আসলেই কি পাখির আঘাতে হয়েছে কোরিয়ার উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা?
দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার পর জরুরি নিরাপত্তা তদন্ত শুরু করেছে সিউল। রোববারের এ দুর্ঘটনায় উড়োজাহাজের ১৮১ আরোহীর মধ্যে ১৭৯ জনই নিহত হয়েছেন।
উড়োজাহাজটি অবতরণের আগে আগে, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল থেকে পাখির আঘাতের সতর্কতা জারি করা হয়। যা উড়োজাহাজের সঙ্গে পাখির সংঘর্ষের ঝুঁকি নির্দেশ করে।
তদন্তে দেখা হবে, পাখির আঘাতই এ দুর্ঘটনা হয়েছে কী না। নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ ছিল।
পাখির আঘাত বলতে কি বোঝানো হয়
মাঝে মাঝে উড়োজাহাজের জেট ইঞ্জিনে পাখি ঢুকে যায়। তখন ইঞ্জিন শক্তি হারিয়ে অকেজো হয়ে যেতে পারে।
তবে উড়োজাহাজে পাখির আঘাত বেশ সাধারণ ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৩ সালেই উড়োজাহাজে ১৯ হাজার ৬০০টি বন্যপ্রাণীর আঘাতের ঘটনা রিপোর্ট করা হয়, যার বেশিরভাগই ছিল পাখির আঘাত।
যুক্তরাজ্যে ২০২২ সালে এক হাজার ৪০০টিরও বেশি পাখির আঘাতের ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে মাত্র ১০০টির প্রভাব ফ্লাইটে পড়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষ।
পাখির আঘাত কতটা বিপজ্জনক?
সাধারণত পাখির আঘাতে উড়োজাহাজে বড় ধরনের দুর্ঘটনা হয় না। হতাহতের বিষয়টিও অস্বাভাবিক।
ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলে পাইলটরা সাধারণত এই সমস্যার সমাধান করতে এবং জরুরি অবতরণের জন্য হাতে যথেষ্ঠ সময় পান।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডগ ড্রুরি এক নিবন্ধে বলেন, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় পাইলটরা এ ব্যাপারে বেশি সতর্ক থাকেন। কারণ তখন পাখিরা বেশি সক্রিয় থাকে।
তবে পাখির আঘাতজনিত কারণে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা একেবারেই ঘটে না, বিষয়টি সেরকমও নয়।
১৯৮৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বন্যপ্রাণীর সঙ্গে উড়োজাহাজের সংঘর্ষে প্রায় ৭৬ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। বলাই বাহুল্য, বন্যপ্রাণী
১৯৯৫ সালে আলাস্কার বিমানঘাঁটির কাছে একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা হয়, যাতে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর মোট ২৪ জন সদস্য প্রাণ হারায়।
২০০৯ সালে এরকম এক দুর্ঘটনার পর ১৫৫ আরোহী নিয়ে নিউইয়র্কের হাডসন নদীতে জরুরি অবতরণ করতে সক্ষম হয় একটি যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ। যা 'হাডসন মিরাকল' হিসেবে পরিচিত।
দক্ষিণ কোরিয়ার দুর্ঘটনাটি কি পাখির আঘাতেই হয়েছে?
পাখির সঙ্গে সংঘর্ষের বিষয়টি এখনো নিশ্চিত করেনি দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মকর্তারা।
তবে স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে জানানো হয়েছে, ফ্লাইটে থাকা একজন যাত্রী তার পরিবারকে টেক্সট বার্তায় জানিয়েছিল একটি পাখি 'ডানায় আটকে আছে', যে কারণে বিমানটি অবতরণ করতে পারছে না।
দুর্ঘটনাস্থল মুয়ানের অগ্নিনির্বাপণ অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছে, পাখির আঘাত ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটতে পারে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ক্রিস কিংসউড জানান, ভিডিও ফুটেজ দেখে স্পষ্টভাবে দুর্ঘটনার কারণ বোঝা যায় না।
তবে তিনি উল্লেখ করেন, অবতরণের সময় উড়োজাহাজটির ল্যান্ডিং গিয়ার (অবতরণে ব্যবহৃত চাকা) বের হয়নি। আর জাহাজের ডানার সঙ্গে থাকা ফ্ল্যাপটিও ঠিকভাবে ব্যবহার করছিল না।
'যার মানে ঘটনাটি আসলেই বেশ দ্রুত ঘটেছে,' বলেন কিংসউড।
বিবিসিকে তিনি আরও বলেন, 'যখন আপনার দুটি ইঞ্জিনই বিকল হয়ে যাবে, তখন এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে। একটি সচল ইঞ্জিন নিয়ে একটি বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ বেশ নিরাপদে উড়তে পারে।'
যদি অল্প উচ্চতায় পাখির আঘাতে দুটি ইঞ্জিনই বিকল হয়ে যায়, তখন পাইলটদের 'বেশ স্বল্প সময়ের ব্যবধানে অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নিতে হয়,' জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেলে ল্যান্ডিং গিয়ার ও ফ্ল্যাপ পরিচালনার বিকল্প ব্যবস্থা থাকে।
'যদি উড়োজাহাজটি তুলনামূলক কম উচ্চতা, কয়েক হাজার ফুটের মধ্যে থাকে, তবে পাইলটদের অবশ্যই এটি উড়ানো এবং নিরাপদে কোথাও নামানোর দিকে মনোযোগ দিতে হয়,' যোগ করেন কিংসউড।
কেবল পাখির আঘাতে এই দুর্ঘটনা ঘটা সম্ভব কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
এয়ারলাইন নিউজের সম্পাদক জেফরি টমাস রয়টার্সকে বলেন, 'একটি পাখির আঘাত অস্বাভাবিক কিছু না। ল্যান্ডিং গিয়ার না নামাও অস্বাভাবিক না।'
'পাখির আঘাতের ঘটনা ঘন ঘনই দেখা যায়। তবে কেবল এই আঘাতেই দুর্ঘটনা সাধারণত ঘটে না,' তিনি যোগ করেন।
অস্ট্রেলিয়ার উড়োজাহাজ নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ জিওফ্রে ডেল রয়টার্সকে বলেন, 'পাখির আঘাতে ল্যান্ডিং গিয়ার বের করা সম্ভব হয়নি, এটা আমি কখনো দেখিনি।'
তিনি দাবি করেন, একবারে এক ঝাঁক পাখি ঢুকে গেলে ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ার কথা না। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সময় পাওয়ার কথা পাইলটদের।
Comments