এমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বহু বছর দেখেনি কেউ

‘ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকে আসছেন আবার অনেক প্রতিষ্ঠান থেকেও টাকা ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কার্টনে কার্টনে পাঠানো হচ্ছে।'
বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা ও বয়সের মানুষ আসছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছবি: স্টার

বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে নিজের ছোট্ট ব্যাংকটি নিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে ১০ বছর বয়সী ইহান। শুধু ইহান নয়, করপোরেট পেশাজীবী থেকে শুরু করে দিনমজুর-রিকশাচালকসহ নানা বয়স, শ্রেণি, পেশার মানুষ নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে হাজির হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে।

একের পর এক প্রাইভেট কার, ট্রাক, ঠেলাগাড়ি আসছে, নামানো হচ্ছে শুকনো খাবার, খেজুর, ওষুধ, স্যানিটারি ন্যাপকিন, খাবার পানিসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী।

এত শ্রেণি-পেশা ও বয়সের মানুষের মিলনমেলা বহু বছর দেখেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

ছবি: স্টার

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতিতে গত বুধবার গণত্রাণ কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাদের এই কর্মসূচিতে ব্যাপক সাড়া পড়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলেছে। 

টিএসসি এলাকায় ক্ষণে ক্ষণে মাইকে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে, 'চলাচলের রাস্তায় ভিড় করবেন না, শৃঙ্খলা বজায় রাখুন'।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সকল বিভাগ ও আবাসিক হলে শিক্ষার্থীরা নিজ উদ্যোগে বন্যার্ত মানুষের জন্য ফান্ড সংগ্রহ, শুকনো খাবার, প্রয়োজনীয় জামা-কাপড় সংগ্রহ করছেন।

শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, গণত্রাণ কর্মসূচিতে কাজ করছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরাও।

ছবি: স্টার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'টিএসসিতে প্রবেশপথের পাশে গণ ত্রাণ সংগ্রহ বুথ বসানো হয়েছে। সেখানে তালিকাভুক্ত করে ত্রাণ রাখা হচ্ছে টিএসসির অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া কক্ষে। সেখানে প্যাকেজিং করে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে টিএসসি ক্যাফেটেরিয়ায়। এগুলো কাভার্ড ভ্যানে করে বন্যা কবলিত এলাকায় পৌঁছানো হবে।'

গতকাল রাতেই কয়েকটি গাড়ি বন্যা কবলিত এলাকায় রওনা হয়েছে বলে জানান তিনি।

ছবি: স্টার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আশরেফা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গতকাল সারাদিনে ব্যাংকে, বিকাশসহ অন্যান্য মোবাইল আর্থিক সেবা ও নগদ টাকা মিলিয়ে ২৯ লাখ ৭৩ হাজার ১৭৩ টাকা উঠেছে। আজকে সকাল থেকেই অসংখ্য মানুষ ত্রাণ সহায়তা ও নগদ টাকা নিয়ে আসছেন। আমরা অনুমান করছি আজকে রাতে শুধু নগদ অর্থের পরিমাণই ৫০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।'

'ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকে আসছেন আবার অনেক প্রতিষ্ঠান থেকেও টাকা ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কার্টনে কার্টনে পাঠানো হচ্ছে। এত জিনিস আমাদের নিজেদেরও লোকবল বাড়াতে হচ্ছে। ট্রাকে, ভ্যানে, ঠেলাগাড়িতে জিনিস আসছে,' বলেন তিনি।

ছবি: স্টার

সকল শ্রেণি-পেশা ও রাজনৈতিক পরিচয়ের মানুষ এক হয়ে কাজ করার বিষয়টি উল্লেখ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য ভূঁইয়া আসাদুজ্জামান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের স্ট্রাগলটা ছিল বাইনারি আইডেন্টিটির বিরুদ্ধে, যে দেয়াল আমাদের মধ্যে তুলে দেওয়া ছিল সেই দেয়ালের বিরুদ্ধে। অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে আমরা এখন একটা পর্যায়ে পৌঁছাতে পেরেছি। ব্যক্তির ভাবাদর্শ এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে না, দেশের নাগরিকের যে পরিচয় সেটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এটাই গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের পরিচয়ের বিভেদ ভুলে সবাই একসঙ্গে কাজ করছে এটা খুবই ইতিবাচক। এটা যেন সামনের দিনেও থাকে এবং আরও যেন মানুষকে সংঘবদ্ধ করা যায় সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাব।'

ছবি: স্টার

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. সামিনা লুৎফা বলেন, 'পৃথিবীর যেকোনো দেশেই মানবিক বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় সর্বস্তরের মানুষ সাধারণত এগিয়ে আসেন, স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে করেন। এটা সাধারণ ঘটনা। কিন্তু ৮৮ বা ৯৮ এর বন্যায় যেরকম টিএসসি ত্রাণের একটা কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল সেটা আমরা অনেকদিন দেখেনি।'

'গতকালকে আমি টিএসসিতে গিয়েছিলাম, ডোনেট করতেই গিয়েছিলাম। তখন আমি দেখেছি যে প্রচুর মানুষ আসছেন, ট্রাকে ট্রাকে জিনিস আসছে। এগুলো খুবই ভালো লক্ষণ। বোঝা যাচ্ছে যে বাংলাদেশের মানুষ মাত্র কয়েকদিন আগে যে ভয়াবহ নিপীড়ন, নির্যাতনের সয়ে একটা গণতান্ত্রিক দেশে রূপান্তরের জন্য চেষ্টা করছে সে অবস্থায় এই মুর্হূতে কালেক্টিভ আইডেন্টিটি বা যেটাকে আমরা একতার কথা বলি সেটা খুবই উজ্জীবিত অবস্থায় আছে। এই সময়ে খুব সহজে মানুষ মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে পারছে কারণ মাত্র কয়েকদিন আগেই হাসিনা হটাও আন্দোলনে তাদের এই যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল।

ছবি: স্টার

'অনেকের কথা শুনে আমার মনে হয়েছে, এই মুহূর্তে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য কিংবা দেশ গড়ার জন্য তারা যে কিছুটা হলেও কন্ট্রিবিউট করতে পারছেন এটাকে মানুষ দেশের জন্য কাজ বলে করছেন। এতদিন তারা করতে পারেন নাই, এখন করছেন। এতদিন করতে না পারার পেছনে কারণ ছিল সমস্তকিছুই একটা নির্দিষ্ট দলের মানুষের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল। তারা কোনোভাবে অন্যদেরকে ঢুকতে দেয়নি এবং সবকিছুর মধ্যেই তাদের নাম সিল ছিল। সেটা এখন আর নেই। যেকেউ এখন যেকোনো সামাজিক উদ্যোগের মধ্যে গিয়ে টাকাটা দিতে পারছে এই ভেবে যে এটা ছাত্রলীগের বা আওয়ামী লীগের বা প্রধানমন্ত্রী ত্রাণভান্ডার হয়ে উঠবে না। আশঙ্কা থেকে আমরা মুক্ত হয়েছি বলেই আমার কাছে মনে হয় অনেক বেশি মানুষ এই কাজের সাথে যুক্ত হতে পারছেন,' বলেন তিনি।

ছবি: স্টার

একই কথা জানান অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান। তিনি বলেন, 'গত ১৬ বছর ধরে দেখেছি যে এই ধরনের কাজ সরকারি ছাত্র সংগঠনের হাতে সীমাবদ্ধ ছিল। তার আগে কিন্তু যেকোনো সংকটের সময়ে সবার একটা সম্মিলিত অংশগ্রহণ আমরা দেখতে পেতাম। ঠিক সেরকম জায়গায় বোধহয় আমরা ফেরত গেলাম। এটাই হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য, এই ধরনের জাতীয় সংকটের মুহূর্তে সবাই সংকট থেকে উৎরানোর জন্য সমানভাবে তার অংশীদারিত্বটা নিশ্চিত করা।'  

Comments

The Daily Star  | English

Yunus’ economic gambit paying off

Two months ago, as Professor Muhammad Yunus waded into Bangladesh’s unprecedented political turmoil, he inherited economic chaos by default.

5h ago