ইসরায়েলের ব্যয়বহুল যুদ্ধ: ২ বছরে নিহত ৮৯১ সেনা, আত্মহত্যা ৩৮ জনের
প্রায় দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্যে একাধিক ফ্রন্টে যুদ্ধ চালাচ্ছে ইসরায়েল। গাজা-লেবাননের পাশাপাশি সম্প্রতি ইয়েমেনের বিরুদ্ধে শুরু করা যুদ্ধ দেশটির সেনাবাহিনীর জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধে প্রতিপক্ষের গুলি-বোমায় নিহত হয়েছেন অনেক ইসরায়েলি সেনা। এছাড়া যুদ্ধের মানসিক চাপ সইতে না পেরে আত্মহননের পথও বেছে নিয়েছেন কেউ কেউ।
সম্প্রতি ইসরায়েলি প্রতিরক্ষাবাহিনী আইডিএফ এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানিয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ইসরায়েলি গণমাধ্যমগুলোতে বিষয়টি নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
আইডিএফ বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, ২০২৩ সালে ৫৫৮ ও ২০২৪ সালে ৩৬৩ জন সেনা নিহত হয়েছেন। এই দুই বছরে প্রাণ হারিয়েছেন মোট ৮৯১ সেনা।
পাশাপাশি, সেনাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও বেড়েছে। একই সময়কালে ৩৮ জন বেছে নিয়েছেন আত্মহননের পথ।
২০২৩ সালে যুদ্ধ ও সামরিক অভিযানে ৫১২, জঙ্গি হামলায় তিন, স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ১০ জন নিহত হন এবং আত্মহত্যা করেন ১৭ জন।
২০২৪ সালে যুদ্ধ ও সামরিক অভিযানে নিহত হন ২৯৫ জন, জঙ্গি হামলায় ১১ জন, স্বাস্থ্যগত সমস্যায় মারা যান ১৩ জন এবং আত্মহত্যা করেন ২১ জন।
এই দুই বছরের যুদ্ধে আহত হয়েছেন সাড়ে পাঁচ হাজার ইসরায়েলি সেনা।
আর্থিক খরচের দিক দিয়েও কোনো অংশে কম নয় এই যুদ্ধ।
গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর আগে সামরিক খাতের খরচ ছিল মাসে ১৮০ কোটি ডলার, যা দুই মাসের ব্যবধানে বেড়ে ৪৭০ কোটি হয়ে যায়। এখনো এই বিপুল পরিমাণ খরচ অব্যাহত রয়েছে। স্থবির হয়ে পড়েছে ইসরায়েলের অর্থনীতি। প্রবৃদ্ধির সব সূচক নিম্নমূখি।
বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা
অন্যান্য কারণে নিহতের সংখ্যা কমলেও বিগত বছরে ইসরায়েলি সেনাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। মূলত রিজার্ভ সেনাদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি দেখা দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০২৩ সালে আত্মহননকারী ১৭ জন সেনার মধ্যে চারজন ছিলেন কর্মকর্তা। বাকিদের মধ্যে নয়জন সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক সেবা দিচ্ছিলেন এবং নয়জন ছিলেন রিজার্ভ সেনা।
২০২৪ সালে নিহতদের মধ্যে দুই কর্মকর্তা, সাত জন বাধ্যতামূলক সেবার কাজে নিয়োজিত এবং ১২ জন রিজার্ভ সেনা ছিলেন।
২০২২ সালে ১৪ জন সেনা আত্মহত্যা করেছিলেন। তাদের মধ্যে কেউই রিজার্ভ সেনা ছিলেন না। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে নিহতদের মধ্যে নয় ও ১২ জন রিজার্ভ সেনা ছিলেন।
২০১৩, ২০১৮ ও ২০২০ সালে আত্মহননকারী সেনার সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। আত্মহত্যার সংখ্যা দুই অংকও ছোঁয়নি এই বছরগুলোতে। ২০০৫ সালে গত ২৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৬ সেনা আত্মহত্যা করেছিলেন।
অক্টোবরে সিএনএনের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গাজায় নিরীহ নারী-শিশুদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে নিজ পরিবারের কাছে ফিরে এসে আইডিএফের অনেক সেনা মানসিক অবসাদে ভুগেছেন। গাজায় নেতানিয়াহুর নির্দেশ পালন করতে গিয়ে আহত হয়ে নিজ দেশে ফিরে যাওয়া অনেক আইডিএফ সদস্য আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন।
গাজায় যুদ্ধে অংশ নেওয়া ইসরাইলি সৈন্যরা সিএনএনকে জানিয়েছেন, গাজার যে নৃশংসতা তারা দেখেছেন, তা বাইরের মানুষ কল্পনাও করতে পারবেন না।
প্রতিবেদন থেকে আরও জানা গেছে, আইডিএফের অনেক সেনা বর্তমানে মানসিক অবসাদে ভুগছেন। ফেরত আসা সৈন্যদের অনেকেই এখন মাংস খেতেও ভয় পান। মাংস খেতে গেলেই গাজায় রক্তাক্ত লাশের কথা মনে হয় তাদের। তারা রাতে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারেন না মানসিক অশান্তির কারণে।
আইডিএফের ব্যাখ্যা
এ বিষয়ে আইডিএফের ব্যাখ্যা হল, সেনাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা একটি বড় সমস্যা। যুদ্ধের কারণে রিজার্ভ সেনার সংখ্যা বেড়েছে। সে কারণে আনুপাতিক হারে বেড়েছে আত্মহত্যার সংখ্যা।
আইডিএফের দাবি, আত্মহত্যার প্রবণতা কমাতে যেসব উদ্যোগ নেওয়া দরকার, তা নেওয়া হচ্ছে। সেনাদের, বিশেষত রিজার্ভ সেনাদের মধ্যে এই প্রবণতা দূর করতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা এই যুক্তি নাকচ করেছেন। তাদের মতে, আইডিএফের এই যুক্তি ফাঁকা বুলির মতো। সেনাবাহিনীর সদস্যদের পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি) নিয়ে কীভাবে কাজ করা যায় অথবা সার্বিকভাবে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে কি করণীয়, সে বিষয়ে কোনো আলোচনায় না গিয়ে কিংবা যথোপযুক্ত যুক্তি না দিয়েই আইডিএফ দাবি করেছে 'যা করা দরকার তা করা হয়েছে'।
বেশিরভাগই গাজায় নিহত
নিহত ৮৯১ জন ইসরায়েলি সেনার মধ্যে ২০২৪ সালে ৩৯০ জন ও ২০২৩ সালে ৩২৯ জন গাজায় নিহত হন। তাদের মধ্যে ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় নিহতরাও অন্তর্ভুক্ত।
উত্তরে লেবাননে ও পশ্চিম তীরেও সেনা হারিয়েছে ইসরায়েল।
২০২৩ ও ২০২৪ সালে যথাক্রমে নয়জন ও ২০ জন সেনা সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের অতর্কিত হামলায় এক হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত ও ২৫১ জন জিম্মি হন। এই ঘটনার পর থেকে শুরু ইসরায়েলের পাল্টা হামলা নৃশংসতা, নির্মমতার নতুন নজির সৃষ্টি করেছে। ১৬ মাসের যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছ ৪৫ হাজার ৫৫০। নিহতদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। একই সময়ে পশ্চিম তীর ও লেবাননেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
ইসরায়েলের দাবি, নিহতদের অর্ধেকেরও বেশি হামাস সদস্য। তবে বাস্তবতা হল, বিপুল সংখ্যক বেসামরিক মানুষের রক্তের দাগ ইসরায়েলি সেনা সদস্যদের হাতে, তাদের রাইফেলের নলে। এটাই আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ার একটি বড় কারণ বলে ভাষ্য বিশ্লেষকদের।
পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য মিত্রদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও সামরিক সহযোগিতা পেয়েও নিহত সেনার সংখ্যা প্রায় ৯০০ তে পৌঁছে যাওয়ার বিষয়টি আইডিএফের সদস্যদের মনে তীব্র চাপ সৃষ্টি করেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সব মিলিয়ে ভালো নেই এখন ইসরায়েলি সেনারা।
Comments