লাখে কত টাকা কমল সঞ্চয়পত্রের মুনাফা
সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমিয়েছে সরকার। আগামী ছয় মাসের জন্য নতুন হার কার্যকর থাকবে। সাধারণত বাংলাদেশে বিনিয়োগের জনপ্রিয় মাধ্যম হলো সঞ্চয়পত্র। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য। দেশের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর আয়ের একটি অংশ আসে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা থেকে। তাই সরকার হঠাৎ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমানোয় মধ্যবিত্তের ওপর কী প্রভাব পড়বে?
কয়েক বছর ধরে দেশের অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি অব্যাহত আছে। যার সবচেয়ে বড় ধাক্কা পড়েছে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ওপর। ফলে তারা সংসারের খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছেন, ভোগব্যয় কমিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তাদের ক্রয় ক্ষমতাও কমেছে। আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াইয়ে অনেক পরিবারের ভরসা ছিল সঞ্চয়পত্র। বাড়তি খরচ যোগাতে কেউ কেউ সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে অর্থের যোগান দিয়েছেন।
ফলে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমানোর সিদ্ধান্ত তাদের জন্য আরেকটি ধাক্কা হয়ে এলো। বিশেষ যেসব পরিবারের একটি নির্দিষ্ট অংশ সঞ্চয়পত্রের মুনাফা থেকে আসত, তাদের ওপর আরও চাপ বাড়বে। তাই উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ধুঁকতে থাকা পরিবারগুলো ভোগব্যয় আরও কমাতে বাধ্য হবে।
এখন প্রশ্ন হলো, নতুন হার কার্যকর হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা কেমন মুনাফা পাবেন?
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, আগামী ছয় মাস সঞ্চয়পত্রের সর্বোচ্চ সুদহার হবে ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন সুদহার হবে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, যাদের বিনিয়োগ কম তারা তুলনামূলকভাবে বেশি মুনাফা পাবেন। অন্যদিকে যাদের বিনিয়োগ বেশি, তারা সুদ কম পাবেন।
নতুন হারের জন্য বিনিয়োগ সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্রে কারো বিনিয়োগ যদি ৭ লাখ ৫০ টাকার কম হয়, তাহলে তিনি তুলনামূলকভাবে বেশি মুনাফা পাবেন। বিপরীতে কারো বিনিয়োগ ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি হলে মুনাফা কমে আসবে।
সার্বিক দিক বিবেচনা করা হলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে মুনাফার হার প্রতি লাখে ৫৭ টাকার মতো কমানো হয়েছে।
তবে যারা ইতোমধ্যে বিভিন্ন সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে রেখেছেন, অর্থাৎ ১ জুলাইয়ের আগে বিনিয়োগ করেছেন তারা আগের হারে মুনাফা পাবেন। নতুন হার কেবল ১ তারিখ থেকে যারা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করবেন তাদের জন্য প্রযোজ্য হবে।
অন্যদিকে কেউ যদি পুনর্বিনিয়োগ করেন, তার ক্ষেত্রে যখন পুনর্বিনিয়োগ করবেন তখনকার মুনাফা হার প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ কেউ যদি এই মুহূর্তে পুনর্বিনিয়োগ করেন তাহলে তিনি কম হারে মুনাফা পাবেন।
বাংলাদেশে কয়েক ধরনের সঞ্চয়পত্র আছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো পরিবার সঞ্চয়পত্র। এ সঞ্চয়পত্রে এত দিন সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগে পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্তিতে মুনাফার হার ছিল সাড়ে ১২ শতাংশ। এখন তা কমিয়ে করা হয়েছে ১১ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আর সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ, সেটা কমিয়ে ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ করা হয়েছে।
আগে কেউ পারিবারিক সঞ্চয়পত্রে ১ লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে মুনাফা পেত ১২ হাজার ৫০০ টাকা। তবে এখন পাবেন ১১ হাজার ৯৩০ টাকা। অর্থাৎ এখন থেকে নতুন বিনিয়োগকারীরা প্রতি লাখে ৫৭০ টাকার মতো কম মুনাফা পাবেন।
আরেক ধরনের সঞ্চয়পত্র হলো পেনশনার সঞ্চয়পত্র। এটাতে সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগে পঞ্চম বছর শেষে, অর্থাৎ মেয়াদ পূর্তিতে মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এখন তা করা হয়েছে ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশ। সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এখন থেকে তা ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ করা হয়েছে।
পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ১ লাখ টাকা বিনিয়োগ আগে পাওয়া যেত ১২ হাজার ৫৫০ টাকা। এখন পাওয়া যাবে ১১ হাজার ৯৮০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি লাখে মুনাফা কমেছে ৫৭০ টাকা।
পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হারও কমানো হয়েছে। এ সঞ্চয়পত্রে সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগে মেয়াদ পূর্তিতে মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ৪০ শতাংশ, এখন থেকে তা হবে ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ, এখন থেকে তা হবে ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ।
পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে আগে ১ লাখ টাকায় মুনাফা পাওয়া যেত ১২ হাজার ৪০০ টাকা, এখন পাওয়া যাবে ১১ হাজার ৮৩০ টাকা।
এছাড়া তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফাও কমবে। এ সঞ্চয়পত্রে সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মেয়াদ পূর্তিতে মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ, এখন থেকে তা হবে ১১ দশমিক ৮২ শতাংশ। সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ, এখন থেকে তা হবে ১১ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের আগে ১ লাখ টাকা বিনিয়োগে আগে মুনাফা পাওয়া যেত ১২ হাজার ৩০০ টাকা, তবে এখন পাওয়া যাবে ১১ হাজার ৮২০ টাকা। অর্থাৎ মুনাফা কমেছে ৪৮০ টাকা।
এর বাইরে ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকে মেয়াদি হিসাবেও মুনাফার হার কমিয়েছে সরকার। তিন বছর মেয়াদ পূর্ণ হলে এবং সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগে ডাকঘর সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ, এখন থেকে তা হবে ১১ দশমিক ৮২ শতাংশ। সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ হার ছিল ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ, এখন থেকে তা হবে ১১ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের আগে ১ লাখ টাকা বিনিয়োগে আগে মুনাফা পাওয়া যেত ১২ হাজার ৩০০ টাকা, তবে এখন পাওয়া যাবে ১১ হাজার ৮২০ টাকা। অর্থাৎ মুনাফা কমেছে ৪৮০ টাকা।
অবশ্য, জাতীয় সঞ্চয় স্কিমের আওতায় ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড, ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড, ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডের মুনাফার হার অপরিবর্তিত থাকবে।
প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন দেওয়ার সময় কিছু শর্ত দিয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি ছিল, সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ কমাতে হবে। মূলত সঞ্চয়পত্রের জন্য দেওয়া সরকারের সুদ ব্যয় কমাতে এই শর্ত দিয়েছিল আইএমএফ।
Comments