বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি কর্মীর সংখ্যা বাড়ছে

বিডা, বেজা, বেপজা, বিদেশি কর্মী, টিআইবি, ভ্রমণ ভিসা, ওয়ার্ক পারমিট,
ছবি: সংগৃহীত

দক্ষ ব্যবস্থাপক ও দেশের শিল্পায়নের উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থার অভাবে দেশে ক্রমবর্ধমানভাবে বিদেশি কর্মজীবীর সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিবছর বাংলাদেশে কাজ করতে আগ্রহী বিদেশি নাগরিকদের আবেদনের সংখ্যাও বাড়ছে।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০১টি দেশের নাগরিকের কাছ থেকে পাওয়া আবেদনের মধ্যে ১৬ হাজার ৩০৩টি আবেদনের অনুমোদন দিয়েছে। যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৮ শতাংশ বেশি।

বিনিয়োগ উন্নয়ন সংস্থার বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর মধ্যে ৬ হাজার ২৫৬টি নতুন ওয়ার্ক পারমিট এবং ১০ হাজার ৪৭টি নবায়ন করা হয়েছে।

এর আগে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১০৬টি দেশের ১৫ হাজার ১২৮ জন আবেদনকারী এই অনুমতি পেয়েছিলেন, যা তার আগের অর্থবছরের তুলনায় ৮৭ শতাংশ বেশি ছিল। এর মধ্যে ৭ হাজার ৭৯০টি নতুন ওয়ার্ক পারমিট এবং ৭ হাজার ৩৩৮টি নবায়নের অনুমোদন ছিল।

তার আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৮ হাজার ৭৬টি আবেদনের অনুমোদন দিয়েছিল বিডা।

এছাড়া বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা), এনজিও বিষয়ক ব্যুরো এবং কিছু মন্ত্রণালয় বিদেশি নাগরিকদের প্রকল্পে কাজ করার অনুমতি দিয়ে থাকে।

যেমন- ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের ভিতরে কাজ করতে ১ হাজার ৮০০ জনের বেশি বিদেশি নাগরিককে অনুমতি দিয়েছে বেপজা। একই সময়ের মধ্যে বেজা ১ হাজার ৩৫০ জন বিদেশি নাগরিককে অনুমতি দিয়েছে।

২০২২-২৩ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি ওয়ার্ক পারমিট পেয়েছেন ভারতের নাগরিকরা ৩ হাজার ১৫৯টি, এরপর চীন (২ হাজার ৩৩৯), শ্রীলঙ্কা (৭৫৯) ও বেলারুশ (৭২৭)।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশিদের দক্ষতা এবং অতীত রেকর্ডের ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কারণ তারা শিল্প উন্নয়নে ভালো অবদান রাখতে পারেন।

বিডার নির্বাহী সদস্য মহসিনা ইয়াসমিন বলেন, এই উত্থান মোটেই খারাপ কিছু নয়। কারণ বিদেশি পেশাজীবীরা শিল্প খাতের জাতীয় কর্মশক্তির দক্ষতার ঘাটতি পূরণ করছে। তারা বাংলাদেশের আইন মেনে চলছে এবং কর দিচ্ছে।

তিনি সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দক্ষ টেকনিশিয়ান ও ম্যানেজারিয়াল লেভেলের পদের জন্য গাইডলাইন অনুযায়ী আমরা ওয়ার্ক পারমিট দিয়ে থাকি। কারণ তারা আমাদের জনশক্তির জন্য দক্ষতা তৈরিতে সহায়তা করতে পারে।'

তিনি উল্লেখ করেন, বিডা নিবন্ধিত শিল্প প্রকল্প, বাণিজ্যিক অফিস ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু করে।

তবে বিডা বাংলাদেশে মোট বিদেশি শ্রমিকের সংখ্যা সম্পর্কিত তথ্য সংরক্ষণ করে না বলে জানান তিনি।

ইন্দো-বাংলা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীরা বিশেষ করে তৈরি পোশাক ও অটোমোবাইল খাতে সাধারণত উচ্চ দক্ষ ভারতীয় প্রকৌশলী ও ম্যানেজার নিয়োগ দিয়ে থাকেন।

'এ ছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অনেক ভারতীয় উদ্যোক্তা নিয়মিত বাংলাদেশ ভ্রমণের জন্য স্বল্পমেয়াদি ভিসার পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদি ওয়ার্ক পারমিট ভিসা নিয়ে থাকেন।'

তিনি জানান, স্থানীয় প্রকৌশলী ও ব্যবস্থাপকদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য তার নিটল নিলয় গ্রুপের জন্য ছয়জন দক্ষ ভারতীয় প্রকৌশলীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

তিনি স্বীকার করেন, বিনিয়োগকারীরা এই ধরনের দক্ষ পেশাদারদের নিয়োগ দিতে আগ্রহী, কারণ তারা ব্যবসা বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখে।

'অন্যদিকে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ও স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে শিল্পের প্রসার হচ্ছে, এজন্য দক্ষ জনবল প্রয়োজন।'

প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিরুল হক বলেন, স্থানীয় ব্যবস্থাপক ও প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণের জন্য বিনিয়োগকারীরা বিদেশি পেশাজীবীদের নিয়োগ দেন।

'তাই বিনিয়োগকারীরা বিদেশি পেশাজীবীদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিদেশিদের চেয়ে স্থানীয় পেশাজীবীদের নিয়োগ দেওয়া ভালো।'

তার ভাষ্য, বিনিয়োগকারীরা স্থানীয়ভাবে দক্ষ পেশাজীবী পেলে রেমিট্যান্স আকারে বাইরে অর্থ যাওয়ার পরিমাণ কমে যাবে, যা দেশের অর্থনীতিকে সহায়তা করবে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশিরা ১৩৭ মিলিয়ন ডলার নিজ নিজ দেশে পাঠিয়েছেন।

যদিও বিশ্লেষকরা মনে করেন, সঠিক সংখ্যা আরও বেশি হবে। কারণ অন্য দেশের অনেকে বৈধ অনুমতি ছাড়াই এখানে কাজ করছেন।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ২০২০ সালে বলেছিল, দেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিকরা প্রতিবছর আনুমানিক ৩ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার পাচার করছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিদেশি কর্মজীবীদের সংখ্যার বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ইঙ্গিত দেয় যে, বাংলাদেশের শ্রমবাজারে নমনীয়তা আছে।

'তবে শিল্প খাতে বিদেশি নাগরিকদের ক্রমাগত বৃদ্ধি এটাই প্রমাণ করে যে, স্থানীয় গ্র্যাজুয়েট ও পেশাজীবীরা বিদেশিদের মতো দক্ষ নন।'

'যদিও স্থানীয় পেশাদারদের কম বেতনে নিয়োগ দেওয়া যায়, বিপরীতে পেশাদারিত্ব ও দক্ষতার কারণে বিদেশিদের উচ্চ বেতনের প্রস্তাব দিয়ে নিয়োগ দেন বিনিয়োগকারীরা।'

এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, এই প্রবণতা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কারিকুলাম নিয়েও প্রশ্ন তোলে।

তার ভাষ্য, 'বিদেশি নাগরিকদের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে।'

গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বেগম স্থানীয় জনশক্তির মধ্যে দক্ষতার ঘাটতি এবং টারশিয়ারি পর্যায়ে মানসম্মত শিক্ষার অভাবকে দায়ী করেছেন।

তিনি বলেন, 'সরকার শিক্ষার পেছনে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করলেও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় দক্ষতা অর্জনের পর দেশ ত্যাগ করে।'

তিনি আরও বলেন, 'কিছু বিদেশি নাগরিক জব ভিসা ছাড়াই বাংলাদেশে এসে অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করছেন বলে অভিযোগ আছে।'

'ট্যুরিস্ট ভিসার আওতায় আসা এসব অস্থায়ী কর্মীকে শনাক্ত করা সত্যিই কঠিন,' বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
US attack on Iran nuclear sites

Iran’s Araghchi says US attack will have ‘everlasting consequences’

Iran says 'no signs of contamination' after US attacks on key nuclear sites

2h ago