বিডার ওয়ান স্টপ সার্ভিসের নন-স্টপ ভোগান্তি

বিডা, ওএসএস, পরিবেশ অধিদপ্তর, প্রাণ, প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলস, সিকম গ্রুপ, পিএইচপি ফ্যামিলি,
ছবি: সংগৃহীত

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বিভিন্ন সরকারি সংস্থার সেবা পেতে তাদের অবহেলার শিকার হতে হয়। এমনকি অনলাইন থেকে কোনো সেবা পাওয়া যায় না। যে সেবা অনলাইনে দেওয়া সম্ভব, তার জন্য সরকারি সংস্থার অফিসে যেতে হয়। এতে ব্যবসায়ীদের সময় যেমন নষ্ট হয়, তেমনি আর্থিক ভোগান্তিও বাড়ে। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে সরকারি সংস্থাগুলোর সেবায় পরিবর্তনের প্রত্যাশা করছেন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা।

এদিকে বাংলাদেশ গত এক দশক ধরে বিনিয়োগ আকর্ষণ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে নতুন উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সরকারি অফিসের চিরাচরিত অবহেলার অভ্যাস কার্যত অপরিবর্তিত আছে।

এ ধরনের অবহেলার বা বিড়ম্বনার আরেক নাম বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) ওয়ান স্টপ সার্ভিস (ওএসএস) পোর্টাল। মূলত বিনিয়োগকারীদের প্রয়োজনীয় রেগুলেটরি, কমপ্লায়েন্স ও ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস কেন্দ্রীয়করণের মাধ্যমে ব্যবসায়িক প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নে সহায়তা করতে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওএসএস চালু হয়।

বর্তমানে পরিবেশ অধিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই) ও রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস (আরজেএসসি) অফিসসহ ২৯টি বিভাগ থেকে ওএসএসের মাধ্যমে বিডা ১১২টি বিনিয়োগ সেবা প্রদান করছে।

তবে ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন, তারা অনলাইনে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবা নিতে পারছেন না। বিপরীতে প্রয়োজনীয় কাজের জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থার অফিসে যেতে হচ্ছে। যেখানে তাদের চাওয়াগুলো সরকারি কর্মকর্তাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে।

সম্প্রতি ওএসএস থেকে সেবা নিতে আবেদন করেছেন এমন ২০ জনের বেশি ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার। তখন তারা এ অভিযোগ করেন।

প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধা বলেন, 'প্রতি অর্থবছর শুরুর আগে আমরা পরিবেশ অধিদপ্তর, ডিআইএফই ও আরজেএসসি থেকে সব লাইসেন্স ও অন্যান্য সনদ বিডার ওএসএস পোর্টালের মাধ্যমে নবায়নের জন্য আবেদন করি। কিন্তু আমাদের কর্মীদের সেবা নিতে কার্যত সংশ্লিষ্ট অফিসে ছুটতে হয়।'

তিনি আরও জানান, অনলাইনে সেবা দেওয়ার সুযোগ থাকার পরও কর্মকর্তারা বিভিন্ন প্রশ্ন তোলেন এবং কারখানা পরিদর্শন করতে চান।

ইলিয়াছ মৃধা এই ব্যবস্থাকে এলোমেলো আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, তাদের কারণে প্রতি বছর ব্যবসায়ীদের অনেক সময় নষ্ট করতে হয়। বেশিরভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এ ধরনের ঝামেলা এড়াতে একটি আলাদা টিম নিয়োগ দিয়ে থাকে।

প্রাণ গ্রুপের আওতায় ৩০টি কোম্পানি রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রত্যেকটিকে প্রতি বছর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নবায়ন করতে হয়।

প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলস পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিকম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আমিরুল হক অভিযোগ করেন, অনেক সময় 'ঘুষ' না দিলে আরজেএসসি, পরিবেশ অধিদপ্তর বা ডিআইএফই থেকে লাইসেন্স নবায়ন বা ছাড়পত্র পাওয়া যায় না।

সিকম গ্রুপের অধীনে ২৫টি কোম্পানি আছে। মোহাম্মদ আমিরুল হক বলেন, 'সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করার জন্য আমি অন্তত ৫০ জন কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।'

শুধু ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের জন্য প্রতি বছর ২৫ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'অন্যায্য সুবিধা না দিলে সরকারি অফিসের এক ডেস্ক থেকে অন্য ডেস্কে ফাইল সরে না।'

চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী গ্রুপ পিএইচপি ফ্যামিলির এক শীর্ষ কর্মকর্তাও একই কথা জানিয়ে বলেন, ঝামেলা এড়াতে ব্যবসাকেন্দ্রিক সরকারি সেবা নিয়ে কাজ করতে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়েছে।

তার মতে, বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘুষ দেওয়ার বিকল্প নেই।

তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, 'এটি একটি ওপেন সিক্রেট ব্যাপার।'

ন্যাশনাল পলিমার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রিয়াদ মাহমুদ বলেন, সরকারি সেবা বলতে গেলে প্রায় কখনোই অনলাইনে পাওয়া যায় না।

তিনি বলেন, 'আমার কর্মীরা তাদের অফিসে যাওয়ার পরেই সেবা পাওয়া যায়। ঘুষ বাবদ অতিরিক্ত ব্যয় অনেক সময় ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে হয়। এতে পণ্যের দাম বাড়ে।'

এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হুমায়ুন রশিদ বলেন, 'অনলাইনে সেবা পাওয়া তো অনেক দূরের কথা। বরং সেবা পেতে হলে কর্মকর্তাদের জন্য বিমান বা হেলিকপ্টারে করে কারখানা পরিদর্শনের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি অন্যান্য অন্যায্য সুযোগ-সুবিধাও দিতে হয়।'

তিনি অভিযোগ করেন, সরকারি কর্মকর্তারা নানান অজুহাত তৈরি করেন এবং ইঙ্গিত দেন- সেবা পেতে গোপন লেনদেন যেতে হবে।

মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি ও এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ব্যবসায়ীদের ওএসএসের মাধ্যমে অনলাইন সেবা নেওয়া উচিত।

তিনি আরও বলেন, 'তার প্রতিষ্ঠান কয়েক বছর ধরে ওএসএসের মাধ্যমে সেবা নিচ্ছে।'

বিডার পরিচালক (ওএসএস অ্যান্ড রেগুলেটরি রিফর্ম) জীবন কৃষ্ণ সাহা রায় বলেন, করপোরেট হাউসগুলো কখনো লাইসেন্স বা সার্টিফিকেট নবায়নে বাধা বা হয়রানির অভিযোগ করেনি।

'তারা যদি অভিযোগ না করে, তাহলে বিডা কীভাবে তাদের সহযোগিতা করবে?' বলেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'যেসব বিনিয়োগকারী কোনো অফিসে এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হবেন, তারা যেন বিডাকে অবহিত করেন, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।'

বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, কিছু সরকারি কর্মকর্তার মনোভাব পরিবর্তনের এই অনীহা উদ্বেগজনক। বিশেষ করে তাদের কারণে ব্যবসা ও বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

সেবাপ্রার্থী কোম্পানিগুলোর অভিযোগ নিয়ে কাজ করেন আরজেএসসির প্রোগ্রামার জিরকা আমিন। তিনি বলেন, বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান জানে না কীভাবে নিরবচ্ছিন্ন সেবা পেতে হয়। এজন্য তারা চড়া খরচে আইনজীবী বা চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট নিয়োগ দেয়।

তার ভাষ্য, 'অন্যদিকে, যারা আবার এটি করতে চায় তাদের অনেকেই ভুল করে। তাই তারা ব্রোকারের মাধ্যমে করে। এসব কাজ করতে গিয়ে তারা টাকা খরচ করে। তবে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা সংশোধনের সুযোগ আছে।'

Comments

The Daily Star  | English

Indian Media Reporting on Bangladesh: Fake or Fact?"

Why is the Indian media's coverage of Bangladesh markedly different from that of Bangladeshi news outlets?

7h ago