ব্যাংক কিনে কেউ এখন দেউলিয়া হয় না

সত্যি নাকি গুজব, সেটা নির্নীত না হলেও একটা গল্প ইদানীং জনপ্রিয় হয়েছে। গল্পটা এমন— স্টিভ জবসের সঙ্গে বিল গেটসের দেখা এক অনুষ্ঠানে। বিল গেটসকে চিন্তামগ্ন মনে হচ্ছিল। স্টিভ জবস তার কাছে জানতে চাইলেন, বিল তোমাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন? কোনো সমস্যা? বিল জানালেন, তিনি ব্যাংকে গিয়েছিলেন ঋণের ব্যাপারে কথা বলতে। স্টিভ বললেন, আরে কী বলো বিল তুমি? তোমার কত টাকা দরকার? বিল বিনয়ের সঙ্গে উত্তর দিলেন, টাকাটা আমার দরকার না। ওই ব্যাংকের দরকার।

এখন নাকি ব্যাংকেরই টাকা দরকার। কয়েকদিন ধরে ব্যাংক নিয়ে বিস্তর গুজব ছড়িয়েছে দেশে। আসলে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর অবস্থা কী? সেখানে কী ঋণ নিয়ে 'নয়-ছয়' চলছে? 'নয়-ছয়' এ যাওয়ার আগে ব্যাংকের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গাটার কথা বলে নেই।

ঋণ নেওয়ার জন্য হোক আর প্রেম প্রস্তাবের জন্য হোক, ব্যাংকের আকর্ষণীয় জায়গার নাম 'নগদ গ্রহণ'! আমার পরিচিত একজন ব্যাংকের 'নগদ গ্রহণে' কর্মরত এক মেয়েকে বলেছিলেন, 'আমার হৃদয়টাকে আপনি নগদে গ্রহণ করুন।' তার চিৎকার চেঁচামেচিতে ওই পরিচিতকে গলাধাক্কা দিয়ে বিদায় করা হয়েছিল ব্যাংক থেকে। ৪ বছর পর দেখা গেল ওই মেয়েটি আমার পরিচিত ওই ছেলের সঙ্গেই সংসার করছে।

ব্যাংক যে কখন নয়, আর কখন ছয় করে বোঝা ভার।

রবীন্দ্রনাথও ব্যাংককে বুঝতে পারেননি। নোবেল পাওয়ার আগেই গরীব কৃষক, শ্রমিক ও মৎস্যজীবীদের মহাজনী ঋণ থেকে বের করে আনার জন্য ১৯০৫ সালে নিজ জমিদারি এলাকা পতিসরে 'কালীগ্রাম কৃষি সমবায় ব্যাংক' স্থাপন করেছিলেন। সুস্থ সমবায় ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করে খেটে খাওয়া মানুষের জন্য তিনি স্বল্প সুদে ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করে ভেবেছিলেন, প্রান্তিক মানুষের জীবন ব্যবস্থা বদলে যাবে। সম্ভবত ক্ষুদ্র ঋণের আইডিয়াটা রবীন্দ্রনাথই প্রথম করেছিলেন। সে যাই হোক, রবীন্দ্রনাথের পছন্দ ছিল কবিতা, গান বা গল্প, গণিত নয়। ফলাফল হয়েছিল ভয়াবহ। ঋণ নিয়ে অনেকেই ফেরত দেননি। ব্যাংকের ধ্বস ঠেকাতে ১৯১৩ সালে পাওয়া নোবেল পুরষ্কারের ১ লাখ ২০ হাজার টাকাও লগ্নি করেছিলেন সেই ব্যাংকে। ১৯২৫ সালে রবীন্দ্রনাথের এই ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যায়। অনেকে বলেন, ভারত উপমহাদেশের প্রথম ব্যাংক রবীন্দ্রনাথের।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, ব্যাংকের এই নয়-ছয় অবস্থা শুধু এই সময়ের না, অনেক আগেরও। অর্থাৎ এটা ঐতিহ্যবাহী।

ব্যাংক নিয়ে প্রচুর চলচ্চিত্র আছে। আছে বিশ্বজুড়ে ব্যাংক ডাকাতির লোমহর্ষক ঘটনা। ২০০৩ সালে ইরাকে আমেরিকান আগ্রাসনের আগের দিন সাদ্দাম হোসেন তার ছেলে কুশেকে পাঠিয়েছিলেন ইরাকের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা আনতে। ৩ ট্রাক ভর্তি করা কয়েক মিলিয়ন ডলার কুশে এনেছিলেন ঠিকই, কিন্তু ভোগ করতে পারেননি। পরে এটা আমেরিকান সৈন্যদের হাতে পরে। তারা টাকা ভাগাভাগি করে নেয়। এই ঘটনায় ৩৫ জন আমেরিকান সৈন্য ও সার্ভিসম্যানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। টাকার অংকে এটা ছিল সবচেয়ে বেশি অর্থ ডাকাতির ঘটনা।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ টাকা ডাকতির ঘটনাও ইরাকের। সেবার ইরাকের দারেস সালাম ব্যাংক থেকে ২৮২ মিলিয়ন ডলার লুট করা হয়েছিল।

তবে বাংলাদেশে একসময়ে ব্যাংক লুট করা হয়েছিল মহৎ উদ্দেশ্যে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি ব্যাংক লুট করেছিলেন যুদ্ধের তহবিল সংগ্রহের জন্য। তবে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে টাকা লোপাটের ঘটনা আছে অনেক। যেমন: ২০১২ সালে সোনালী ব্যাংকের ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছিল। প্রায় একই সময়ে হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে এবং ব্যাংক থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়। বেসিক ব্যাংকে ৪ হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারির ঘটনা দেশময় তোলপাড় তোলে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতেও জনতা ব্যাংকে ২৫১ কোটি টাকার দুর্নীতি ধরা পরে।

এ ছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একবার টাকা লোপাটের ঘটনা ঘটেছিল। ২০১৬ সালর ২৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে (?) প্রথম হামলে পড়েছিল হ্যাকার, চোর অথবা লোপাটকারীরা। ৫ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১২টায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফটের (সুইফট হচ্ছে ব্যাংকের আর্থিক লেনদেনের বার্তা আদান প্রদানকারী আন্তর্জাতিক একটা নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা) বার্তা ব্যবহার করে ৩৫টি অর্থ স্থানান্তরের অ্যাডভাইস পাঠানো হয়েছিল আমেরিকার ফেডারেল ব্যাংক অব নিউইয়র্কে (এই ব্যাংকে বাংলাদেশের মতো অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বড় বড় প্রতিষ্ঠান তাদের রিজার্ভ বা সঞ্চয় জমা রাখে। এই টাকা দিয়ে বিদেশি ঋণ শোধ, কেনাকাটার দাম পরিশোধ, এলসির টাকা পরিশোধসহ আরও অনেক কিছুর লেনদেন হয়ে থাকে) ৩৫টির ভেতর ৫টি বার্তা বা পরামর্শ কার্যকর হয়ে গেলে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার বা ৮০৮ কোটি টাকা চলে যায় ফিলিপাইন ও শ্রীলংকাতে।

ব্যাংকের টাকা নিয়ে এ দেশের অনেকের আগ্রহ আছে। ব্যাংকের টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়াটা এখন ফ্যাশন। বাংলাদেশে যত খেলাপি ঋণগ্রহীতা আছে, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে সেটা আছে কি না, সন্দেহ। হাজারো কোটি টাকা লুটে নিয়েছে অল্প কয়েকজন খেলাপি। সরকার আসে, সরকার যায়; খেলাপিদের তাতে কিছু যায় আসে না। আসে যায় না সুদের হার নিয়ে 'নয়-ছয়' করলে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১৮ সালের আগস্টে বিনিয়োগের সুদ বা মুনাফার হার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ এবং ৬ মাসের কম মেয়াদি মুনাফার হার ৬ শতাংশ বেঁধে দিয়েছিল, যা বেসরকারি ব্যাংকের মালিকরা মেনেও নিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে এই নয়-ছয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাস্তবায়িত করতে পারেনি। সুদের হার এখন আর সরকারের ওপর নির্ভর করে না, ব্যাংক মালিকদের মর্জির ওপর নির্ভর করে। তাই তো  এই হার ১৭-১৮ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। তারপরও বেসরকারি ব্যাংকগুলো ভুগছে তীব্র তারল্য সংকটে, খেলাপি ঋণ বেড়েছে অনেক বেশি মাত্রায়, আস্থা সংকটের কারণে বাড়ছে না বিনিয়োগ। যার প্রভাব পড়ছে শেয়ার বাজারে। সব মিলিয়ে ব্যাংকের ওপর আস্থা কমে গেছে মানুষের। আর ব্যাংক পাচ্ছে না আমানতকারী। তবু খেলাপিদের কাউকে শাস্তি পেতে দেখা যায়নি।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আপনি দুর্বল হলে টাকা ফেরত দিতে হবে, সবল হলে ব্যাংক আপনার পেছন ঘুরে মরবে। যদি আপনি ব্যাংক থেকে মাত্র ৫ লাখ টাকা ঋণ নেন, তাহলে সেটা আপনার মাথাব্যথা। কিন্তু ৫০০ কোটি ঋণ নিলে সেটা ব্যাংকের মাথাব্যথা। খেলাপিরা তাই শত কোটির নীচে নামে না।

আসুন আমরাও আর নীচে না নামি। ব্যাংকের ওপর শেষ ভরসাটা জিইয়ে রাখতে আমরা দুটো গল্প শুনে বিদায় নেই।

গাড়ি কিনবে বলে ঋণ নিতে ব্যাংকে গেছেন একজন। তার সব তথ্য নেওয়ার পর ব্যাংক ম্যানেজার বললেন, ঠিক মতো কিস্তি দিয়ে ঋণ শোধ করবেন। না হলে আপনার গাড়ি কিন্তু ব্যাংক নিয়ে নেবে। তার ভয়াবহ মন খারাপ হলো। 'কি হলো?' ব্যাংক ম্যানেজারের এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, আগে জানলে আমি ঋণ নিয়েই বিয়ে করতাম।

সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছিলেন, বই কিনে কেউ কখনো দেউলিয়া হয় না। তিনি বেঁচে থাকলে এখন হয়তো লিখতেন, 'ব্যাংক কিনে এখন আর কেউ দেউলিয়া হয় না। তবে আমানতকারীদের অবস্থা রবীন্দ্রনাথের মতো হবে কি না, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না।'

আমরা বিশ্বাস রাখি। পরের গল্পটা বিশ্বাসের।

অস্ত্র হাতে দলবল নিয়ে টেন্ডার দাখিল করতে গেছেন পাপ্পু। তিনি একাই টেন্ডার বিট করবেন, অন্য কাউকে করতে দেবে না। টেন্ডার কর্মকর্তা ভড়কে গেলেন। তিনি পাপ্পুকে বললেন, আপনি টেন্ডার বুথ দখল করতে পারেন, তাতে সাময়িক লাভ হবে। তারচেয়ে একটা ব্যাংক দখল করুন। মেধা থাকলে বিশ্ব জয় করতে পারবেন।

পাপ্পু ভড়কে গেলেন নিজেই। কী করবেন তিনি এখন? টেন্ডার কর্মকর্তাকে কী বিশ্বাস করা যায়?

নাকি এ দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলো এখন পাপ্পুদের দখলে?

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

15h ago