বিষণ্ন মনে জন্মভূমি ছাড়লেন ড. বিজন

ড. বিজন কুমার শীল। ছবি: সংগৃহীত

বিষণ্নতা ও কিছুটা কষ্ট নিয়ে আজ রোববার সকাল সাড়ে ৭টার ফ্লাইটে সিঙ্গাপুর চলে গেলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীল। একেবারে চলে গেলেন, না সাময়িকভাবে গেলেন— তিনি নিজেও জানেন না। তবে, বাংলাদেশে ফিরে আসতে চান। শনিবার রাতে টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে এ কথা বলেন ড. বিজন।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে তো আমি সব সময়ই আসা-যাওয়ার মধ্যে ছিলাম। এবার যাওয়ার আগে কেন যেন মনটা খুব বিষণ্ন। খুব কষ্ট অনুভব করছি। আমার ওয়ার্ক পারমিট হবে না, এমন সিদ্ধান্তও কিন্তু জানিয়ে দেওয়া হয়নি। কষ্টের কারণ হয়তো, এত মান সম্পন্ন কিট উদ্ভাবন করলাম, এখনো অনুমোদন পেলাম না। ভেতরে ভেতরে একটা ধারণাও হয়ত তৈরি হয়েছিল যে, অল্প সময়ের মধ্যে ওয়ার্ক পারমিট পেয়ে যাব।’

গণবিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ড. বিজনের ওয়ার্ক পারমিটের জন্যে আবেদন করা হয়েছে। নতুন করে তার পদের বিজ্ঞপ্তি দিতে বলা হয়েছিল। সেটা সম্পন্ন হয়েছে। ট্যাক্সসহ আরও কিছু কাগজ চেয়েছিল, তাও জমা দেওয়া হয়েছে। আরও একটি বিষয় বলা হয়েছে, ওয়ার্ক পারমিট পেলে বাংলাদেশের বাইরে থেকে ভিসা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তারপর আসতে হবে। এক প্রকার বাধ্য হয়েই ড. বিজনকে বাংলাদেশ ছাড়তে হচ্ছে। গণবিশ্ববিদ্যালয় ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র তার বিষয়ে অত্যন্ত সংবেদনশীল। এই খ্যাতিমান বিজ্ঞানীকে তারা কোনোভাবেই ছাড়তে চান না।

‘আমার ওয়ার্ক পারমিটের জন্যে গণবিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। ধারণা করছি, প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে সময় লাগবে। প্রক্রিয়া বা আইনের প্রতি আমি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল। যে দেশে জন্ম, বেড়ে ওঠা, কাদামাটির গন্ধ, বিশেষ কারণে আমি অন্য একটি ভৌগলিক অংশের বাসিন্দা। কাগজপত্র অনুযায়ী আমার সিঙ্গাপুরের পাসপোর্ট, আমি সিঙ্গাপুরের নাগরিক। কিন্তু, বাংলাদেশ তো আমার জন্মভূমি। সেই দেশের ওয়ার্ক পারমিট পাব না, কল্পনাও করতে চাই না। এমন তো না যে আমি অর্থের জন্যে চাকরি করতে এসেছি। এর চেয়ে পাঁচ-সাত গুণ বেশি সুবিধায় সিঙ্গাপুরসহ অন্য কোনো দেশে কাজ করা মোটেই কঠিন কিছু নয়। কিন্তু, আমি জন্মভূমিতেই কাজ করতে চাই। আমার তো আর অর্থ-সম্পদের দরকার নেই। যাই হোক, যদি ওয়ার্ক পারমিট পাই তবে সেই কাগজপত্র সিঙ্গাপুরের বাংলাদেশ দূতাবাসে জমা দিতে হবে। তারা এমপ্লয়মেন্ট ভিসা দেবে। হয়তো ফিরে আসব প্রিয় জন্মভূমিতে। অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি কিট যে পর্যায়ে রেখে গেলাম, অনুমোদন পেলে উৎপাদনে যেতে পারবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। তবে, কিছু কারণে আমার উপস্থিত থাকার প্রয়োজন হতে পারে। যদি উপস্থিত থাকতে নাও পারি, সিঙ্গাপুর থেকেই সহায়তা করার চেষ্টা করব’, বলছিলেন ড. বিজন।

ড. বিজনের স্ত্রী ও দুই সন্তান সিঙ্গাপুরে থাকেন। গত সাত মাস গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ল্যাবে সঙ্গীদের নিয়ে গবেষণা করেছেন। গবেষণা এবং করোনা পরিস্থিতির কারণে সিঙ্গাপুরে যেতে পারেননি। তার ওয়ার্ক পারমিট প্রক্রিয়া কতদিনে সম্পন্ন হবে, তা তিনি জানেন না। এখনো বিশ্বাস করেন তার উদ্ভাবিত অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি কিট সরকারের অনুমোদন পাবে। উৎপাদন শুরুর সময়ে তিনি বাংলাদেশে থাকতে চান।

‘বিশ্বাস করি, কারণ আমরা করোনাভাইরাস শনাক্তের অপরিহার্য কিট উদ্ভাবন করেছি। আমাদের কিটটি ইউনিক। আমাদের অ্যান্টিবডি কিট দিয়ে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কি না এবং নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কি না, তা শনাক্ত করা যায়। পৃথিবীর অন্যান্য র‌্যাপিড টেস্ট কিট দিয়ে শুধু অ্যান্টিবডি শনাক্ত করা যায়, তা নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি কি না, সেটা শনাক্ত করা যায় না। অ্যান্টিবডির প্রকৃতি শনাক্ত করা অপরিহার্য দুটি কারণে। প্রথমত, যার শরীরে নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, তার টিকার প্রয়োজন নেই। ১৭ কোটি মানুষের জন্যে আমরা টিকার ব্যবস্থা করতে পারব না। দ্বিতীয়ত, টিকা দেওয়ার পরে পরীক্ষা করে দেখতে হবে শরীরে নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কি না। তৈরি না হলে বুঝতে হবে, টিকা কাজ করছে না। করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধু ভ্যাকসিন ভ্যাকসিন করলে হবে না। অ্যান্টিবডি টেস্ট করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই’, যোগ করেন তিনি।

কথা বলার সময় ড. বিজনের গলা ভারী হয়ে আসছিল। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবিত কিটের পেটেন্ট প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। পৃথিবীর অনেকগুলো দেশ র‌্যাপিড টেস্ট কিট উদ্ভাবন করে ব্যবহার শুরু করেছে। যদিও র‌্যাপিড টেস্ট কিট উদ্ভাবনের প্রথম ঘোষণা বাংলাদেশ দিয়েছিল। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সূত্রে জানা যায়, বেশ কয়েকটি দেশ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবিত কিট উৎপাদন করতে আগ্রহী। পেটেন্ট থাকায় সেসব দেশে উৎপাদনে বাধা নেই। এমনকি এর জন্যে বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি নেওয়ারও প্রয়োজন নেই। তবে, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র শেষ পর্যন্ত দেখতে চায়। একান্ত বাধ্য না হলে অন্য কোনো দেশকে স্বত্ব দিতে চায় না।

ড. বিজন বলছিলেন, ‘পৃথিবীতে সবার আগে উদ্ভাবন করে বাজারে আনতে পারিনি, এই দুঃখ সারাজীবন থাকবে। তবে, ভালো সংবাদ হলো আমরা পেটেন্ট করে ফেলেছি। আমাদের ইউনিক কিট অন্য কোনো দেশে তৈরি করতে পারবে না। শুরু থেকে বেশ কয়েকটি দেশ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। তারা তাদের দেশে উৎপাদন করতে চায়। এখনো সেই চাহিদা আছে। দেখেন, আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ। বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসা, দেশের মানুষের প্রতি মমত্ববোধ কথা বলে বোঝাতে চাই না। সত্যি বলছি, এই কিট অন্য কোনো দেশে উৎপাদন হোক তা আমরা কখনো চাইনি। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্যার চান সবচেয়ে কম মূল্যে এই কিটের সুবিধা বাংলাদেশের জনগণ পাক। তবে, শেষ পর্যন্ত যদি অনুমোদন পাওয়া না যায়, তবে বিকল্প চিন্তা আমরা হয়তো বিবেচনা করব।’

উল্লেখ্য, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ড. বিজন কুমার শীলদের উদ্ভাবিত অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি কিটের ঘোষণা দেয় মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। অনুমোদনের জন্যে আবেদন করে বাংলাদেশ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কাছে।  র‌্যাপিড কিট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত নয়, পৃথিবীর কোথাও ব্যবহার হয় না— ইত্যাদি কথা বলা হতে থাকে। সরকার সমর্থক চিকিৎসকদের অনেকে বলতে শুরু করেন, এই কিট মানসম্পন্ন নয়। পরীক্ষার আগেই সমালোচনা চলতে থাকে। বেশ সময় নিয়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ৩০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বিএসএমএমইউ) গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কিট পরীক্ষার অনুমতি দেয়। ২ মে বিএসএমএমইউ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কিট পরীক্ষার জন্যে ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করে। তারপর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ট্রায়ালের জন্যে কিট জমা দেয়। অভিযোগ আসে, অত্যন্ত ধীর গতিতে পরীক্ষা চলছে। প্রায় দেড় মাস পর ১৭ জুন বিএসএমএমইউ অ্যান্টিবডি টেস্ট কিট পরীক্ষার রিপোর্ট দেয়। তার আগেই বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষের অ্যান্টিজেন টেস্ট কিটের নমুনা সংগ্রহ পদ্ধতিতে ত্রুটি ধরা পড়ে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র পরীক্ষা স্থগিত রাখার আবেদন করে। অল্প সময়ের মধ্যে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র অ্যান্টিজেন কিটের নমুনা সংগ্রহের ডিভাইস তৈরি করে দেয়। তারপর থেকে অ্যান্টিজেন কিট পরীক্ষা নিয়ে চিঠি চালাচালি চলছে। পরীক্ষা আর শুরু হয়নি।

বিএসএমএমইউ পরীক্ষায় অ্যান্টিবডি কিটের কার্যকারিতা ৭০ শতাংশ সফল হিসেবে প্রমাণ হয়। কিন্তু, আরও মান উন্নয়নের পরামর্শ দিয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর অনুমোদন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র কিটের মান আরও উন্নত করেছে বলে একাধিকবার জানান ড. বিজন কুমার শীল ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। কিন্তু, পুনরায় পরীক্ষার জন্যে যে নীতিমালা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা পূরণ করা অসম্ভব বলে মনে করেন ড. বিজন। তারপর থেকেই বিষয়টি আটকে আছে।

আরও পড়ুন: আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানীর ‘সন্ন্যাসীর জীবন’ ও অনাবশ্যক বিতর্ক

আমাদেরই সবার আগে এই কিট বিশ্ববাসীর সামনে আনার সুযোগ ছিল: ড. বিজন

আমরা যা আজ ভাবছি, পশ্চিমা বিশ্ব তা আগামীকাল ভাবছে: ড. বিজন

ড. বিজনের উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে ৩৫০ টাকায় ১৫ মিনিটে করোনা শনাক্ত সম্ভব

দ্বিতীয়বার করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সম্ভাবনা নেই: ড. বিজন

বিমানবন্দরেই দ্রুত-নির্ভুল কোভিড-১৯ পরীক্ষা সম্ভব: ডা. জাফরুল্লাহ ও ড. বিজন

গণস্বাস্থ্যের কিটে নয়, ত্রুটি নমুনা সংগ্রহ প্রক্রিয়ায়

গণস্বাস্থ্যের কিট কার্যকর নয়: বিএসএমএমইউ, কিট কার্যকর- প্রতিবেদন পেয়ে প্রতিক্রিয়া: ড. বিজন

Comments

The Daily Star  | English

BNP's name being misused for personal gains: Rizvi

He urges party men to remain vigilant against committing misdeeds

47m ago