৪ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংকট, প্রায় ৭০ হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত

ঢাবি শিক্ষার্থী সাম্য হত্যার বিচার দাবিতে শাহবাগ থানা ঘেরাও করতে যাচ্ছেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। ছবি: পলাশ খান/স্টার

বিক্ষোভের কারণে দেশের চার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। এতে প্রায় ৭০ হাজার শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়েছে।

বিক্ষোভের কারণে হচ্ছে না ক্লাস-পরীক্ষা। এতে সেশন জট বৃদ্ধি ও একাডেমিক ক্যালেন্ডার ঠিকভাবে শেষ হওয়া নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

এ চার বিশ্ববিদ্যালয় হলো—জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।

সাধারণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের আশঙ্কা, দীর্ঘদিন ক্লাস-পরীক্ষা না হলে যথাসময়ে সিলেবাস শেষ করা সম্ভব হবে না। 

বিশেষ করে কুয়েটে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ থেকে উপাচার্য অপসারণের আন্দোলনের কারণে গত তিন মাস এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যকে অপসারণের দাবিতে গত এক মাস ধরে কার্যত বন্ধ। এ কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এ দুই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।

কুয়েটের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের ক্যাম্পাস বন্ধ প্রায় তিন মাস। আমরা ক্লাসে ফিরতে চাই। আমাদের পড়াশোনা এবং সময় নষ্ট হচ্ছে।'

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন বলেন, 'এই সেমিস্টারে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমাদের সিলেবাস শেষ  করা এখন প্রায় অসম্ভব মনে হচ্ছে।'

শিক্ষকরাও বলছেন একই কথা। দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, একাডেমিক সেশন স্থবির হয়ে গেছে, যার ফলাফল অবশ্যই শিক্ষার্থীদের জন্য ভালো হবে না।

শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে গত মঙ্গলবার বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে অব্যাহতি দেয় সরকার। সেখানে নিযুক্ত নতুন উপাচার্য অধ্যাপক তৌফিক আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কোনো সমস্যা সমাধানই অসম্ভব নয়। আমি শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করে সব সমস্যা সমাধান করব।'

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক এসএমএ ফয়েজ ডেইলি স্টারকে বলেন, কুয়েট ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে।

তিনি বলেন, 'সমস্যা সমাধানে আমরা কোনো কৌশল বাদ রাখছি না। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কিছু সমস্যা আছে। আমরা শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি।'

তিনি আরও বলেন, 'অনেক বছর পর এবার শিক্ষার্থীরা তাদের কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে। এতদিন তারা দাসের মতো বন্দী ছিল। কিন্তু এখন তারা এমন একটি উন্মুক্ত পরিবেশ পেয়েছে, যেখানে তারা নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে পারছে।'

তবে, দীর্ঘ সময় ক্লাস-পরীক্ষা না হওয়ায় পড়াশোনার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা সমস্যায় পড়বে বলেও মন্তব্য করেন ইউজিসি চেয়ারম্যান।

'আমি আশা করি সবাই এই বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে নেবে। কমিশনের পক্ষ থেকে অবিলম্বে যা করা সম্ভব, আমরা তা করার চেষ্টা করব,' বলেন তিনি।

ইউজিসি সূত্র জানায়, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৬ হাজার ৬৭৬, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭ হাজার ৫২৭, কুয়েটে ৭ হাজার ৯৪১ ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭ হাজার ৩৪৬ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরপর দেশের বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটেছে। প্রায় ৪৫টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রো-ভিসি এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা পদত্যাগ করেছেন অথবা পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।

অভ্যুত্থানের পর সরকার ১৮ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পুনরায় চালু করার পরিকল্পনা করলেও, পরে প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধীরে ধীরে ক্লাস শুরু হয় ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ২০ অক্টোবরের মধ্যে। তখন পর্যন্ত অনেক ক্যাম্পাসে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ডেইলি স্টারকে বলেন, '৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর নতুন প্রশাসন দুর্বল ছিল এবং তাদের সঠিক পরিকল্পনার অভাব ছিল। কারণ সরকার পরিস্থিতি কার্যকরভাবে সামলাতে পারেনি।'

'কিছু ক্ষেত্রে সরকার অনিশ্চিত ছিল যে, সংকট মোকাবিলায় কখন কঠোর হতে হবে, আর কখন নরম হতে হবে,' বলেন তিনি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) আবাসন সংকটকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রসঙ্গ তুলে আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, 'সম্প্রতি কিছু বিক্ষোভে সরকারের "সমর্থন" দেখে জবি শিক্ষার্থীরা মনে করেছিল যে, তারা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের দিকে মিছিল নিয়ে যেতে পারবে।'

আবাসনের দাবিকে ন্যায্য বলে উল্লেখ করেন তিনি। তবে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের প্রতি পুলিশের আচরণের সমালোচনা করে তিনি বলেন, 'এতে পরিস্থিতি আরও সংকটে পড়েছে এবং এটার প্রভাব শিক্ষকদের ওপরও পড়েছে।'

এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত মঙ্গলবার রাতে এক শিক্ষার্থীকে হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেখানে গতকাল কোনো ক্লাস-পরীক্ষা হয়নি। 

শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম সাম্যকে ছুরিকাঘাতে হত্যার ঘটনায় শিক্ষার্থীদের একটি অংশ বুধবার থেকে বিক্ষোভ করছে।

শিক্ষার্থীরা গতকাল বিভিন্ন অনুষদের গেট, রেজিস্ট্রার ভবন এবং লাইব্রেরিতে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে।

আজ শুক্রবার সকালে শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ করে শাহবাগ থানা ঘেরাও কর্মসূচি পালন করছে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা গতকাল ঢাকার কাকরাইল মোড়ে টানা দ্বিতীয় দিনের মতো ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করে তাদের অবস্থান কর্মসূচি পালন করে।

গতকাল রাতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকরা একাত্মতা ঘোষণা করেন এবং আজ দুপুরে জুমার নামাজের পর থেকে তারা অনশনে বসবেন বলে ঘোষণা দেন।

তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে যথাযথ আবাসিক সুবিধা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য আবাসন ভাতা প্রদান।

কুয়েটে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি বহিরাগতদের হামলায় শিক্ষার্থী আহতের ঘটনার পর অচলাবস্থা শুরু হয়। পরে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের এক পর্যায়ে উপাচার্যকে অপসারণের দাবিতে অনশনে বসলে সরকার উপাচার্যকে অব্যাহতি দেয়।

সেখানে ৪ মে থেকে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা থাকলেও, শিক্ষকরা সরকারের সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্টি জানিয়ে একাডেমিক কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা দেন।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেট থেকে এক সদস্যকে অপসারণ করলে ১৫ এপ্রিল থেকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ শুরু হয়।

রেজিস্ট্রার নিয়োগের পর থেকে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের একটি অংশ উপাচার্যের তীব্র বিরোধিতা করেন। অনিয়ম ও প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার অভিযোগে বিক্ষোভের মধ্যে ১৩ মে উপাচার্য পদ থেকে অধ্যাপক শুচিতা শারমিনকে অপসারণ করা হয়।

 

Comments

The Daily Star  | English

JnU protests called off

Students and teachers of Jagannath University called off their protest last night after receiving assurances from the government that their demands would be met.

3h ago