেড় বছর পর্যন্ত একটা অংশে হাড় তৈরি হয় না। ওই জায়গাটায় শুধু ত্বক থাকে আর তার নিচেই ব্রেইন থাকে। ফলে চাপ পড়লে ওই জায়গায় ইনজুরিও হতে পারে। তবে যদি কেউ মনে করেন বাচ্চার চুল অনেক বড়, তাহলে কিছুটা ছোট করে দিতে পারবেন। বাচ্চা একটু স্থিতিশীল হলে ১০-১৫ দিন পর চুল ফেলতে পারেন।

জন্মের তিন দিন পর গোসল

জন্মের ৭২ ঘণ্টা মানে তিন দিন পর নবজাতককে গোসল করাতে হবে। প্রথম তিন দিন শিশুকে গোসল করাতে বলা হয় না। কারণ হঠাৎ করে শরীরে পানি দিলে বাচ্চা ঠান্ডা হয়ে যেতে পারে।

গোসলের সময় খেয়াল রাখতে হবে, বাচ্চার কান দিয়ে যাতে পানি ঢুকে না যায়। ঈষদুষ্ণ হালকা গরম পানিতে গোসল করাতে হবে। কোনো কারণে বাচ্চার মুখ দিয়ে যদি পানি চলে যায় তাহলে যাতে পেটের সমস্যা না হয় সেজন্য গোসলের সময় ফোটানো পানি ব্যবহার করতে হবে।

নবজাতককে কাজল দেওয়া যাবে না

ডা. নিশাত বলেন, জন্মের পর শিশুর চোখে, কপালে, ভ্রু কিংবা পায়ের পাতায় কাজল দেওয়া যাবে না। কাজলে কোনো না কোন কেমিক্যাল থাকে, সেখান থেকে ইনফেকশন হতে পারে। চোখে কাজল দেওয়ার ফলে চোখে ইনফেকশন হতে পারে। কাজলের কণা চোখের ভেতর চলে গেলে চোখ দিয়ে পানি পড়ে, চোখে ময়লা আসে।

নবজাতকের মুখে মধু দেবেন না

জন্মের পর শিশুর মুখে মধু বা মিছরির পানি কোনোটিই দেওয়া যাবে না। জন্মের পর শিশুকে অবশ্যই মায়ের বুকের শাল দুধ খাওয়াতে হবে। প্রথম ছয় মাস শিশু শুধু মায়ের বুকের দুধ খাবে। এর বাইরে বাচ্চার মুখে আর কিছু দেওয়া উচিত নয়। বাইরের কোনোকিছু দিলে পেটে ইনফেকশন হতে পারে, পরে হজমের সমস্যা হতে পারে। এমনকি ইনফেকশন রক্তে ছড়িয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া বাচ্চার মুখে চুষনি, নিপল এগুলোও দেওয়া যাবে না।

ঢেকুর তোলানো

বাচ্চাকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর পর অবশ্যই ঢেকুর তোলাতে হবে। বাচ্চাকে সোজা করে রেখে আস্তে আস্তে ঢেকুর তোলাতে হবে। তা না হলে যা খাবে তা বমি করে ফেলে দেবে।

নবজাতকের নাভির যত্ন

জন্মের পর প্রথম নাভি কাটার পর শুকানোর জন্য যে ওষুধ দেওয়া হয়, তারপর নাভিতে কোনো ধরনের সেঁক দেওয়া যাবে না, কোনো অয়েন্টমেন্ট ব্যবহার করা যাবে না। অন্য কোনোকিছু লাগালে নাভিতে ইনফেকশন হতে পারে।

নবজাতকের ত্বকের যত্ন

জন্মের পর প্রথম ২৮ দিন বা ৪ সপ্তাহ শিশুর ত্বকে অতিরিক্ত কোনোকিছু ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই বলে জানান ডা. নিশাত। যদি লোশন বা অন্যকিছু ব্যবহার করতেই হয় তাহলে বাচ্চার বয়স এক মাস হওয়ার পর।

কিছু কিছু বাচ্চার শরীর খুব শুষ্ক থাকে, খসখসে বা ফাটাফাটা থাকে। যে বাচ্চাগুলো মায়ের পেটে বেশি সময় থাকে আর মায়ের পেটে পানি কম থাকে, জন্মের পর সেই বাচ্চাগুলোর যদি খুব ফাটাফাটা ত্বক থাকে তবে খুব অল্প করে অলিভ ওয়েল ব্যবহার করতে পারেন। বাচ্চাদের ত্বক এমনিতেই অনেক নরম থাকে, কোনো প্রসাধনী ব্যবহার করার দরকার নেই।

নবজাতকের পোশাক

নবজাতকের পোশাক পরিষ্কার, জীবাণুমুক্ত ও নরম কাপড়ের হতে হবে। প্রত্যেকবার খুব ভালো করে ধুয়ে ব্যবহার করতে হবে। নতুন কাপড় ব্যবহারের আগে ধুয়ে নিতে হবে। বাচ্চার কাপড় সুতি হতে হবে, সিনথেটিক কোনোকিছু ব্যবহার করা যাবে না। সিনথেটিক কাপড়ে বাচ্চার শরীরে জ্বালা হতে পারে। ছিঁড়ে যেতে পারে বা ঝুঁকি থাকতে পারে এমন কোনো পোশাক নবজাতককে পরানো থেকে বিরত থাকতে হবে।

শীতে নবজাতকের যত্ন

ডা. নিশাত বলেন, মায়ের পেটে সন্তান একটা গরম পরিবেশে থাকে, তাই জন্মের পর বাইরের পরিবেশে খুব সহজে ঠান্ডা হয়ে যায় নবজাতক শিশু। এজন্য বাচ্চাকে সবসময় মাথায় টুপি ও পায়ে মোজা পরিয়ে রাখতে হবে। তবে অনেক বেশি কাপড় দেওয়া যাবে না বাচ্চার শরীরে। বেশি কাপড় দিলে বাচ্চা ঘেমে যাবে। এতে কাশি হতে পারে।

ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার

ডা. নিশাত বলেন, অপরিপক্ক ও কম ওজনের বাচ্চা যদি জন্মগ্রহণ করে তাহলে সেই বাচ্চার প্রতি বেশি যত্নশীল হতে হবে। কম ওজন এবং সময়ের আগে যে বাচ্চা জন্মগ্রহণ করেছে তাদের ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ারে অর্থাৎ মায়ের বুকের সঙ্গে বাচ্চাকে একদম লাগিয়ে রাখতে হবে।

কম ওজনের বাচ্চা হলে বাচ্চার ওজন আড়াই কেজি হওয়া পর্যন্ত ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার দিতে হবে। আর সময়ের আগে যদি বাচ্চার জন্ম হয়ে যায় তাহলে বাচ্চার ৪০ সপ্তাহ অর্থাৎ মায়ের পেটে থাকতে ৪০ সপ্তাহ, যদি বাচ্চার জন্ম ৩২ সপ্তাহে হয় তাহলে আরও ৮ সপ্তাহ বাচ্চাকে ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার দিতে হবে। অথবা যতদিন বাচ্চার ওজন আড়াই কেজি না হবে ততদিন পর্যন্ত এটি দিয়ে যেতে হবে।

সারাদিনে ২০ ঘণ্টার বেশি ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার নিশ্চিত করার কথা বলেন ডা. নিশাত। প্রত্যেকবার বাচ্চাকে বুকে নেওয়ার পর টানা দুই ঘণ্টা রাখতে হবে। এই বিশেষ পদ্ধতিতে শিশুর যত্নে পরিবারের সবাইকে সহযোগী হতে হবে।

 

Comments

The Daily Star  | English
consensus commission bicameral parliament proposal

Consensus commission: Talks stall over women’s seats, upper house

The National Consensus Commission proposed establishing an upper house comprising elected representatives from each district and city corporation, and suggested abolishing the current system of reserved seats for women in parliament.

5h ago