‘শিল্পী যদি গণমানুষের কথা না বলে গণভবনের কথা বলে, দর্শক তাকে ছুড়ে ফেলতে পারে’

আশফাক নিপুণ। ছবি: শেখ মেহেদি মোরশেদ/স্টার

ন্যায্যদাবির পক্ষে কিংবা অন্যায্যতার বিরুদ্ধে আন্দোলনে দেশের যেসব শিল্পীরা সরব থাকেন, তাদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। আরও সুনির্দিষ্ট করে এসব ক্ষেত্রে সরব থাকা নির্মাতাদের ব্যাপারে বলতে গেলে শুরুর দিকে আসে আশফাক নিপুণের নাম। বিভিন্ন আন্দোলনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত লেখার পাশাপাশি সশরীরেও তাকে দেখা গেছে। সবশেষ কোটা সংস্কারের দাবির আন্দোলন, যেটি পরবর্তীতে রাষ্ট্র সংস্কারের আন্দোলনে পরিণত হলো, সেখানেও শুরু থেকেই দৃঢ় চিত্তে দেখা গেছে এই নির্মাতাকে।

দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শিল্পীর রাজনৈতিক সচেতনতা-দায়, আলোচিত ওয়েব সিরিজ 'মহানগর', শিল্পীর প্রতি প্রত্যাশাসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন আশফাক নিপুণ

দ্য ডেইলি স্টার: একজন শিল্পীর রাজনৈতিক সচেতনতা কেন প্রয়োজন, কতটুকু প্রয়োজন?

আশফাক নিপুন: আমি বিশ্বাস করি সাধারণ মানুষ বা শিল্পী—কেউ রাজনীতির বাইরে না। আপনি যে সময়ের মধ্যে আছেন, যেই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের মধ্যে বাস করছেন—নির্মাতা বা লেখক যে কারো কাজে কিন্তু রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন আসবে।

আবার এটিও ঠিক, সব শিল্পীর মধ্যেই যে রাজনৈতিক সচেতনতা থাকবে, ব্যাপারটি তেমনও নয়। আমি কোনো শিল্পীর মধ্যে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া পক্ষে নই। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি, শোষণ, দমন-পীড়ন দেখে যদি একজন মানুষের ভেতর আপনা-আপনি এই অনুভূতি তৈরি না হয়, তাহলে যতই পড়াশোনা থাক, সেটা আসবে না। এটা নির্ভর করছে ব্যক্তির সংবেদনশীলতার ওপর।

একজন নির্মাতার সুবিধা হলো, তার নির্মাণ করা সিনেমা বা ওয়েব সিরিজ সহজেই বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছায়। সেই কাজে যদি রাজনৈতিক-পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি থাকে, তাহলে সেটার সঙ্গে মানুষ সংযোগ খুঁজে পায়। নির্মাতা হিসেবে ব্যাপারটিতে আমরা তখন আন্দোলিত হই।

আবার এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, অ্যাক্টিভিজম ও আর্ট—এই দুইটার মধ্যে পার্থক্য আছে। সিনেমার মধ্যে রাজনৈতিক চর্চা করতে গিয়ে যদি সেটাই খুব বেশি প্রভাবশালী হয়ে ওঠে, তখন তো আর সিনেমা থাকল না। এই দুইটার মধ্যে যারা সুন্দর ব্যালেন্স করতে পারে, তাদেরই আমরা মহৎ শিল্পী বলি। শিল্পের চেয়ে অ্যাক্টিভিজম বেশি হয়ে গেলে ব্যাপারটা আর শিল্প হয় না। রাজনৈতিক প্রতিচ্ছবির পাশাপাশি শৈল্পিক ব্যাপারটিও যথাযথভাবে থাকতে হবে।

ডেইলি স্টার: অনেক সময় শিল্পের ক্ষেত্রে রাজনীতিকরণ দেখা যায়। শিল্পীর রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাকে কীভাবে দেখেন?

আশফাক নিপুণ: একটা বিষয় স্পষ্ট করে বলি। আমি সব সময় শিল্পীর স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। কেউ যদি প্রপাগান্ডাভিত্তিক সিনেমা বানাতে চায়, সেই স্বাধীনতাও তার আছে। দর্শক তাকে গ্রহণ করবে নাকি ছুঁড়ে ফেলবে, প্রপাগান্ডার অংশ হওয়ার জন্য দর্শক তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে কি না, সেটা সময়ের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।

কেউ ক্ষমতাসীনদের দমন-পীড়ন নিয়ে সিনেমা বানাতে চাইলে সেটারও স্বাধীনতা আছে। তবে, যে ক্ষমতাসীনের বিরুদ্ধে সিনেমা বানাবে, তাকে যেমন সামনে বিপদে পড়তে হতে পারে, তেমনি যিনি প্রপাগান্ডাভিত্তিক সিনেমা বানাবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যদি ওই প্রপাগান্ডা না টেকে, সেই দায়ভারও তাকেই নিতে হবে।

ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি যে ক্ষমতা কাঠামো যখন শিল্পকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে, সেটিতে প্রভাবিত না হলে ভালো। শুধু সবশেষ সরকার না, সব সরকারের আমলেই এমনটি হয়েছে। তারা শিল্পীদের মাউথপিস হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। কারণ শিল্পীদের গ্রহণযোগ্যতা সর্বব্যাপী।

সাম্প্রতিক সময়ের দিকে তাকালেই দেখা যাবে যে, যারা বিগত সরকারের সময় সুবিধাভোগী ছিলেন, সরকারের প্রপাগান্ডা বাস্তবায়নে যাদের সংশ্লিষ্টতা ছিল, দর্শকরা কীভাবে তাদের ছুঁড়ে ফেলেছে। সুতরাং ওই দায় তাদেরকেই নিতে হবে।

ডেইলি স্টার: আপনিও তো একজন দর্শক। সেই জায়গা থেকে 'মহানগর'কে কীভাবে দেখছেন?

আশফাক নিপুণ: আমার জন্য দর্শকের দৃষ্টিকোণ থেকে 'মহানগর' নিয়ে বলা কিছুটা কঠিন। কারণ গল্পের প্লট, চরিত্রগুলো আমারই নির্মাণ করা।

এই কাজের মধ্যে দিয়ে পুলিশি ও রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের কথা বলা হয়েছে। নির্মাতা হিসেবে সেই বিষয়টি ফুটিয়ে তোলার একটা তাড়না ছিল। দর্শক হিসেবে কীভাবে দেখছি, সেভাবে না বলে কাজটির সঙ্গে কী পরিমাণ মানুষের সংযোগ তৈরি হচ্ছে, সেটা দেখা যেতে পারে। মানুষ রিলেট করতে পারছে কি না। এখন মহানগরকে একভাবে দেখা হচ্ছে। ১০ বছর পর গিয়ে হয়তো অন্যভাবে দেখবে। আসলে পুরো ব্যাপারটি সময়ের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভালো।

ছবি: শেখ মেহেদি মোরশেদ/স্টার

ডেইলি স্টার: দর্শকদের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে যে, মহানগরের মতো কাজ আরও কেন হচ্ছে না। অন্যরাও কেন এই ধরনের কাজ নির্মাণ করছেন না। আপনি কী মনে করছেন?

আশফাক নিপুণ: এই ধরনের কাজ তৈরির তাড়না নির্মাতাদের নেই, বিষয়টি এমন নয়। হ্যাঁ, সবাই বলছে এইরকম কাজ আরও হওয়া উচিত। তবে দিনশেষে ব্যাপারটি আমি পুরোপুরি নির্মাতাদের ওপর ছেড়ে দিতে চাই। আমি একটি রাজনৈতিক সিনেমা বানাব—বিষয়টি আসলে সেভাবে হয় না। মহানগরের ক্ষেত্রেও সেরকম কোনো পরিকল্পনা করে বানাইনি। এটা এক ধরনের তাড়না থেকে চলে এসেছে।

ডেইলি স্টার: মহানগরের মতো ওয়েব সিরিজ নির্মাণের কারণে হয়রানির কথা শুনেছি। যখন এই রকম একটা কাজের কথা ভেবেছিলেন, অভিনেতা বা কলাকুশলীদের কেউ কাজ করবে না বলে জানিয়েছিলেন?

আশফাক নিপুণ: গল্পটা নিয়ে যখন আলোচনা করেছি, কেউই না করেননি। গল্পের ক্ষেত্রে আমি যাদের কথা ভেবেছি, তাদের সবাইকে নিয়েই কাজ করতে পেরেছি। মহানগর-২ এর বেলাতেও তাই হয়েছে। সেক্ষেত্রে আমি খুব সৌভাগ্যবান। অভিনেতা-প্রযোজকসহ কলাকুশলীরা সবাই আগ্রহ নিয়ে কাজটি করেছেন। মহানগর নির্মাণের কারণে শুধু আমাকেই হয়রানির শিকার হতে হয়নি, অভিনেতাদেরও ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। কিন্তু এরপরেও তারা বলেননি যে মহানগর-২ এ অভিনয় করবেন না। বরং সবাই আগ্রহের সঙ্গে কাজটা করেছেন। প্রচারিত প্ল্যাটফর্মের পক্ষ থেকেও সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ছিল।

ডেইলি স্টার: মহানগরের আইকনিক চরিত্র ওসি হারুন। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন মোশাররফ করিম। তার কথা কেন মাথায় এলো?

আশফাক নিপুণ: আমি যখন মহানগরের গল্প নিয়ে ভাবা শুরু করি, এই চরিত্র করার জন্য পারফেক্ট হিসেবে মোশাররফ করিমকে ছাড়া আর কাউকে দেখিনি। এই চরিত্রটি কিন্তু সাধারণ কোনো চরিত্র নয়। তার মধ্যে দ্বিচারিতা আছে। সে মুখে বলছে একটা, কিন্তু হয়তো মনে চলছে আরেকটা বিষয়। ওসি হারুন কাঠখোট্টা কিংবা একেবারে প্লেইন অ্যান্ড বোরিং কোনো পুলিশ অফিসার না। তার মধ্যে প্রচুর রসবোধ আছে। সব মিলিয়ে ওই চরিত্র করার জন্য আমার আর কাউকেই উপযুক্ত মনে হয়নি। মোশাররফ করিম যে শুধু থিয়েটার ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছেন, তা নয়। তিনি গণমানুষের শিল্পী। সে কারণে সবাই তাকে আপন ভাবে। ওই চরিত্র করার জন্য যে সংবেদনশীলতা থাকা দরকার, সেটাও তার মধ্যে আছে। মোশাররফ করিম যেভাবে চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলেছেন, আমার মনে হয় না অন্য কেউ এভাবে পারত।

তার প্রতি আমার যে বিশ্বাস-প্রত্যাশা ছিল, সেটা তিনি পূরণ করেছেন। যেমন: ওসি হারুনের 'দুইটা কথা মনে রাখবেন' যে সংলাপটা বিখ্যাত হলো, সেটা লিখেছি আমি। কিন্তু তিনি যেভাবে বলেছেন, সেটা তো অনবদ্য।

ডেইলি স্টার: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর নতুন বাংলাদেশ পেলাম। এখন রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ চলছে। সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে শিল্পের ওপর সাম্প্রদায়িকতার চাপ পড়তে পারে কি না?

আশফাক নিপুণ: শিল্পী হিসেবে আমরা সবসময় একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা বলে এসেছি। সাম্প্রদায়িকতার ঝুঁকি ৫০ বছর আগে থেকেই ছিল। যেই সরকারই আসুক না কেন, এই লড়াই আমাদের মধ্যে সবসময়ই ছিল। আমরা দেখেছি যে, ২০০১ সালে জেএমবির উত্থান হলো, ছায়ানটে হামলা হলো। কিন্তু সেখান থেকে আমরা ফাইট করেছি এবং এই সংগ্রাম শেষ হয়ে যাবে না, সবসময় থাকবে।

ডেইলি স্টার: আন্দোলনের পক্ষ-বিপক্ষে শিল্পীদের অবস্থান নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। অনেককে সুবিধাবাদীও বলা হচ্ছে। আন্দোলনে না থেকেও কেউ কেউ এখন পক্ষে কথা বলছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

আশফাক নিপুণ: বিষয়টি দুইভাবে দেখা যায়। প্রথমত, কেউ হয়তো আগে সরকারের সুবিধাভোগী ছিল। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতির পর এখন হয়তো তার বিবেক জাগ্রত হয়েছে। যে গণহত্যা হয়েছে, সেটি দেখে সে হয়তো আগের অবস্থানে আর নেই। দ্বিতীয়ত, যখন আপনি দেখলেন অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে নৌকা থেকে নেমে গেলেন এবং তীরে আসার চেষ্টা করছেন।

আসলে শিল্পী সমাজের দিকে তো মানুষ তাকিয়ে থাকে। তাদের মাধ্যমে অনেকেই প্রভাবিত-অনুপ্রাণিত হয়। আমি বলব, দর্শকদের বোঝা দরকার কোন শিল্পী মানুষের কথা বলে, আর কোন শিল্পী ক্ষমতার কথা বলে। দর্শকরাই এটি ঠিক করে। তরুণরাও এটা বোঝে। শিল্পীর যেখানে গণমানুষের কথা বলা উচিত, কিন্তু এর পরিবর্তে কেউ যদি গণভবনের কথা বলে, তাহলে দর্শক তাদের ওই কাতার থেকে ফেলে দেবে। এবারের আন্দোলনে ব্যাপারটি আরও স্পষ্ট হয়েছে।

মানুষকে বোকা ভাবলে হবে না। দেশের মানুষ কিন্তু কোনো শিল্পীর ডাকের জন্য বসে ছিল না যে, সে ডাক দিলে রাস্তায় নামবে। তারা রাস্তায় নেমে গেছে। অপেক্ষা করেনি তার পছন্দের শিল্পী বা আইডলের ডাকের জন্য। এখান থেকেও আসলে শিল্পী সমাজের শিক্ষা নেওয়ার বিষয় আছে যে, আপনি মানুষের সঙ্গে থাকলে মানুষ আপনার সঙ্গে থাকবে। না হয় ছুড়ে ফেলে দেবে।

Comments

The Daily Star  | English

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

2h ago