বাইডেনের সম্ভাব্য বিকল্প: কমলা হ্যারিস থেকে মিশেল ওবামা
২০২৪ সালের নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও সাবেক রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রথম প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেটে জো বাইডেনের ভরাডুবিতে বিচলিত হয়ে পড়েছে তার দল। বাইডেনের বদলে নতুন প্রার্থী মনোনয়নের সম্ভাবনা নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা কল্পনা।
বাইডেনের সম্ভাব্য বিকল্পদের নিয়ে বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
২০২৪ সালের বেশিরভাগ সময়জুড়ে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি সমর্থকদের বাইডেনের বয়স ও মানসিক দৃঢ়তা নিয়ে অন্যদের উদ্বেগ দূর করার কাজে ব্যস্ত থেকেছে। দলের একনিষ্ঠ ভক্তরা এ বিষয়গুলোকে 'গণমাধ্যমের তৈরি' সমস্যা হিসেবে অভিহিত করে এসেছে এতদিন।
কেন এসেছে নতুন প্রার্থীর আলোচনা
বৃহস্পতিবার রাতে ট্রাম্পের সঙ্গে ডিবেটে বাইডেনের অসংলগ্ন, খাপছাড়া বক্তব্য এবং সব মিলিয়ে দুর্বল পারফরম্যান্সের পর নড়েচড়ে বসেছে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। ডিবেটের পর বিভিন্ন জরিপ ও বিশ্লেষকদের মত থেকে উঠে এসেছে, এই ডিবেটে নিশ্চিতভাবে জয়ী হয়েছেন ট্রাম্প এবং বাইডেনের সব ধরনের দুর্বলতা এতে উন্মোচিত হয়ে পড়েছে।
যার ফলে বিভিন্ন মহল থেকে বাইডেনের বদলে নতুন প্রার্থী দেওয়ার দাবি এসেছে। এমন কী ,তার প্রতি যারা অনুগত, তারাও এ ধরনের দাবি তুলেছেন।
নির্বাচনী প্রক্রিয়ার এ পর্যায়ে এসে নতুন প্রার্থী মনোনয়ন বেশ জটিল হয়ে পড়বে। বাইডেন স্বেচ্ছায় সরে না দাঁড়ালে এর বাস্তবায়ন মোটামুটি অসম্ভব বললেও কম বলা হয়। তবে বিশেষ কারণে দলীয় ককাসে জয়লাভের পরও প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর নির্বাচনী দৌড় থেকে সরে দাঁড়ানোর নজির রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে।
তবে যদি তার বিকল্প হিসেবে অন্য কোনো ডেমোক্র্যাটকে সামনে নিয়ে আসতে হয়, সে ক্ষেত্রে সম্ভাব্য ১০ প্রার্থীর একটি তালিকা তৈরি করেছে ওয়াশিংটন পোস্ট।
১। ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস
সবচেয়ে প্রথম যে নামটি সবার মাথায় আসবে, তা হলো বাইডেনের সহযাত্রী ও বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস।
তবে এ ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো, বাইডেনের মতো কমলার জনপ্রিয়তাও নিম্নমুখী। সাম্প্রতিক কিছু জরিপে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। এ ছাড়া, ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারিতে লড়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলেও পরে তহবিলের অভাবে তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন।
বেশিরভাগ ডেমোক্র্যাট সমর্থক মনে করেন, কমলা বাইডেনের চেয়ে খুব ভালো কোনো প্রার্থী হতে পারবেন না। মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাছে বাইডেনের অজনপ্রিয়তার ধারা কমলার ক্ষেত্রেও অব্যাহত থাকবে বলে বিশ্লেষকদের মত।
২। গ্রেচেন হুইটমার
মিশিগানের গভর্নর হুইটমারকে 'কাগজেকলমে' একজন আদর্শ প্রার্থী হিসেবে উল্লেখ করেছে ওয়াশিংটন পোস্ট।
তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরাজ্য থেকে উঠে আসা নারী গভর্নর। জরিপের ফল অনুযায়ী মিশিগান অঙ্গরাজ্যের ৫৪ থেকে ৬১ শতাংশ ডেমোক্র্যাট ভোটার তাকে পছন্দ করেন। অন্যান্য সমসাময়িক ও শীর্ষ ডেমোক্র্যাট গভর্নরদের তুলনায় তার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাও বেশি।
সব মিলিয়ে, সম্ভাব্য প্রার্থীর দৌড়ে কমলার পরের নামটিই তার।
৩। পিট বুটিজেজ
২০২০ সালে আইওয়া ও নিউ হ্যাম্পশায়ারের প্রাইমারি ককাসে বেশ ভালো ফল করেছিলেন মার্কিন পরিবহনমন্ত্রী পিট বুটিজেজ। অল্পের জন্য জিততে না পারলেও শীর্ষ নেতাদের নজর কাড়েন তিনি। সে সময় তিনি ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের ছোট শহর সাউথ বেন্ডের মেয়র ছিলেন।
ট্রাম্পের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বক্তব্যের ঝড় তোলার জন্য তিনি বেশ ভালো একজন বিকল্প হতে পারেন। ফক্স নিউজের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ও কংগ্রেসের শুনানিতে রিপাবলিকানদের সঙ্গে বিতর্কে তিনি বেশ সাবলীল ছিলেন। জনগণের প্রয়োজনীয় বার্তা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি বেশ দক্ষ—মত দিয়েছেন দলের অন্যান্যরা।
পিটের একমাত্র সীমাবদ্ধতা হলো তিনি আফ্রিকান আমেরিকানদের মাঝে অতটা জনপ্রিয় নন। ২০২০ সালেও এই গোষ্ঠীর কাছ থেকে ভালো সাড়া পাননি তিনি।
৪। জশ শাপিরো
পেনসিলভ্যানিয়ার গভর্নর শাপিরোকে দলের একজন উদীয়মান নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। হুইটমারের মতো তিনিও ডেমোক্র্যাটদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গরাজ্যে বেশ জনপ্রিয়। এমনকি, জরিপে জানা গেছে, তার রাজ্যে ৩০ শতাংশ ট্রাম্প সমর্থকরাও তাকে পছন্দ করেন।
পিরোকে মূলত ২০২৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছিল, কারণ তিনি মাত্র দেড় বছর গভর্নরের পদে আছেন।
৫। জ্যারেড পোলিস
কলোরাডোর গভর্নর ও সাবেক কংগ্রেস সদস্য পোলিসও একজন উল্লেখযোগ্য বিকল্প হতে পারেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম গভর্নর, যিনি নিজেকে প্রকাশ্যে সমকামী বলে অভিহিত করেন। রাজনীতিবিদ হিসেবে তার রেকর্ড বেশ নিখুঁত এবং তিনি ২০১৮ ও ২০২২ সালের গভর্নর নির্বাচনে বেশ বড় ব্যবধানে জয়লাভ করেন।
তিনি 'ভবিষ্যতে' জাতীয় পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ইচ্ছেও প্রকাশ করেছেন।
৬। গ্যাভিন নিউসম
বাইডেন সরে দাঁড়ালে কে বিকল্প হতে পারেন, সে আলোচনায় বারবার উঠে এসেছে ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিনের নাম। পিট বুটিজেজের মতো তিনিও হতে পারেন একজন উপযুক্ত প্রার্থী।
তবে কৌশলগত দিক দিয়ে তাকে মনোনয়ন দেওয়া উচিৎ হবে না বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর সানফ্রানসিস্কোর সাবেক মেয়র—যে শহরটিতে সাম্প্রতিক সময়ে অপরাধপ্রবণতা অনেক বেড়েছে। গ্যাভিন মনোনয়ন পেলে রিপাবলিকানরা এ বিষয়টিকে পুঁজি করেই তার নির্বাচনী প্রচারণা ভেস্তে দিতে পারে বলে ভাবছেন বিশ্লেষকরা।
৭। রাফায়েল জি. ওয়ারনক
জর্জিয়ার সিনেটর ওয়ারনক অল্প সময়ের মধ্য একটি দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যে দুইবার জয়লাভ করেছেন।
২০২২ সালে ওয়ারনকের প্রচারণা ডেমোক্র্যাটদের জন্য আদর্শ হিসেবে বিবেচিত এবং তার দেওয়া ফর্মুলা ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণাকে প্রভাবিত করেছে বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। মিডওয়েস্টের বাইরের দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সে অঞ্চলের একজন নেতাকে মনোনয়ন দিতে পারে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি।
৮। মিশেল ওবামা
সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার স্ত্রী মিশেল প্রার্থিতা করতে রাজি হলে তা ডেমোক্র্যাটদের জন্য 'স্বপ্নের মতো' একটি বিষয় হবে বলে মত দিয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট। অনেকের দৃষ্টিতেই তিনি বাইডেনের আদর্শ বিকল্প, কিন্তু তিনি নিজেই প্রার্থিতায় রাজি নন।
মিশেল ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাবেক ফার্স্ট লেডি। ২০২৩ সালের ইউগভ জরিপে তিনি লেডি বার্ড জনসনকে পেছনে ফেলে প্রথম স্থান দখল করেন।
তবে তিনি প্রার্থিতার বিষয়ে কখনোই কোনো আগ্রহ দেখাননি এবং জানা গেছে, তার সঙ্গে বাইডেনের প্রচারণা দলের সদস্যদের সম্পর্কে টানাপড়েন চলছে।
মিশেল ওবামার প্রার্থিতা 'জরুরি অবস্থার' শেষ ভরসা হিসেবে বিবেচিত, এবং বিশ্লেষকদের মতে, সেই জরুরি অবস্থা এখনো আসেনি।
৯। অ্যামি ক্লোবুশার
মিনেসোটার সিনেটর অ্যামির সঙ্গে বাইডেনের তেমন কোনো পার্থক্য নেই—বয়স ছাড়া। তিনি তার অঙ্গরাজ্যে জনপ্রিয় এবং নীতিগতভাবে বাইডেনের একজন 'অনুসারী'। ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে তাকে একজন বাস্তববাদী ও বলিষ্ঠ রাজনীতিবিদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
তবে জাতীয় পর্যায়ে তিনি অতটা পরিচিত নন। ২০২০ সালের প্রাইমারি ককাসে লড়লেও তিনি খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি।
১০। অ্যান্ডি বিশিয়ার
ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান, উভয় দলের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন রাজনীতিবিদ অ্যান্ডি বিশিয়ার। কেনটাকি অঙ্গরাজ্যের গভর্নর হিসেবে তিনি বেশ সফল। গর্ভপাতের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়ে তিনি বেশ আলোচিত হন।
জাতীয় পর্যায়ে উঠে আসার জন্য তিনি বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে কট্টর সমর্থকদের বাইরে মধ্যপন্থীদের ভোটারদের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে বলে বিশ্লেষকদের মত।
বাইডেনের ঘুরে দাঁড়ানোর আশ্বাস
ইতোমধ্যে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ডেমোক্র্যাট পার্টির দাতাদের আশ্বস্ত করেছেন যে প্রথম ডিবেটে তিনি ভালো করতে না পারলেও নির্বাচনে তিনিই জিতবেন।
অপরদিকে, শনিবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে জো বাইডেনকে সরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস। প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চ্যালেঞ্জ করতে অন্য ডেমোক্র্যাটকে সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে পত্রিকাটি।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, বাইডেনের স্বেচ্ছায় সরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। দলের নেতারা তাকে সরিয়ে দেবে কী না, বা আদৌ সেটা সম্ভব কী না, তা আগামী দিনগুলোতে বোঝা যাবে।
Comments