ঢালাও আইপিও অনুমোদন পুঁজিবাজারে ‘বোঝা’ তৈরি করছে
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা গত ১৪ বছরে ১২৭ প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্তি অনুমোদন করেছে। এর মাধ্যমে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে পাবলিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। কিন্তু, এরা পুঁজিবাজারের জন্য ভালো ফল বয়ে আনতে পারেনি। কারণ এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগেরই তালিকাভুক্ত হওয়ার পর মুনাফা করার সক্ষমতা কমেছে।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পাবলিক প্রতিষ্ঠান হওয়ার পর সেগুলো 'বোঝায়' পরিণত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, গত ১৪ বছরে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে তালিকাভুক্ত অনেক প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের কাজ করছে।
গত ১৪ বছরে অনুমোদিত ১২৭ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে 'এ' ক্যাটাগরিতে আছে মাত্র ৫২টি, 'বি' ক্যাটাগরিতে ৪৩টি। এ ছাড়াও, ৩২টি প্রতিষ্ঠানকে 'জেড' ক্যাটাগরিতে নামিয়ে আনা হয়েছে।
অর্থাৎ, তালিকাভুক্তির পর ৪০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান 'এ' ক্যাটাগরির মর্যাদা ধরে রেখেছে এবং ৬০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান তা পারেনি।
কোনো প্রতিষ্ঠান ১০ শতাংশের কম বার্ষিক লভ্যাংশ দিলে তাকে 'বি' ক্যাটাগরি ধরা হয়। 'এ' ক্যাটাগরির প্রতিষ্ঠানকে কমপক্ষে ১০ শতাংশ হারে লভ্যাংশ দিতে হয়।
কোনো প্রতিষ্ঠান পরপর দুই বছর লভ্যাংশ দিতে না পারলে 'জেড' ক্যাটাগরিতে নামিয়ে দেওয়া হয়।
'জেড' ক্যাটাগরিতে নেমে যাওয়ার কারণগুলোর মধ্যে আছে—নিয়মিত বার্ষিক সাধারণ সভা আয়োজনে ব্যর্থ হওয়া, ছয় মাসের জন্য উৎপাদন বন্ধ রাখা বা প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধিত মূলধনের চেয়ে সঞ্চিত লোকসানের পরিমাণ বেশি হওয়া।
এ ছাড়াও, কোনো প্রতিষ্ঠান ঘোষিত লভ্যাংশের অন্তত ৮০ শতাংশ পরিশোধে ব্যর্থ হলে তাকে 'জেড' ক্যাটাগরির বলে গণ্য করা হয়।
সরকারি তথ্য অনুসারে, ২০১১ সালে 'জেড' ক্যাটাগরি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের সংখ্যা ছিল মোট ইস্যু করা শেয়ারের প্রায় আট শতাংশ। চলতি বছর তা হয়েছে ১০ শতাংশের বেশি।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আর্থিক লেনদেন বিশ্লেষণ করে ডিএসই প্রায় ৭০ শতাংশ আইপিও প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।'
তার মতে, বিশ্বব্যাপী স্টক এক্সচেঞ্জগুলো সাধারণত বাজার নিয়ন্ত্রকদের সম্পৃক্ততা ছাড়াই প্রতিষ্ঠানকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করে। দেশে তালিকাভুক্তি প্রক্রিয়ায় বিএসইসির অতিরিক্ত জড়িত থাকার ভূমিকা এই নিয়মে বিচ্যুতি ঘটিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, 'গত ১৪ বছরে আইপিও অনুমোদন পাওয়ার সুবিধার্থে এসব প্রতিষ্ঠান অনেক সময় অনেক সরকারি সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের অন্যায্য সুবিধা দিয়েছে।'
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, 'বেশি দামে কোরবানির পশু কিনে ও পরে চাকরি হারানোয় শিরোনাম হওয়া সাবেক শীর্ষ কর কর্মকর্তা মতিউর রহমান টাকা না দিয়ে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়েছিলেন। এটি অবশ্যই এসব কোম্পানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।'
এ ধরনের কাজ নতুন তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে দেয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। তার মতে, 'পুঁজিবাজার এখন "প্রতিবন্ধী প্রতিষ্ঠানে" ভরে গেছে। ফলে সার্বিকভাবে পুঁজিবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।'
ডিএসইর সাবেক এই পরিচালক মনে করেন, এমনকি যেসব প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়ামে শেয়ার বিক্রি করেছে তাদেরও পারফরম্যান্স ভালো না।
যখন কোনো কোম্পানির অভিহিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে শেয়ার বিক্রি করা হয়, সেই অতিরিক্ত দামকে প্রিমিয়াম বলে। কোনো প্রতিষ্ঠান ভালো বলে বিবেচিত হলে সে কোম্পানির শেয়ার প্রিমিয়ামে বিক্রি করার অনুমোদন দেওয়া হয়।
উল্লেখিত সময়ে ৫১ প্রতিষ্ঠানকে প্রিমিয়াম ইস্যু করতে দেওয়া হয়। এর মধ্যে কয়েকটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা নির্ধারণ করে। কিছু ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নিলামের মাধ্যমে প্রিমিয়াম নির্ধারণ করা হয়।
এর মধ্যে ৩০ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম পরবর্তীকালে প্রিমিয়াম দামের নিচে নেমে আসে। সবচেয়ে ক্ষতিকর বিষয় হলো—অ্যাপোলো ইস্পাত, রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড (আরএসআরএম), রিজেন্ট টেক্সটাইল, জাহিনটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ ও জিবিবি পাওয়ারের শেয়ার 'জেড ক্যাটাগরিতে' পরিণত হয়েছে।
'প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে যেকোনো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থার অবনতি হতে পারে', উল্লেখ করে ইমন বলেন, 'তবে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই দুর্বল হয়ে পড়েছে নিজেদের কর্মকাণ্ডের কারণে।'
প্রায় ১৪ বছরে তালিকাভুক্ত হয়েছে একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান রবি আজিয়াটা ও একটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবলস পিএলসি।
পুঁজিবাজারে আসতে ভালো প্রতিষ্ঠানের অনীহা প্রসঙ্গে প্রাইম ব্যাংক সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তালিকাভুক্ত নয় এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর রিপোর্টিং ও রেগুলেটরি বাধ্যবাধকতা কম। তারা আরও সহজে ব্যাংক ঋণ পেতে পারে।'
'তাহলে তারা কেন পুঁজিবাজারে আসবেন?' প্রশ্ন তুলে তিনি আরও বলেন, 'অধিকাংশ ক্ষেত্রে যাদের আর্থিক অসচ্ছলতা আছে এবং ব্যাংক ঋণ নিতে পারছেন না, তারাই পুঁজিবাজারের দিকে ঝুঁকেন।'
তিনি আরও বলেন, 'এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসিকে একসঙ্গে বসা উচিত। তালিকাভুক্ত না হলে কোনো প্রতিষ্ঠান ব্যাংক ঋণ পাবে না উল্লেখ করে নীতি প্রণয়ন করতে হবে।'
এ ছাড়া নির্দিষ্ট মুনাফার সীমা অতিক্রমকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্যতামূলক তালিকাভুক্ত হতে বা উচ্চহারে কর দিতে বাধ্য করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
প্রাইম ব্যাংক সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মতে, তালিকাভুক্ত নয় এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনসাধারণের কাছে আসতে উৎসাহিত করতে কর ফাঁকির সুযোগ বন্ধ করতে হবে। এর বিরুদ্ধে প্রচেষ্টা জোরদার করে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কম করের ব্যবস্থা আকর্ষণীয় হতে পারে।
এই নীতিগুলো কার্যকর হলেও বিনিয়োগকারীদের সতর্ক থাকতে হবে। দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোর আইপিও এড়িয়ে যেতে হবে।
নিম্নমানের প্রতিষ্ঠানকে পুঁজিবাজারে আনার ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংক কর্মকর্তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাজেদা খাতুন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শুধু কাগজপত্রের ভিত্তিতে ম্যানেজাররা এগুলো ইস্যু করেন। তালিকাভুক্তির পর তারা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নজরদারি করেন না।'
তিনি আরও বলেন, 'ইস্যু ম্যানেজাররা আইপিওর পর প্রতিষ্ঠানগুলোর পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করতে পারেন না। নিরীক্ষকসহ সব অংশীজনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।'
বাংলাদেশে অনেক ভালো দেশি ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান থাকলেও তারা পুঁজিবাজারে আসতে আগ্রহী নয়। এ বিষয়ে মাজেদা খাতুন বলেন, 'বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে আসতে চায় না কারণ তারা মনে করে যে এটি তাদের জন্য সমস্যা তৈরি করতে পারে।'
অন্যদিকে, তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত প্রতিষ্ঠানের কর-ব্যবধান বেড়ে যাওয়ার পরিবর্তে কমেছে। বর্তমানে করপোরেট করের ব্যবধান পাঁচ শতাংশ পয়েন্ট। কয়েক বছর আগে ছিল ১০ শতাংশ পয়েন্ট।
Comments