১৬ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রভিশন ঘাটতি ১৯৫৪ কোটি টাকা

যখন কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রভিশন ঘাটতির মুখে পড়ে, তখন তার দুর্বল ব্যবস্থাপনার বিষয়টি সামনে আসে।
এমডি নেই এক ডজন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে!

চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১৬টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) মোট প্রভিশন ঘাটতি ১ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে উচ্চ খেলাপি ঋণে জর্জরিত। এর মধ্যে আবার প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে। যা শেষ পর্যন্ত তাদের নিট মুনাফার ওপর প্রভাব ফেলবে।

যখন কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রভিশন ঘাটতির মুখে পড়ে, তখন তার দুর্বল ব্যবস্থাপনার বিষয়টি সামনে আসে।

নিয়ম অনুযায়ী, এনবিএফআইগুলোকে সাধারণ শ্রেণির ঋণের বিপরীতে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে পাঁচ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হয়। অন্যদিকে নিম্ন শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ ও সন্দেহজনক শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখতে হবে।

এছাড়া, মন্দ বা লোকসান ক্যাটাগরিতে শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে তাদের অবশ্যই ১০০ শতাংশ প্রভিশন আলাদা করে রাখতে হবে।

প্রভিশন ঘাটতিতে থাকা ১৬ ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান হলো- আভিভা ফাইন্যান্স, বিডি ফাইন্যান্স, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), বে লিজিং, এফএএস ফাইন্যান্স, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স, হজ ফাইন্যান্স, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কোম্পানি (আইআইডিএফসি), ইসলামিক ফাইন্যান্স, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স, মাইডাস ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স, ফিনিক্স ফাইন্যান্স, প্রিমিয়ার লিজিং ও প্রাইম ফাইন্যান্স।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত দেশের ৩৫টি এনবিএফআইয়ের প্রভিশন বাবদ মোট ১৬ হাজার ২৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার কথা থাকলেও তারা ১৪ হাজার ১২২ কোটি টাকা রাখতে পেরেছে।

অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উদ্বৃত্ত প্রভিশন থাকায় তাদের মোট প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ৯০১ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) চেয়ারম্যান ও আইআইডিএফসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম সারওয়ার ভূঁইয়া বলেন, প্রভিশন ঘাটতির কারণে এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত দেশের এনবিএফআইগুলোতে ঋণ বেড়েছে রেকর্ড ২৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকা।

একই সময়ে তাদের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৪ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা, অর্থাৎ খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে বিতরণ করা ঋণের রেকর্ড ৩৩ দশমিক ১৫ শতাংশ।

চলতি বছরের জুনে মন্দ ঋণ আগের বছরের একই মাসের চেয়ে চার হাজার ৭৬০ কোটি ১১ লাখ টাকা বা ২৪ শতাংশ বেড়েছে। গত বছরের জুনে মন্দ ঋণ ছিল ১৯ হাজার ৯৫১ কোটি ১৭ লাখ টাকা।

গোলাম সারওয়ার ভূঁইয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, তার কোম্পানি প্রভিশন ঘাটতি পূরণ করবে এবং সেপ্টেম্বরের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে সেই তথ্য পাওয়া যাবে।

তিনি আরও বলেন, বেশিরভাগ এনবিএফআই এ ধরনের ঘাটতি পূরণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কিছুটা সময় পায়।

লিজিং ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর প্রধান নির্বাহীদের ফোরাম বিএলএফসিএ সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করেছে। তারা এনবিএফআইগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে তারল্য সহায়তা ও নীতিগত ব্যবস্থার দাবি জানিয়েছে।

কয়েক বছর আগে করপোরেট সুশাসনের অভাবে ব্যাপক অনিয়ম ও কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত হয়ে এনবিএফআইয়ের প্রতি ভোক্তাদের আস্থা তলানিতে ঠেকেছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পি কে হালদার পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, এফএএস ফাইন্যান্স ও বিআইএফসি এই চারটি এনবিএফআইয়ের কাছ থেকে অন্তত সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

ফলে এই এনবিএফআইয়ের ৯০ শতাংশ ঋণ মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে এবং এগুলো রুগ্ন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

গত জুন পর্যন্ত এফএএস ফাইন্যান্সের প্রভিশন ঘাটতি ছিল সর্বোচ্চ প্রায় ৫৫০ কোটি টাকা। কোম্পানিটির খেলাপি ঋণ রয়েছে ১ হাজার ৮২০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা, যা প্রতিষ্ঠানটির মোট বিতরণ করা ঋণের ৯৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ।

আভিভা ফাইন্যান্সের প্রভিশন ঘাটতি ৪৪১ কোটি টাকা। কেলেঙ্কারির কবলে পড়া আভিভা ফাইন্যান্সকে এস আলম গ্রুপমুক্ত করতে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে।

কোম্পানিটির খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৮৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, দেশে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং এনবিএফআই খাতটি সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত।

তিনি মনে করেন, ব্যাংকিং খাতের চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকলেও এনবিএফআইয়ের সমস্যাগুলো সমাধান করা খুব কঠিন হবে।

'সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত এ খাতের মনিটরিং বাড়ানো। অন্যথায় আর্থিক খাতে বড় ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি হবে,' বলেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জিএসপি ফাইন্যান্সের প্রভিশন ঘাটতি ২০৯ কোটি টাকা, হজ ফাইন্যান্স ২১২ কোটি টাকা, ইসলামিক ফাইন্যান্স ১২১ কোটি টাকা, বিডি ফাইন্যান্স ৯৬ কোটি টাকা, ফার্স্ট ফাইন্যান্স ৮৩ কোটি, বে লিজিং ৬৬ কোটি টাকা, প্রিমিয়ার লিজিং ৫৬ কোটি টাকা এবং প্রাইম ফাইন্যান্সের ৫৪ কোটি টাকা।

বিআইএফসি, আইআইডিএফসি, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স, মাইডাস ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স ও ফিনিক্স ফাইন্যান্সের সমন্বিত প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ৬২ কোটি টাকা।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, সবার চোখ ব্যাংকিং খাতের দিকে। অথচ এনবিএফআইগুলোর দিকে কারো নজর নেই।

তিনি বলেন, 'এনবিএফআইগুলোর সুশাসন ফিরিয়ে আনতে হবে। দেশের অর্থনীতির স্বার্থে এ খাতের আরও উন্নয়ন প্রয়োজন।'

Comments

The Daily Star  | English

Ban on plastic bags a boon for eco-friendly sacks

Availability of raw materials now a challenge

7h ago