ঘরের রান্নায় সিলিন্ডার গ্যাসের খরচ কমাবেন যেভাবে
সিলিন্ডার গ্যাসের অস্থির বাজারের প্রত্যহ ধকল সামলাতে হয় হিসাবি পরিবারগুলোকে। এই অনিশ্চয়তাকে মোকাবিলা করার জন্য চিরায়ত রন্ধন প্রক্রিয়া এবং চুলা ব্যবহারের অভ্যাসে পরিবর্তন আনতে পারেন।
তাই চলুন, বাসা-বাড়ির রান্নায় সিলিন্ডার গ্যাসের খরচ কমানোর কিছু উপায় জেনে নেওয়া যাক-
চুলা ব্যবহারের আগে নিয়মিত রান্নার পাত্র ও চুলা পরিষ্কার করা
রান্না বা সেদ্ধ করার পাত্রে লেগে থাকা বিন্দু বিন্দু পানি বাষ্পীভবনের জন্য অতিরিক্ত গ্যাস গ্রহণ করে। একইভাবে পূর্ণ শক্তির তাপ পেতে চুলা ময়লা বিশেষ করে পানিমুক্ত হওয়া প্রয়োজন। উজ্জ্বল নীল বর্ণ মানেই চুলা পূর্ণ শক্তিতে জ্বলছে।
আর হলুদ বা কমলা শিখা আংশিক অথবা কম শক্তিতে জ্বলনের ইঙ্গিত করে। আর এই হলুদ বা কমলা রঙের শিখা সাধারণত অপরিষ্কার চুলাতেই দেখা যায়। আংশিক দহনের ফলে রান্নার সময় পাত্র গরম করতে আরও বেশি গ্যাসের প্রয়োজন হয়। তাই পরিপূর্ণ তাপশক্তি পাওয়ার জন্য চুলা ও এর উপর বসানো পাত্র দুটোই ভালোভাবে পরিষ্কার করে নেওয়া উচিত।
চুলায় বসানোর আগে রান্নার যাবতীয় সামগ্রী প্রস্তুত করে নেওয়া
শাক-সবজিসহ রান্নার যাবতীয় কাঁচামাল ধোয়া, কাটা ও মেশানোর কাজ করতে হবে চুলা জ্বালানোর আগে। এমনকি অনেকে আগে থেকে পাত্র গরম করার উদ্দেশ্যে চুলা জ্বালিয়ে রান্নার সামগ্রী প্রস্তুত করতে থাকেন। এই কাজটিও ঠিক নয়। বরং রান্না শুরুর আগেই সমস্ত কাঁচামাল প্রস্তুত করে চুলার কাছাকাছি রাখতে হবে।
চুলার ওপর পাত্র বসিয়ে তাতে তৈরি কাঁচামালগুলো চড়িয়ে সবশেষে চুলা জ্বালানো উচিত। এতে করে সর্বনিম্ন সম্ভাব্য সময়ের জন্য চুলার চালু রাখার ব্যাপারটি নিশ্চিত করা যায়। তাছাড়া আগে থেকে গরম পাত্রে প্রস্তুতকৃত কাঁচামাল চড়ানোর ক্ষেত্রে অনেক ক্ষেত্রে তা পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
চুলা চালু করার আগে রান্নার সামগ্রী প্রস্তুতের সময় সেগুলোর ছোট ছোট টুকরো করা উচিত। খাবারের ছোট টুকরাগুলো বড়গুলোর চেয়ে দ্রুত সেদ্ধ বা রান্না হয়। কারণ ছোট টুকরোগুলোর আয়তনের তুলনায় তাদের পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল বেশি থাকে, যার কারণে তাপ দ্রুত খাবারগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। এই পদ্ধতিটি মূলত শাকসবজি, মাংস এবং অন্যান্য শক্ত উপাদানগুলোর জন্য উপযোগী।
রান্নার আগে হিমায়িত খাবার গলিয়ে নেওয়া
ফ্রিজে রাখা কোনো খাবার বের করার সঙ্গে সঙ্গে চুলায় চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। কারণ এ ক্ষেত্রে খাবারটি রান্না করতে সাধারণত দুটি পর্যায়ে তাপের দরকার হয়। প্রথমে জমাট বাঁধা খাবারটিকে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় নিয়ে আসার জন্য এবং তারপর সেটাকে গরম করার জন্য। খাবারের প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে অনেক খাবার গলাতে অনেক বেশি তাপের দরকার হতে পারে। ফলশ্রুতিতে, রান্নার সময়টি দীর্ঘায়িত হয় আর বাড়তে থাকে গ্যাসের খরচও।
তাই রান্নার জন্য নির্ধারিত খাবারটিকে আগে থেকে ফ্রিজ থেকে বের করে গলিয়ে নিতে হবে। এর ফলে খাবারটি আংশিক রান্না বা আধা সিদ্ধ হওয়ার ঝামেলা থাকে না। এমনকি অনেকে ঠান্ডা খাবার অনেকক্ষণ চুলায় রাখতে হবে ভেবে খাবার পুড়িয়ে ফেলতে পারেন। এ ক্ষেত্রে সেই বিড়ম্বনাও নেই। বরং এই প্রক্রিয়াতে খাবারের স্বাদ অটুট থাকে।
এমন রান্নার পাত্র ব্যবহার করা যা সম্পূর্ণভাবে চুলাকে ঢেকে ফেলে
পাত্রটিকে চুলায় এমনভাবে রাখা উচিত, যেন এটি আগুন বের হওয়ার পুরো জায়গাটিকে ঢেকে রাখে। পাত্রের পাশ ঘেঁষে আগুনের শিখা বের হওয়া মানে চুলাটি অনেক বেশি তাপশক্তি নিয়ে জ্বলছে। একই সঙ্গে এই শিখা অতিরিক্ত গ্যাস অপচয়ের বিষয়টিও নিশ্চিত করে।
এই অপচয় রোধের ক্ষেত্রে গোলাকার বা ডিম্বাকৃতির পাত্রের পরিবর্তে সমতল পৃষ্ঠের পাত্র অনেক বেশি কার্যকর। সমতল পৃষ্ঠের পাত্রটি একদম চুলার বার্নারের সমান না হলে স্বাভাবিকভাবেই এই পাত্রের গা ঘেঁষেও শিখা বেরিয়ে আসতে পারে। এমতাবস্থায় আগুন পাত্রের নিচে থাকা পর্যন্ত চুলা কমিয়ে রাখতে হবে। অন্যথায়, এই পাত্রও কোনো কাজে আসবে না।
আগুন পাত্রের সমতল পৃষ্ঠদেশের সর্বত্র ভালোভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এতে পাত্রের নিচে প্রতিটি অংশে সমান তাপ বিতরণ হয় বিধায় রান্না দ্রুততর হয়। অন্যদিকে, ডিম্বাকৃতি বা গোলাকার তলদেশের পাত্রের সব জায়গায় সমানভাবে তাপ লাগতে পারে না। অসম অংশগুলোতে তাপ পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় রান্নার সময়ও দীর্ঘায়িত হতে থাকে।
যতটা সম্ভব কম তাপে রান্না করা
রান্নাঘরে একসঙ্গে অনেক কাজ করার সময় অনেকেই চুলা একদম বাড়িয়ে দেন। এতে খাবার পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া উচ্চ তাপে রান্নার ফলে খাবারের প্রয়োজনীয় পুষ্টি নষ্ট হয়ে যায়। সর্বোপরি, এতে গ্যাসের অনেক অপচয় হয়। তাই সব সময় যতটা সম্ভব কম আঁচে রান্নার চেষ্টা করা উচিত।
যেমন- পানি ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছানোর পরেও চুলা পুরোটা বাড়ানো থাকলে সেই পানি বাষ্পীভূত হয়ে যাবে। ফলে ফুটন্ত পানি পেতে আবার চুলায় পানি চড়াতে হবে। এতে অতিরিক্ত গ্যাস অপচয় হওয়ার পাশাপাশি চরম অবস্থায় পাত্রের পৃষ্ঠদেশ পাতলা হয়ে যেতে পারে। আর ঘন ঘন এমন ঘটনা ঘটলে পাত্র ফুটো হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
তাপ সঞ্চয়ের একটি উপযোগী উপায় হচ্ছে চুলা বন্ধ করার পরে অবশিষ্ট তাপকে কাজে লাগানো।
যেমন- ভাত বা পাস্তার মতো খাবারগুলো রান্নার সময় রান্না সম্পন্ন হওয়ার কয়েক মিনিট আগে চুলা বন্ধ করে দেওয়া যায়। তারপর অবশিষ্ট তাপে শেষ করা যায় বাকি রান্না। এই প্রক্রিয়া খাবারের মানের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না।
রান্নার সময় পাত্রে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখা
খাবার গরম করার সময় বদ্ধ পাত্রের ভেতর থেকে তাপ বাইরে যেতে পারে না। অন্যদিকে, পাত্রের ওপরে ঢাকনা দেওয়া না থাকলে, যথেষ্ট পরিমাণে তাপ বাতাসে চলে যায়। ফলে হারিয়ে যাওয়া তাপের ঘাটতি পূরণে চুলার অতিরিক্ত তাপের যোগান দিতে হয়। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে পুরো রন্ধন প্রণালী সম্পন্ন হতে অনেকটা সময় লেগে যায়।
এ ছাড়াও রান্না চলাকালীন পাত্রে ঢাকনা থাকলে ভেতরের আর্দ্রতা অক্ষুণ্ন থাকে। ফলে খাবারের গুণগত মান ও স্বাদ নষ্ট হয় না।
পরিমিত পানি ব্যবহার
কী ধরনের খাবার রান্না করা হচ্ছে তার ওপর ভিত্তি করে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেশ হিসাবি হওয়ার উচিত। কারণ পানি কম হলে যেমন রান্না পরিপূর্ণ হবে না, আবার উপাদানগুলো পানিতে ডুবে গেলে হারিয়ে যেতে পারে কাঙ্ক্ষিত স্বাদ। পাত্রে পরিমিত পরিমাণে পানি দেওয়ার মাধ্যমে কম সময়েই পছন্দসই তাপমাত্রায় পৌঁছানো যায়। আবার পাত্রে একদম কম পানি থাকলেও স্বল্প তাপেই খাবার সেদ্ধ বা রান্না হয়ে যায়। তাই এক্ষেত্রে খাবারের প্রকৃতির দিকে খেয়াল রাখা বাঞ্ছনীয়।
একসঙ্গে একাধিক খাবার তৈরি
আলাদা আলাদা করে ভিন্ন খাবার তৈরি করার বদলে একবারে পাঁচমিশালী করাটা অধিক সাশ্রয়ী উপায়। অবশ্যই এখানে যে খাবারগুলো একই ধরনের তাপমাত্রায় বা পদ্ধতিতে রান্না হওয়ার উপযোগী, সেগুলোকে নির্বাচন করা উচিত। এগুলোকে ওয়ান-পট মিল বা এক পাত্রের খাবারও বলা হয়ে থাকে।
চুলায় দেওয়ার আগে প্রস্তুতিতে বেশ সময় লাগলেও গ্যাসের খরচ বাঁচাতে এটি বেশ কার্যকরী একটি পদ্ধতি।
এ ছাড়া একটি খাবার থেকে নিঃসৃত তাপকে অন্য একটি খাবার সিদ্ধ করতে কাজে লাগানো যায়। এ ক্ষেত্রে অবশ্য প্রয়োজন হবে বিশেষ পাত্রের, যেখানে উপর-নিচ করে দুটি ভিন্ন খাবার রাখার জায়গা থাকবে।
জ্বালানী-সঞ্চয়ী পাত্র ব্যবহার
ঢালাই লোহা বা তামার মতো পৃষ্ঠ সম্পন্ন পাত্রগুলো তাপকে সমানভাবে বিতরণ করতে পারে। এগুলো সাধারণ রান্নার পাত্রের চেয়ে বেশি সময় ধরে তাপ সঞ্চয় করে রাখতে পারে। ঢালাই লোহা দীর্ঘ সময় ধরে গরম থাকে, যা কম আঁচে রান্নার জন্য বেশ উপযোগী। এমনকি চুলা বন্ধ করে দেওয়ার পরেও অবশিষ্ট তাপ দিয়ে রান্না শেষ করা যায়।
আর তামা একটি উৎকৃষ্ট তাপ সঞ্চালনকারী পদার্থ বিধায় এটি দ্রুত উত্তপ্ত হতে পারে এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই উপকরণগুলো রান্নার সময় কমিয়ে দেয় এবং কম গ্যাস খরচ করেই রান্নায় ভিন্নতা আনা যায়।
পাত্রের নিচে তাপ ধরে রাখার পাথর ব্যবহার
বেশ পুরনো হলেও ঐতিহ্যবাহী এই পদ্ধতিটি গ্যাস ব্যবহারকে সাশ্রয়ী করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট কার্যকর। পাথরের রয়েছে তাপীয় ভর, যার কারণে এগুলো দীর্ঘ সময়ের জন্য তাপ শোষণ করতে পারে। এগুলোর মধ্য থেকে আংশিক মসৃণ ও প্রায় বৃত্তাকারগুলো সংগ্রহ করে বার্নারের ঠিক মাঝের গর্তে একটি বসানো যেতে পারে। তারপর চুলায় পাত্র বসিয়ে চুলা জ্বালিয়ে দিলে পাথরটি ধীরে ধীরে উৎপাদিত তাপ শোষণ করতে থাকবে। গরম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাথরটি পাত্রের মধ্যে উষ্ণতা ছড়াতে শুরু করে। এর ফলে অল্প গ্যাসেই উল্লেখযোগ্য পরিমাণে তাপশক্তি পাওয়া যায়।
বাসা-বাড়িতে রন্ধন প্রণালী ও চুলা ব্যবহারের এই উপায়গুলো সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহারকে অনেকাংশে সাশ্রয়ী করে তুলতে পারে। চুলায় রান্নার পাত্র বসানোর আগে পরিচ্ছন্নতা, হিমায়িত খাবার গলানো, এবং অল্প পানি ব্যবহারের মতো পূর্বপ্রস্তুতিগুলো স্বল্প সময়ে রান্নার সহায়ক হয়। ঢাকনা এবং সঠিক পাত্র ব্যবহার একদিকে যেমন রান্নাকালীন গ্যাস অপচয় রোধ করে, অন্যদিকে পাত্রের নিচে পাথর ব্যবহার উৎপাদিত তাপ ধরে রাখতে সহায়তা করে।
উপরন্তু, একসঙ্গে একাধিক খাবার রান্না করা গ্যাস সঞ্চয়ের কার্যকরী উপায়। সব মিলিয়ে লক্ষ্য হতে হবে- রান্নার সময়টাকে যথাসম্ভব কমিয়ে আনা এবং অল্প তাপে রান্না শেষ করা।
Comments