নোয়াখালীতে নিউমোনিয়ায় ২ মাসে ১০০ শিশুর মৃত্যু

নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতাল
নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের ৩ শিশু ওয়ার্ডে সক্ষমতার চেয়ে বেশি শিশু ভর্তি আছে। ছবি: আনোয়ারুল হায়দার/স্টার

নোয়াখালীতে শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়া রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসের ৬২ দিনে নিউমোনিয়ায় অন্তত ১ হাজার ৩০০ শিশু নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে ০-২৮ দিন বয়সী ১০০ শিশু চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে।

হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্তরা সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে এ তথ্য জানিয়েছেন।

হাসপাতালে ৪ নং শিশু ওয়ার্ডের ইনচার্জ আকলিমা আক্তার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত ডিসেম্বর মাসে এ ওয়ার্ডে নিউমোনিয়া আক্রান্ত ৩৪১ জন শিশু ভর্তি হয়। তাদের মধ্যে ১৮ জন মারা গেছে। জানুয়ারি মাসে ৩৫ শিশু ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৫ জন মারা গেছে।'

নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতাল
নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতাল। ছবি: স্টার

১৩ নং শিশু ওয়ার্ডের ইনচার্জ কামাল উদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডিসেম্বর মাসে এ ওয়ার্ডে ৪০০ শিশু নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়। তাদের মধ্যে ১১ জন মারা গেছে। জানুয়ারিতে ৩৮৪ শিশু ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৩ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে।'

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্পেশাল কেয়ার নিউনেটাল ইউনিট ওয়ার্ডের ইনচার্জ সিনিয়র স্টাফ নার্স জানান, ডিসেম্বর মাসে এ ওয়ার্ডে নিউমোনিয়া আক্রান্ত ৬৩ জন শিশুকে ভর্তি করা হয়। তাদের মধ্যে ২১ জন মারা গেছে। জানুয়ারীতে ৫১ শিশু ভর্তি হয়। তাদের মধ্যে ২২ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে।

এ ওয়ার্ডে মৃত শিশুদের মধ্যে ৩১ জন নির্ধারিত সময়ের আগে অর্থাৎ ৩৭ সপ্তাহের আগে ডেলিভারি করানো হয়েছে বলে জানান তিনি।

জানা গেছে, নোয়াখালী জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে হাতিয়া, সুবর্ণচর, কবিরহাট ও কোম্পানীগঞ্জের অধিকাংশ অধিবাসী দিনমজুর ও জেলে। শীতের শুরুতে এসব উপজেলায় দেখা দিয়েছে শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য ঠাণ্ডাজনিত রোগ।

জেনারেল হাসপাতালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ ও শয্যার সংকট থাকায় গরিব ও নিম্ন আয়ের বাবা-মা সন্তানদের নিয়ে উদ্বেগে আছেন।

নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতাল
শয্যা সংকটে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের বারান্দায় শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ছবি: আনোয়ারুল হায়দার/স্টার

তারা বলছেন, হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা শিশু ও ডায়রিয়া ওয়ার্ডে রোগী না দেখায় যথাযথ চিকিৎসার অভাবে শিশুরা মারা গেছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা অনিয়মিত হওয়ায় নোয়াখালী আবদুল মালেক উকিল সরকারি মেডিকেল কলেজ ও চিকিৎসক সহকারী প্রশিক্ষণ বিদ্যালয়ের (ম্যাটস) ইন্টার্ন চিকিৎসক ও নার্সদের ওপর নির্ভর করছে চিকিৎসা সেবা।

গতকাল শনিবার ও আজ রোববার নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের টয়লেট, ফ্লোর ও সিঁড়িতে ময়লা-আবর্জনা পড়ে আছে। শিশু ও ডায়রিয়া ওয়ার্ডের বাথরুম অপরিষ্কার ও নোংরা। ওয়ার্ডের বারান্দায় ও টয়লেটে বাতি না থাকায় অন্ধকারে রোগীর অভিভাবকদের দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। এর ফলে ব্যহত হচ্ছে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের চিকিৎসা সেবা।

হাসপাতালে কর্মরত স্টাফ নার্স ও শিশু ওয়ার্ড ইনচার্জ কামাল উদ্দিনসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্যরা জানান, হাসপাতালের ৩ শিশু ওয়ার্ডে মোট শয্যা ৪৩টি। কিন্তু শয্যার বিপরীতে শিশু ভর্তি থাকে প্রায় ২০০ জন। ওয়ার্ডগুলোতে প্রতিদিন ৪০-৫০ জন নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশু ভর্তি হচ্ছে।

ধারণক্ষমতার বেশি সংখ্যক রোগী ভর্তি হওয়ায় হিমশিম খাচ্ছেন তারা। হাসপাতালে শয্যার অভাবে শিশুদের বারান্দায় ও মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

এছাড়াও হাসপাতালে ওষুধ সংকট আছে বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ও বমির ইনজেকশনের সংকট আছে। শিশুদের জন্য নেবুলাইজার মেশিন থাকলেও ওষুধ না থাকায়, শিশুদের বুকের কফ অপসারণ ব্যহত হচ্ছে।

জানতে চাইলে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার সৈয়দ মহি উদ্দিন আবদুল আজিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডিসেম্বর-জানুয়ারির তীব্র ঠাণ্ডায় শিশুরা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। এই দুই মাসে নিউমোনিয়া রোগী অনেকগুণ বেড়েছে।'

ওষুধ সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, 'হাসপাতালে শিশু বিভাগের ৩টি ওয়ার্ডে ৪৩টি শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি থাকে ১৫০-২০০ জন। এ কারণে ওষুধ সংকট দেখা দেয়। শয্যা না পেয়ে অনেক শিশুদের তীব্র শীতেও মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।'

জানতে চাইলে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. ইয়াকুব আলী মুন্সি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া শিশুদের বেশিরভাগই ০-২৮ দিন বয়সী।'

মৃত শিশুদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'গ্রামের ধাত্রী দিয়ে নির্ধারিত সময়ের আগে ও পরে জোরপূর্বক ডেলিভারি করাতে গিয়ে নবজাতক ও প্রসুতিদের নানাভাবে আহত করা হয়। শেষ অবস্থায় তাদের সরকারি হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। এমনও দেখা গেছে কোনো কোনো শিশু হাসপাতালে ভর্তির কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মারা যাচ্ছে।'

নির্দিষ্ট সময়ের আগে জন্ম নেওয়া অপরিণত শিশুদের মায়ের বুকের স্পর্শে রাখার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, 'শিশুর ঠাণ্ডা লাগার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাওয়া নাক পরিস্কার করে দিতে হবে। শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি এবং বুকের নিচের অংশ যদি বেশি ওঠা-নামা করে এবং খাওয়া বন্ধ করে দেয় তাহলে দ্রুত নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে কিংবা রেজিস্টার্ড কোনো চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।'

হাসপাতালের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অনিয়মিত চিকিৎসা দেওয়া ও ওষুধ সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হেলাল উদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, '১৫০ শয্যা হাসপাতালের লোকবল দিয়ে ২৫০ শয্যা হাসপাতালের কাজ চলছে। লোকবল সংকটের কারণে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিঘ্নিত হচ্ছে।'

চিকিৎসকদের অনিয়মিত চিকিৎসা দেওয়া বিষয়টি নাকচ করে তিনি বলেন, 'রোস্টার করে মেডিকেল অফিসার কনসালটেন্ট ও সহকারী অধ্যাপকরা তাদের দায়িত্ব পালন করেন। এর পরেও সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

ওষুধ সংকটের পেছনে তিনি হাসপাতালের সক্ষমতার অতিরিক্ত রোগী আসাকে দায়ী করেন।

দুই মাসে ১০০ শিশুর মৃত্যুর বিষয়টি স্বীকার করে ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, 'মৃত শিশুদের বেশিরভাগই স্পেশাল কেয়ার নিউনেটাল ইউনিটে মারা গেছে।'

Comments

The Daily Star  | English

Teknaf customs in limbo as 19 mt of rice, authorised by AA, reaches port

The consignment of rice weighing 19 metric tonnes arrived at Teknaf land port on Tuesday evening with the documents sealed and signed by the Arakan Army

4h ago