চাহিদা কমায় উৎপাদন কমিয়েছে ইস্পাত কোম্পানিগুলো
চাহিদা ও দাম কমায় এ বছরের সেপ্টেম্বরে দেশের ইস্পাত শিল্পের উৎপাদন গত বছরের একই সময়ের চেয়ে উল্লেখযোগ্য কমেছে।
দেশব্যাপী বিক্ষোভ, কারফিউ, রাজনৈতিক পরিবর্তন ও পরবর্তী অনিশ্চয়তার কারণে গত তিন মাস ইস্পাত খাতের জন্য আশাব্যঞ্জক ছিল না। এই শিল্পের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড (বিএসআরএম) ও আনোয়ার ইস্পাতের মতো শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হতাশা প্রকাশ করেছে।
জানা গেছে, মিলগুলো প্রতি টন ইস্পাত উৎপাদন করে লোকসানের মুখে পড়ছে। ফলে, সাম্প্রতিক সময়ে অনেকে তাদের চুল্লি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিএসআরএমের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, 'মিলাররা এখন কর্মীদের বেতন ও ইউটিলিটি বিল দিতে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে পণ্য বিক্রি করছেন।'
স্থানীয় ইস্পাতের চাহিদার প্রায় ৬৭ শতাংশ ব্যবহার হয় সরকারি নির্মাণ ও মেগা প্রকল্পে। কিন্তু চলতি বছরের জুলাই থেকে এসব প্রকল্পের কাজ কমতে শুরু করে ও ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর তা স্থবির হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে, ক্রমাগত উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে রিয়েল এস্টেট খাতও লড়াই করছে। এতে ইস্পাতের চাহিদা আরও কমেছে।
এছাড়া রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা পালিয়ে যাওয়ায় উপ-শহর ও গ্রামাঞ্চলে নতুন নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সরকারি অনুমোদন প্রক্রিয়া থমকে আছে।
খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, জুলাই থেকে স্থানীয় ইস্পাত কোম্পানিগুলোর মোট বিক্রি প্রতি মাসে দেড় লাখ টনে নেমে এসেছে, যা আগে প্রতি মাসে পাঁচ লাখ টনের বেশি ছিল।
তপন সেনগুপ্ত বলেন, 'আগের মতো চাহিদা নেই, তাই আমরা লোকসানে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি।
মজুত থাকা পণ্য খালাসে ইস্পাত কোম্পানিগুলো পরিচালন ব্যয় মেটাতে গত মাসে টনপ্রতি প্রায় ছয় হাজার থেকে সাড়ে ছয় হাজার টাকা দাম কমিয়েছে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, ৬০ গ্রেডের মাইল্ড স্টিল (এমএস) রড প্রতি টন ৯৩ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা এক মাস আগে ছিল ৯৯ হাজার ৫০০ টাকা।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) সাবেক সভাপতি ও আনোয়ার গ্রুপের মনোয়ার হোসেন বলেন, 'ইস্পাতের ব্যবহার এখন নিম্নমুখী, ফলে মিল মালিকদের পক্ষে পুরো সক্ষমতায় উৎপাদন চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।'
এ অবস্থায় পূর্ণ উৎপাদন সক্ষমতা কাজে লাগাতে না পারায় ওভারহেড খরচ বাড়ছে।
মনোয়ার হোসেন বলেন, করোনা মহামারির পর মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, উচ্চ সুদের হার এবং মূল্যস্ফীতির কারণে মূলধন ঘাটতিসহ অসংখ্য প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছে ইস্পাত নির্মাতারা।
তিনি আরও বলেন, 'এছাড়া ঋণপত্র মার্জিন বেড়েছে, বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে, কাঁচামাল সংকট এবং গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। এই কারণগুলো ইস্পাত উৎপাদন কোম্পানিগুলোর জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।'
তার ভাষ্য, সম্প্রতি মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ১২০ টাকায় নেমে যাওয়ায় বিদ্যমান মূলধন সংকটে ইস্পাত কোম্পানিগুলোর সংকট আরও বেড়েছে।
ফলে চলতি মূলধন ও রাজস্ব আয়ের অভাবে কিছু মাঝারি আকারের মিল সাময়িকভাবে উৎপাদন বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে।
তিনি জানান, ন্যূনতম লাভ বা লোকসানের কারণে প্রায় সব মিলার মালিকরা উৎপাদন অন্তত ৬০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে।
তবে দেশের বাজার নিয়ে ভালো কিছুর প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন বিএসআরএমের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত।
তিনি মন্তব্য করেন, 'রাতারাতি পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। বরং নতুন নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণের জন্য আইন-শৃঙ্খলার প্রতি জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করা গুরুত্বপূর্ণ।'
তপন সেনগুপ্ত বলেন, 'ব্যবসা-বাণিজ্য উত্থান-পতনের মুখোমুখি হয় এবং পরিস্থিতির উন্নতি হলে চাহিদা আবার ঘুরে দাঁড়াবে।'
তবে বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব সুমন চৌধুরী তেমন আশাবাদী নন।
তিনি বলেন, আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে কোনো সরকারি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি। এমনকি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও চলমান নির্মাণ কাজের বিষয়ে এখনও কোনও দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয়নি।
ফলে সরকারি খাত থেকে ইস্পাতের চাহিদা প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে, সাধারণত মোট ইস্পাতের ৬৭ শতাংশ এখানে ব্যবহার হয়, যা বার্ষিক সাত দশমিক পাঁচ মিলিয়ন টন।
তিনি দাবি করেন, সার্বিক চাহিদা প্রায় ৭০ শতাংশ কমে গেছে।
তিনি আরও বলেন, বাজারের আকার ও বিনিয়োগের দিক থেকে ইস্পাত খাত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্প খাত।
স্থানীয় ইস্পাত বাজারে প্রায় ২০০ কোম্পানি রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৪০টি বড় কোম্পানি আছে। মিলগুলোর বর্তমান উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় এক কোটি ১০ লাখ টন।
Comments