‘জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে আওয়ামী লীগ মিথ্যাচার করেছে, রাজনীতি করেছে’

জিডিপি প্রবৃদ্ধি
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। ফাইল ফটো

বিগত আওয়ামী লীগ সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে পরিসংখ্যান দেখিয়েছিল তা সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রস্তুতি কমিটির সভাপতি ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

আর্থিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারবিষয়ক আলোচনার অংশ হিসেবে 'অ্যাকশনেবল ফিন্যানসিয়াল অ্যান্ড ইকোনোমিক পলিসিজ ফর অ্যান ইনক্লুসিভ, ইক্যুইটেবল অ্যান্ড প্রোসপারিওস বাংলাদেশ' শীর্ষক প্লেনারি সেশনে সিপিডি ফেলো বলেন, 'বড় সমস্যা হচ্ছে প্রবৃদ্ধির হিসাবটি মিথ্যা।'

'প্রবৃদ্ধির তথ্যে গুরুতর সমস্যা এবং তথ্য ও তথ্যের রাজনীতিকরণ ছিল' উল্লেখ করে দেবপ্রিয় আরও বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরে প্রবৃদ্ধির যে চিত্র দেখানো হয়েছে তা বিশ্লেষণ করা না হলে সংস্কার নিয়ে এগিয়ে যাওয়া কঠিন হবে।'

গতকাল শনিবার ঢাকায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে কী ধরনের অর্থনীতি পেয়েছে তা দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য স্পষ্ট করার চেষ্টা করেন।

গত কয়েক বছর ধরে ৬-৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে কথা বলা হয়েছে, তা কেন সঠিক নয়, তার ব্যাখ্যা দিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, 'গত ১০ বছর ধরে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ২৩ শতাংশ। বেসরকারি বিনিয়োগ ছাড়াই জিডিপি বাড়ছিল। সরকারি বিনিয়োগ ছিল ছয় থেকে আট শতাংশ।'

অন্যদিকে, জিডিপি বেশি থাকলেও কর-জিডিপি অনুপাত বাড়েনি। এটি আটকে আছে ৮-৯ শতাংশে।

'তাহলে টাকা গেল কোথায়?' প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, 'হয় তা যথাযথভাবে আদায় হয়নি, নয়তো পুরোপুরি নেটওয়ার্কের বাইরে ছিল। অথবা দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।'

যেটুকু টাকা ছিল তা দৃশ্যমান উন্নয়ন সূচকে বরাদ্দ করা হয়। এটি আন্তঃখাতের ভারসাম্যহীনতা তৈরি করেছিল। এ কারণে স্বাস্থ্য, সামাজিক উন্নয়ন, সামাজিক সুরক্ষা ও মানব উন্নয়ন উপেক্ষিত ছিল বলে মনে করেন তিনি।

'নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া সত্ত্বেও জিডিপির মাত্র এক শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে ও দুই শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তাও পুরোপুরি কাজে লাগানো যায়নি। আপনি কি কল্পনা করতে পারেন যে এটি কতটা কলঙ্কজনক?'

প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান ঠিক না থাকলে তা সার্বিক উন্নয়নে সমস্যা করে। সেটা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় আসার প্রস্তুতি কিংবা উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের দিকে এগিয়ে যাওয়াই হোক।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, 'আমরা এমনিতেই মধ্যম আয়ের ফাঁদে পড়েছি।'

কেন এটা হলো এর ব্যাখ্যাও দেন তিনি।

আর্থিক খাতকে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে দেবপ্রিয় বলেন, 'রাষ্ট্রের যে সব প্রতিষ্ঠানের উচিত দেশের নাগরিকদের সুবিধা, সুরক্ষা ও পরিষেবা দেওয়া সেগুলো দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।'

দেশে রাজনীতিবিদ ও আমলাদের একাংশ সংস্কারবিরোধী ও দুর্নীতির পক্ষে জোট গড়ে তুলেছে।

'তথাকথিত উন্নয়নের আখ্যান দেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসে বিত্তবানদের উত্থান হিসেবে পরিচিত হবে' বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ধনীরা ব্যাংকিং, জ্বালানি, পুঁজিবাজার ও অবৈধ লেনদেনে প্রভাব ফেলছে। এসব বিত্তশালী ও তাদের ক্ষমতার উৎস নির্মূল করতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে দেশে কোনো সংস্কার হবে না।

আর্থিক ও জ্বালানি খাতকে দেশের ফুসফুস আখ্যা দিয়ে তিনি আরও বলেন, 'এ দুটোই লুট হয়ে গেছে।'

যারা আর্থিক খাতে কারসাজি করেছে তারাও মেগা প্রকল্পের ঠিকাদার হিসেবে কাজ করেছে। 'তারা সবাই একই দলের অংশ।'

ব্যাংকিং খাতে তদারকি ও করপোরেট সুশাসন দুটোই ব্যর্থ হয়েছে।

যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ছিল বিষয়টি দেখভাল করা তারাই আপস করেছিল। বিত্তবানরা তাদের লোকদের মাসিক ভাতা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে রেখেছিল। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিয়েই অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করতে হবে।

আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ মিলে দেশকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।

'দেশ মেরামত করতে না পারলে সংস্কার বাস্তবায়ন করা যাবে না' বলে মনে করেন তিনি।

অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে না পারলে সংস্কার নিয়ে এগোনো কঠিন হবে বলে মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

অনুষ্ঠানে অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'আর্থিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। তা না হলে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না।'

'তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থনীতি অনেকটাই স্থিতিশীল হয়েছে' দাবি করে তিনি আরও বলেন, 'অনেকে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে শ্রীলঙ্কার মতো ডলারের বিনিময় হার ১৮০-২০০ টাকা বা ৪০০ টাকায় উঠবে। এখন তা স্থিতিশীল হয়েছে ১২০ টাকায়। এটি বজায় রাখতে হবে।'

আর্থিক খাতের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করে তিনি বলেন, 'বাইরের কেউ কল্পনাও করতে পারেননি এই খাতে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে।'

এ সময় তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুরের একটি বক্তব্য তুলে ধরে বলেন, 'আমি যেসব দেশে গিয়েছি, তার কোথাও এমন অনিয়ম, নৈরাজ্য ও দুর্নীতি দেখিনি।'

সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, ২০০৯ সালে তিনি যখন বাংলাদেশ ব্যাংক ছেড়েছিলেন তখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার কোটি টাকা।

'এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দেড় লাখ কোটি টাকা। আইএমএফের হিসাব অনুসারে এ সংখ্যা আড়াই লাখ কোটি টাকা। আমাদের অবশ্যই এই সংকট কাটিয়ে উঠতে হবে। জনগণের হতাশ হওয়ার দরকার নেই।'

'অনেক চেক পরিশোধের জন্য সরকার এক মাসে ১৮ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে' জানিয়ে তিনি আরও বলেন, 'কয়েকটি ব্যাংক এখনো আমানতকারীদের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে।'

তিনি বলেন, 'কল্পনা করুন কীভাবে ব্যাংকগুলো লুট করা হয়েছে। আমানতকারীদের টাকার নিরাপত্তার দায়িত্ব আমরা নিয়েছি।'

আর্থিক খাত ধীরে ধীরে মেরামত করা হচ্ছে বলে তা নিয়ে হতাশ হওয়ার কারণ নেই।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির বিষয়ে তিনি সরবরাহ ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীদের ওপর দোষ চাপিয়েছেন।

'হ্যাঁ, মধ্যস্বত্বভোগী দরকার। কিন্তু কেউ চাঁদাবাজ হিসেবে কাজ করে। রাজনীতিতে ঐকমত্যে পৌঁছানো কঠিন হলেও চাঁদাবাজি চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে মোটামুটি সবাই একমত।'

অন্তর্বর্তী সরকার পুঁজিবাজারসহ কয়েকটি ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছে বলেও দাবি করেন তিনি। বলেন, 'সংশোধনের সময় একটু ব্যথা সহ্য করতে হয়।'

এ ছাড়াও, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর নীতিনির্ধারণী ও কর আদায় শাখা আলাদা করার পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি।

সরকার বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক অংশীদারদের কাছ থেকে মোট ছয় থেকে সাত বিলিয়ন ডলার ঋণ নিচ্ছে।

তিনি রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো সুশাসনের অভাবের সমালোচনা করেন। এর মধ্যে অনেকগুলো অব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহিতার অভাবের কারণে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।

আদানিকে দেওয়া কর অবকাশের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, 'সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই ও চড়া সুদে ঋণ নিয়ে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল।'

আদানির সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ কেনার চুক্তির কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'এটা কি আদৌ যথাযথ কোনো চুক্তি?'

কৃত্রিমভাবে টাকার বিনিময় হার কম রাখতে রিজার্ভের ৪২ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১২ বিলিয়ন ডলার বিক্রির জন্য তিনি সাবেক গভর্নরের সমালোচনা করেন।

আগের সরকারের কাছ থেকে 'বোঝা' হিসেবে পাওয়া ভুল নীতি সংশোধন করতে সময় লাগবে বলেও জানান তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Polythene ban: A litmus test for will and eco-innovation

Although Bangladesh became the first country in the world to announce a complete ban on the use of polythene bags in 2002, strict enforcement of the much-lauded initiative has only started taking shape recently.

15h ago