জালের ফাঁদে ফিঙের মরণ

নিসর্গসখা দ্বিজেন শর্মা লিখেছিলেন, ‘ফুল ও পাখির উদয় পৃথিবীতে বলা চলে এক সঙ্গে, প্রায় ১০-১২ কোটি বছর আগে। সৌন্দর্যে, বৈচিত্র্যে উভয়ই সমতুল- তবু পাখি ছোটদের এত মন ভোলায় কেন?’
উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, ফিঙে পাখি কৃষি ও কৃষকের পরম বন্ধু। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

নিসর্গসখা দ্বিজেন শর্মা লিখেছিলেন, 'ফুল ও পাখির উদয় পৃথিবীতে বলা চলে এক সঙ্গে, প্রায় ১০-১২ কোটি বছর আগে। সৌন্দর্যে, বৈচিত্র্যে উভয়ই সমতুল- তবু পাখি ছোটদের এত মন ভোলায় কেন?'

আবার ছোট-বড় নির্বিশেষে মানবমনে পাখির ডাক ও সৌন্দর্য যে এক অদ্ভুত দ্যোতনা সৃষ্টি করে তার তুলনা বিরল। অথচ এই মনভোলানো পাখিগুলোই কাতারে কাতারে মরছে মাছের ঘের কিংবা ফসলের খেতের ওপর পেতে রাখা ফাঁদে।

পাখিরা কেবল প্রকৃতির অলংকার নয়, অবিচ্ছেদ্য অংশও বটে। এরা না থাকলে প্রকৃতি ধ্বংস হয়। ক্ষতি হয় মানুষের। অথচ সেই মানুষেরই লাভ-লোভের শিকার হচ্ছে এসব পাখিরা।

কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের বাস্তুসংস্থানে পাখির অবদান অনস্বীকার্য। পাখিরা ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে ফসল রক্ষা করে। বীজের বিস্তারে ভূমিকা রাখে সরাসরি। পাকা ফল খাওয়ার সময় বীজসহ খেয়ে ফেলে পাখি। পরে বিষ্ঠার সঙ্গে সেই বীজ বের হয়ে মাটিতে পড়ে জন্ম নেয় নতুন গাছ। প্রতিনিয়ত এভাবে জন্ম হয় অসংখ্য গাছের। তাই বলা চলে প্রাকৃতিক সবুজায়নে পাখির যে অবদান, তারও বিকল্প নেই।

অন্যদিকে ফুলের পরাগায়নে সরাসরি ভূমিকা রাখার পাশাপাশি ফসল রক্ষায় পাখির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো কীটপতঙ্গ নিধন। ফসলের অসংখ্য ক্ষতিকারক পোকা খেয়ে ফেলে পাখি। এ সংক্রান্ত গবেষণার তথ্য বলছে, ছোট একটি পাখি ঘণ্টায় এক হাজারের বেশি পোকা খায়। তাই পাখি ছাড়া ফসলহীনতায় দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ার অভিজ্ঞতাও আছে মানবজাতির।

ছবিতে জালে আটকে মারা যাওয়া যে পাখিটিকে দেখা যাচ্ছে সেটি একটি কালো ফিঙে। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, ফিঙে পাখি কৃষি ও কৃষকের পরম বন্ধু। ক্ষতিকর পোকামাকড় দমনে ফিঙে পাখির অবদান অনেক। এমন কিছু পোকামাকড় আছে যা কীটনাশক প্রয়োগ করলেও মরে না। কিন্তু পার্চিং পদ্ধতিতে ফিঙে পাখির মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবেই সেটি দমন করা সম্ভব।

পরিচিত এই ফিঙে এশিয়ায় বাস করা ড্রোঙ্গো পরিবারভুক্ত একটি ছোট্ট গানের পাখি। গ্রীষ্মকালীন অঞ্চলের স্থায়ী এই বাসিন্দা বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পশ্চিম ইরান থেকে শুরু করে ভারত ও শ্রীলঙ্কা হয়ে দক্ষিণ চীন এবং ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত দেখা যায়।

পৃথিবীতে প্রায় ২৪ প্রজাতির ফিঙের মধ্যে বাংলাদেশে দেখা মেলে ছয় প্রজাতির। পুরুষ ও স্ত্রী ফিঙে সহজে আলাদা করা যায় না। খোলা আকাশের নিচে কোনো খুঁটি, বিদ্যুতের তার অথবা গরু কিংবা মহিষের পিঠের ওপর লম্বা লেজ ঝুলিয়ে বসে থাকতে দেখা যায় এই পাখিটিকে। তাই বুঝি কবীর সুমনও গেয়েছিলেন, 'ভরসা থাকুক ট্রেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের লেজে…'

বলা হয়, একটি ফিঙে গড়ে ২৫ থেকে ২৮টি মাজরা পোকা খেতে পারে। এছাড়া এর খাবার তালিকায় আছে ঘাসফড়িং, হলুদ মাজরা পোকা, বাদামি ঘাসফড়িং ও পামরি পোকা। এসব ক্ষতিকর পোকামাকড় খাওয়ার কারণে কীটনাশকের অতিরিক্ত খরচ থেকে রক্ষা পান কৃষক।

কবি আল মাহমুদ তার কবিতায় ফিঙেকে অভিহিত করেছিলেন 'গগনভেরী ঈগলের চিরস্থায়ী রাজত্বের বিরুদ্ধে একটি কালো উড়ন্ত প্রতিবাদ' হিসেবে। লিখেছিলেন, 'সে কালো কিন্তু কোকিল নয়, সে কালো কিন্তু কাক নয়/সে বরং কাকের দঙ্গলকে ভিক্ষুকের দল মনে করে।/সে একা উড়ে, একাকী আঁচড়ে কামড়ে পালক ধসিয়ে দেয়/চিলের, শকুনের, বাজের।'

খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার মাধবকাঠি গ্রাম থেকে সেই সাহসী ফিঙের এমন করুণ পরিণতির ছবিটি তুলেছেন দ্য ডেইলি স্টারে আলোকচিত্রী হাবিবুর রহমান

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh foreign adviser visit to China 2025

Foreign adviser’s China tour: 10 extra years for repaying Chinese loans

Beijing has assured Dhaka it will look into the request to lower the interest rate to ease Bangladesh’s foreign debt repayment pressure

10h ago