জেল-জমানার ওসি হারুন: সিস্টেমের মহানগরে সিস্টেমবাজ সুপারহিরো
মহানগরজুড়ে অনেক চরিত্র। মহানগরজুড়ে অনেক গল্পও বটে। গল্পগুলো ছড়িয়ে যায়, এসে আবার গুটি বাঁধে একখানে। আবার ছড়ায়। অনেক গল্প আর চরিত্রের ভিড় এসে একখানে দানা বাঁধে এখানে।
এরপর এই সকল গল্পের জটিল সব জটেরা খুলে যায় তার কাছে এসে। তিনি ভয়ঙ্কর বুদ্ধিমান, কুটিল, অর্থলোভী। অসহায় মানুষকে নিয়ে খেলতে-খেলাতে ভালোবাসেন। তবে তাদের 'ক্ষতি' করেন না। 'মেয়ে এবং মদের' দোষ নাই তাঁর একেবারেই। তবে তিনি সিগারেটে বুঁদ। ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় বুদ্ধি খোলা আর খেলানোই তার কাজ।
আবার শ্রেণির প্রশ্নে তিনি বড্ড সচেতন। বড়লোকের টাকার প্রতি যত লোভ তার। গরিবের টাকায় তেমন রুচি নেই। তিনি এই মহানগরের এক পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি আশফাক নিপুণের মহানগর- এর ওসি হারুন (মোশাররফ করিম); যিনি তার পদবীর চাইতেও অনেক বেশি ক্ষমতাধর এবং নিরঙ্কুশ।
তবে প্রথম থেকে নজর দিলে দেখা যায়, গল্পটা এমন ছিল না মোটেও। মহানগরের প্রথম সিজনে ওসি হারুন এতটা নিরঙ্কুশও ছিলেন না। তার বলয় ছিল কতোয়ালি থানা ঘিরে। আর ভালো খারাপের বাইনারিতে তার অপরপক্ষে দাড়িয়ে ছিলেন মলয় (মোস্তাফিজুর নূর ইমরান) নামের পুলিশ চরিত্রটি। কেবল তাই নয়, ওসি হারুন আমাদের সামনে হাজির ছিলেন একটি জীবন্ত সংশয় হিসেবে। আমরা দর্শকরা একদম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম ওসি হারুনের কতিপয় সৎগুণ জানতে। তবে দ্বিতীয় সিজনে কিন্তু এমনটা ঘটে না। তখন তাকে নিয়ে কিছুটা সংশয় থাকলেও তাকে আমরা অল্প বিস্তর চিনি। জানি তার নির্ভেজালভাবে মিথ্যে বলতে পারার ইতিবৃত্ত, আর জানি টাকার জন্য তার ভয়ঙ্কর কাঙালপনার কথা। ফলে তাকে আমাদের দেখা আশেপাশের পরিচিত আর দশটা ধূর্ত, ধান্ধাবাজ মানুষের মতোই অল্প-বিস্তর পাঠ করা যাচ্ছিল।
ঘটনার মোড় ঘুরতে লাগল মহানগর-২ এর সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে। এখানে প্রতি পর্বেই ওসি হারুন একজন মানব থেকে অতিমানব হয়ে ওঠার দিকে যাত্রা করতে থাকেন। মনে রাখতে হবে, মহানগর থেকে মহানগর-২ ওসি হারুনের জন্য একটি রাতের ব্যবধান হলেও, এর পরিচালক নিপুণ এবং দর্শকের জন্য মাঝে পেরিয়ে গেছে দুটি বছর। প্রথম পর্বে আফনান চৌধুরীর (শ্যামল মওলা) গালে কষে ওসি হারুনের চড় দেওয়ার দৃশ্য দর্শককে প্রশান্ত ও পরিতৃপ্ত করেছে। কারণ সুগন্ধা গ্রুপের মালিকের বেয়াড়া এবং ধর্ষক সন্তান আফনান চৌধুরীর মতো চরিত্রগুলো বাস্তবের জমিনে সাধারণত এক রাতের জন্যও আটক হন না; চড় খাওয়া তো আরও দূর অস্ত। ফলে আমদর্শকের মনে ওসি হারুনের চরিত্রকে পরাবাস্তব মনে হতে থাকে। দুই বছর ধরে দর্শক রহস্যময় ওসি হারুনকে অতিমানব হিসেবে আকাঙ্ক্ষা করতে থাকে। আশফাক নিপুন এই আকাঙ্ক্ষার চাপ এড়াতে পারেন না। ফলে ওসি হারুনের মুখে বসিয়ে দেন 'নামটা হইতেসে হারুন' বা 'এক ঘন্টা সময় আমার জন্য অনেক' অথবা শুনতে থাকি- 'ওসি হারুন হারে না' ধরনের সংলাপ। এ ধরনের সংলাপ বাণিজ্যিক মূলধারার চলচ্চিত্রে প্রটাগনিস্টদের মুখে অহরহই শোনা যায়। উদাহরণ হিসেবে ডন (২০০৬) চলচ্চিত্রের শাহরুখ খানের কথা আসতে পারে। সেখানে কথায় কথায় তিনি বলে উঠতেন, ডনকে পাকাড়না মুশকিল নেহি হ্যায়; না মুমকিন হ্যায় (ডনকে আটক করা শুধু মুশকিলই নয়, বরং অসম্ভব)। ফলে ওসি হারুনকেও শেষের দিকে এসে ডনের মতোই অপ্রতিরোধ্য মনে হতে থাকে।
তাই বলা যায়, গুলি খেলেও হয়তো ওসি হারুন ফিরবেন তৃতীয় সিজনে। অর্থাৎ তৃতীয় রাতে আবারও হয়তো সেই হারুনেরই 'খেলা হবে'। অতীত আর বর্তমানের মিশেলে প্যারালাল স্টোরি টেলিংয়ে আশফাক নিপুণ শোনাবেন আরও একাধিক গল্প; যার বড় অংশজুড়ে থাকবেন ওসি হারুন।
মজার বিষয় হলো, ওসি হারুন কিন্তু এখন আর দুষ্ট চরিত্র হিসেবে হাজির নেই; যা তাকে আর সব সমসাময়িক সিরিজের পুলিশ প্রটাগনিস্টদের থেকে আলাদা করেছিল। তিনি দুষ্টু থেকে ভালো, ভালো থেকে মহামানব চরিত্র হয়ে উঠেছেন। এই চরিত্রটিকে রবিন হুড চরিত্র বললেও অত্যুক্তি হবে না। অজানা এক জায়গায়, অজানা কোনো শক্তিশালী বাহিনীর হাতে বন্দি অবস্থাতেই কয়েকটি ফোন কলে তিনি জামিনপ্রাপ্ত আফনানকে ধর্ষন মামলায় পুনরায় গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি ভিকটিমের প্রটেকশনের ব্যবস্থা করেন রাতারাতি। যেহেতু মলয় নেই, ফলে সিরিজটি চলতে থাকে ওসি হারুনকে কেন্দ্র করে। আর এখানেই নিজের অজান্তে (অথবা জ্ঞাতসারেই) পরিচালক ওসি হারুনকে খোদ মহানগর সিরিজটির প্যারালাল হিসেবে হাজির করেন। এমনকি চরিত্রটিকে কখনো কখনো পুরো গল্পের চেয়েও বড় মনে হতে থাকে।
অনেকে বলবেন এটা তো ফিকশন। তবে এটাই সেই সাহসী ফিকশন; যার অধিকাংশ আলাপই বিদ্যমান বাস্তবতার জমিনে নির্মাণ বলে মনে হতে থাকে। বাস্তবে ভয়ঙ্কর খল চরিত্রগুলোকে এখানে ওসি হারুন ক্রমাগত চ্যালেঞ্জ জানাতে থাকেন। শুধু তাই নয়, ওসি হারুন নিদারুণভাবে সেই চরিত্রগুলোকে পরাজিতও করতে থাকেন। বাস্তবে টেলিফোনে ক্রসফায়ারে মৃত্যুর আগে বাবার কান্নার শব্দ শোনা মেয়েদের মতোই শত মানুষের আনন্দ হয়, যখন সিরিজের মাসুম (দিব্য জ্যোতি) চরিত্রটি একবারও পেছনে না ফিরে মৃত্যু থেকে নিশ্চিন্তে ধীরপায়ে হেঁটে হেঁটে দূরে-বহুদূরে চলে যান। এই দৃশ্য দর্শককে অদ্ভুত প্রশান্তি দেয়। তাদের নিখোঁজ হওয়া আর উঠিয়ে নেওয়া স্বজন কিংবা পরিচিতজনরা ক্রসফায়ারকে এমনই নির্বিঘ্নে পেছনে ফেলে, হেঁটে হেঁটে দূরে কোথাও বেঁচে বর্তে আছেন- এটা ভাবতে তাদের ভালো লাগে। তারা ওসি হারুনের প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করে। অথবা গোয়েন্দা অফিসের সেই ব্যবসায়ীর অন্তত পরিবারকে নিজের অবস্থান জানানোর আকুলতা আমাদের ছুঁয়ে যায়। এসব ঘটনার সঙ্গে আমরা অনেকদিন ধরে পরিচিত বলেই হয়তো।
এমন পরিস্থিতিতে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের (ডিএসএ) এই যুগে যখন একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস লিখে পোস্ট করতেও আমাদের ভয় হয়, তেমনই বাস্তবতার প্রতিবেশে আশফাক নিপুণ এমন একটি সিরিজ বানিয়ে ফেলেন মাত্র ২৪ দিনের শ্যুটিংয়ে। আর ঈদের আনন্দের মাঝেই আমাদের আবার মনে করিয়ে দেন চলমান বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার কথকতা। তাই নির্দ্বিধায় তাকে অসম্ভব সাহসী হিসেবে অভিহিত না করার কোনো কারণ নেই।
তবে মনে রাখতে হবে, 'সিস্টেমের ভূত' তাড়াতে সুপার হিরোর আবির্ভাব কোনো সমাধান নয়। আসলে এটা অনেকটা ফাঁদের মতোই। সম্মিলিতভাবে সমস্যা সমাধানের থেকে গণমানুষ কোনো আইকনের বা সুপারহিরোর পুজা বা সেলিব্রেশনে বুঁদ হয়ে থাকুক এটাই আদতে ক্ষমতাতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা। ফলে মাঝে মাঝে 'আঙ্গুল বাঁকা করা', বা 'নিজেই সিস্টেমের ভূত হয়ে ওঠা' ওসি হারুন দুটো সিজন এবং ১৭টা পর্বজুড়ে বিবিধ আচরণের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেন যে, সরল মানুষের জন্য এই মহানগর নয়। ফলে মহানগরে টিকতে হলে তারই মতো ধূর্ত হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। তাই মলয়ের সারল্যকে (সিজন ১) তিনি কটাক্ষ করেন আর মাসুমকে (সিজন ২) বলেন শহর ছেড়ে চলে যেতে অন্য কোথাও। মাসুমও চলে যান শহর ছেড়ে। আরও গুরুত্বপূর্ণ আলাপ হলো, সিস্টেমের ভূত নিয়ে অনেক কথা বললেও, আশফাক নিপুণের ওসি হারুন খোদ সিস্টেম নিয়ে কোনো আলাপ করেন না। মনে হতে থাকে, প্রবল ক্ষমতাতন্ত্রের বাহক এই সিস্টেমটার মাঝে কোনো গলদ নেই, বরং গলদ এর ভূতদের মধ্যেই নিহিত; যেন এই ভূতদের হারাতে পারলেই জিতে যাবে মানুষ।
এখানে বলে নেওয়া দরকার, বর্তমানে দেশি চলচ্চিত্র, সিরিজ এবং ভিজ্যুয়াল কন্টেন্ট নির্মাণের বিষয়বস্তু লক্ষ্য করলে দেখা যায়- পুলিশ, জেল, কারাগার এগুলোর অতি গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। কন্টেন্টগুলোর একটি বড় অংশ হয় কপ থ্রিলার। নাহলে এক পর্যায়ে এসে বাঁক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পুলিশি অনুপ্রবেশ ছাড়া সিরিজগুলো আর পূর্ণতা পাচ্ছে না। সেখানে পুলিশ অবশ্যম্ভাবীভাবে ইতিবাচক চরিত্র, নায়ক অথবা প্রটাগনিস্ট হিসেবে আবির্ভূত হয়। ইমতিয়াজ সজীবের রিফিউজি (২০২২) মোস্তফা সারয়ার ফারুকীর লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলম্যান (২০২২) সৈয়দ আহমেদ শাওকীর কারাগার (২০২২), তানিম নূরের কাইজার (২০২২), শিহাব শাহীনের আগস্ট ২৪ (২০২০) সহ এমন আরও অনেক সিরিজ এর গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হতে পারে। অথবা অন্য যেকোনো ফিকশনও- যেমন নিখাদ প্রেমের গল্পও আমাদের সামনে হাজির হতে থাকে কারাগার বা থানার ফ্রেম থেকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে পরাণ (২০২২) এর কথা। মূলত ২০১৫ সালে ঢাকা অ্যাটাক এর মধ্য দিয়েই ভিজ্যুয়াল কন্টেন্ট নির্মাণের এই ধরনের বাঁকবদল ঘটে। পরবর্তীতে মিশন এক্সট্রিম ১ (২০২১),মিশন এক্সট্রিম ২ (২০২৩), অপারেশন সুন্দরবন (২০২২) দিন-দ্যা ডে (২০২২) সহ আরও অনেক চলচ্চিত্র এই পরম্পরাকে আরও পোক্ত করে। মেধাবী নির্মাতাদের একটা বড় অংশ জ্ঞাতে অথবা অজ্ঞাতে নিজেদের কন্টেন্টে পুলিশি পৌরুষ নির্মাণের পরম্পরায় নিজেদের যুক্ত করতে থাকেন। পাঠক একাধারে দৈনিক সংবাদপত্রে জেল এবং পুলিশের ইমেজ নির্মাণের বিপরীতে দাঁড়িয়ে চলচ্চিত্র এবং ফিকশনাল জগতে পুলিশি পৌরুষ নির্মাণ হতে দেখেন। তবে এই যে পুরো পরম্পরা, সেখানে আশফাক নিপুণের মহানগর সিরিজ ব্যত্যয় ঘটানোর সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়। ওসি হারুন সেখানে রহস্যময়তার জাল বোনেন এবং দর্শক সেখানে আটকে পড়েন তার চরিত্রের পোস্টমর্টেমের সন্ধানে। তবে এই রহস্য ঘনীভূত হওয়ার আগেই দ্বিতীয় সিরিজে ওসি হারুন তার রহস্যময়তা হারান এবং সমসাময়িক অন্যান্য সিরিজের পুলিশ চরিত্রগুলোর মতোই নায়োকোচিত ভঙ্গিতে হাজির হন এবং বলতে থাকেন- 'হারুনরা এত সহজে হারে না'।
বলা বাহুল্য, আশফাক নিপুণ নিঃসন্দেহে বর্তমান সময়কে ছাড়িয়ে আরও দূরে কাজ করবেন। কাস্টিং বা চরিত্র নির্বাচনে নিপুণের মুনশিয়ানা আছে ষোলআনা। কুমিল্লার সেই সিএনজি ড্রাইভার থেকে আফনান চৌধুরী, মেয়র রাশেদা খানম (আফসানা মিমি), মাসুম ( দিব্য জ্যোতি), মিতুসহ (তানজিকা আমিন) সবাই নিজ চরিত্রের সঙ্গে মানিয়ে গেছেন। একথা বললে বাড়াবাড়ি হবে না যে, ওসি হারুন চরিত্রের জন্য মোশাররফ করিমের চেয়ে ভালো অভিনয় আর কারো পক্ষে সম্ভব হতো না। এমনকি তার অভিনয়ের পাশে মাঝে মাঝে ফজলুর রহমান বাবুর মত পোড় খাওয়া অভিনেতাকেও ম্রিয়মাণ বলে মনে হতে থাকে। ওসি হারুনের পর এই চলচ্চিত্রের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো এর মিউজিক স্কোর, ইন্ট্রো এবং অবশ্যই এর অসাধারণ দুটি সেট। পরিচালকের জবানিতেই জানতে পারি, গারবেজ সরিয়ে পুরান ঢাকার শাখারীপুর থানা এবং গোপন গোয়েন্দা সংস্থার সেট দুটি তিনি এমনভাবে তৈরি করিয়েছেন যেন চলচ্চিত্রের পরিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে তা চরিত্র হিসেবে হাজির হয়। হয়েছেও তাই। প্রত্যেকবারই সেট দুটিকে রিয়েল লোকেশন হিসেবে ভ্রম হয়। এছাড়া দুটি গল্প সমান্তরালে বলতে দুটি টাইমজোন; অর্থাৎ শীত এবং গরমকালের প্লটগুলোর প্রতিস্থাপনে আশফাক নিপুণ অবশ্যই মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। তবে দ্বিতীয় সিজনের প্রথম ছয়টা পর্বের যে মন্থরতা (খারাপ সময়ের মন্থরগতি বোঝাতে সিরিজের এই ধীরগতি প্রাসঙ্গিক বলেই মনে হয়), তা শেষের তিন পর্বে পাওয়া যায় না।
আবার শেষে এসে যেন খুব দ্রুত সব সমাধানের তাগিদ অনুভব করেছিলেন নিপুণ। জানা যায়, প্রথম সিজন শেষ করার সময় পরিচালক দ্বিতীয় সিজন মাথায় রাখেননি। হয়তো সেজন্যই বেশ কয়েকটা প্লটহোলও চোখে পড়েছে। প্রথম সিজনের শেষে সকালে মুখ খোলা অবস্থায় কতোয়ালি থানা থেকে হারুনকে ইউনিফর্মড পুলিশ তুলে নিলেও দ্বিতীয় সিজনে তার আবির্ভাব ঘটে মুখ বাধা অবস্থায়। সাদা পোশাকের অতি ক্ষমতাধর আরেকদল বাহিনীর হাতে, এবং সেটা রাতে। যদিও 'সাদা মাইক্রোবাসে'র কন্টিনিউটিতে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। পরবর্তী সিজনে এই বিষয়গুলো তিনি আরও খেয়ালে রাখবেন আশা করি। আশফাক নিপুণের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে জানতে পারি, একদম সংলাপনির্ভর এই সিরিজটির সংলাপগুলো সেটে বসেই লিখেছেন তিনি। এখানে আরও একটু বেশি সময় বরাদ্দ করতে পারেন নিপুণ। তাহলে হয়তো বড় কর্মকর্তা দিন মোহাম্মদ বাবরের (ফজলুর রহমান বাবু) ধাঁধাগুলো আরও মনোহর হতে পারত।
তবে বলে নেওয়া ভালো, বিগত এক দশকের চলচ্চিত্র এবং সিরিজের বিচারে আশফাক নিপুণের সাবরিনা (২০২২) একটি অনন্য সাধারণ এবং সেরা কাজ হয়ে উঠবার সম্ভাবনা নিয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। রাষ্ট্রের ক্ষত সাবলীল সিনেভাষায় প্রকাশ, করপোরেশনের সঙ্গে রাষ্ট্রসম্পর্ক এবং পুরো বিষয়টাকে সাধারণ মানুষের ফ্রেম থেকে পোট্রে করার মত এমন নিখুঁত কাজ সাম্প্রতিক সময়ে কমই চোখে পড়েছে। খুব সম্ভবত নারীকেন্দ্রিক সিরিজ বলে সাবরিনা মহানগর'র মত এতটা আলোচনায় আসতে পারেনি।
তবে রাষ্ট্র প্রশ্নে আলাপের ক্ষেত্রে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, পুলিশ এর একমাত্র অর্গ্যান নয় এবং প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মকর্তাকে সুপারহিরো বানানোর কৌশলও চলচ্চিত্রের ইতিহাসে পৃথিবীজুড়েই অত্যন্ত আদি প্রবণতা হিসেবে চিহ্নিত। তবু একথা সত্য যে, কারিগরি নৈপুণ্য, সিনেভাষার প্রয়োগ, রাজনৈতিক সচেতনতা এবং গণমানুষের পক্ষে আলাপ করার সাহসের এমন বিরল সম্মিলন বর্তমানের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে আশফাক নিপুণের মধ্যেই দেখা যায়। এই নিরঙ্কুশ নীরবতার জেল-জমানার কালে আশফাক নিপুণ কথা বলতে জানেন। আর ক্ষমতাবিলাসী মানুষের আরাম আরাম সময়টাতে তাদের প্রতিচ্ছবি হাজির করার মধ্য দিয়ে তাদের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ান। এই সময়ে এতটুকুই বা কজন পারেন?
লেখক: শিক্ষক, চলচ্চিত্র সমালোচক
Comments