পোশাক শিল্পে নতুন হুমকি অস্থিরতা

পোশাক শিল্প
সম্প্রতি শ্রমিকরা দাবি আদায়ে আন্দোলন করায় প্রায় ১৫ দিন কারখানা বন্ধ থাকে। ছবি: আকলাকুর রহমান আকাশ/স্টার

দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন ও গত আড়াই মাস ধরে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে চলতি শরৎ ও শীতে বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যাদেশ প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে।

গত জুলাই থেকে চলমান সংকটময় পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিদেশি ক্রেতারা সফর পিছিয়ে দিয়েছেন। অনেকে কারখানা পরিদর্শন বাতিল করেছেন। ফলে আসন্ন মৌসুমে কার্যাদেশ কমেছে।

গত জুলাই ও আগস্ট এবং চলতি সেপ্টেম্বরে ক্রিসমাসের সময় পশ্চিমের খুচরা বিক্রেতাদের কাছে পণ্য বিক্রির সেরা মৌসুমই নয়, আগামী শরৎ ও শীতের জন্য কার্যাদেশ পাওয়ার ব্যস্ততম মাস।

দুর্ভাগ্যবশত এমন সময়ে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নজিরবিহীন অবনতির হয়।

গত জুলাইয়ের মাঝামাঝি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমনে কারফিউ ও ইন্টারনেট বন্ধ করলে পোশাক তৈরি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

শেষ পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যান।

নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর কয়েকটি খাতের শ্রমিকদের কাছ থেকে নানা দাবি উঠতে শুরু করে।

এমন পরিস্থিতিতে শ্রমিকরা দাবি আদায়ে আন্দোলন করায় প্রায় ১৫ দিন কারখানা বন্ধ থাকে।

আশুলিয়া, জিরানী, সাভার, টঙ্গী ও গাজীপুরের শিল্প এলাকায় কয়েক হাজার শ্রমিক রাস্তায় নামেন। কারো কারো বিরুদ্ধে ভাঙচুর ও আগুনে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে।

এরপর মালিকরা অস্থিরতা এড়াতে ও সম্পত্তি রক্ষায় একের পর এক কারখানা বন্ধ করে দেন।

ক্ষমতার পালাবদলের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ায় বিক্ষোভ আরও ছড়িয়ে পড়ে।

পুলিশের ওপর হামলার কারণে শিল্প পুলিশের সদস্যরা শিল্প এলাকায় টহল দেওয়া বন্ধ রাখে।

এ ছাড়াও, সে সময় সরকার পরিবর্তনের পর পুলিশ প্রশাসনে রদবদল হচ্ছিল। প্রায় সব থানা অকার্যকর হয়ে পড়েছিল।

ফলে মালিকরা কারখানা চালাতে সাহস পাননি।

পোশাক শিল্প
শ্রমিক অসন্তোষের ফলে অনেক মালিক কারখানা খুলেননি। ছবি: আকলাকুর রহমান আকাশ/স্টার

ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা না থাকায় সেনাবাহিনীর সহায়তায়ও কারখানা চালানো যায়নি।

তাই আশুলিয়া, সাভার, জিরানী ও জিরাবোর অধিকাংশ কারখানা বন্ধ ছিল। অনেক কারখানায় শ্রমিকরা ভাঙচুর করেছিলেন।

মালিকরা শেষমেশ বাংলাদেশ শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারা অনুসারে কারখানা বন্ধ করে দেন। এই আইনটি 'কাজ নেই, বেতন নেই' শর্তের সঙ্গে সম্পর্কিত।

এই সময় কেন অশান্তি?

অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন যে জাতি যখন নাজুক পরিস্থিতিতে, তখন কেন এই অস্থিরতা? বিশেষ করে, যখন গত বছরের ডিসেম্বরে পোশাক শ্রমিকদের জন্য নতুন মজুরি কাঠামো কার্যকর হয়।

ক্রমাগত মূল্যস্ফীতির কারণে বেতন বাড়লেও শ্রমিকদের জীবনমানের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি।

সাধারণ শ্রমিক, ইউনিয়ন নেতা, শ্রম বিশেষজ্ঞ ও কারখানা মালিকদের মতে, শ্রমিক আন্দোলনের পিছনে আরও কিছু কারণ ছিল।

সর্বশেষ অসন্তোষের সময় শ্রমিকরা প্রাথমিকভাবে টিফিন ও উপস্থিতি ভাতা মানসম্মত করার দাবি তুলেছিলেন। কারণ অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানে তা দেওয়া হয়।

শ্রমিকদের অপর দাবি 'বৈষম্য' দূর করতে নারী-পুরুষকে সমান অনুপাতে নিয়োগ দিতে হবে।

রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় প্রভাবশালীরা আইনশৃঙ্খলার অভাবকে কাজে লাগাতে শ্রমিকদের প্রভাবিত করেছিল।

গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ক্ষমতার শূন্যতা পূরণ ও 'ঝুট' ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ শুরু হয়।

গত সপ্তাহে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং মেজর জেনারেল মুহাম্মদ মো. মঈন খান অস্থিরতার তিন কারণ তুলে ধরেন। সেগুলো হলো: বহিরাগতদের উসকানি, শ্রমিকদের দাবি ও ঝুট বাণিজ্য দখল নিয়ে দ্বন্দ্ব।

অস্থিরতার মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার জানায়, তারা মজুরি কাঠামো পর্যালোচনা করতে পারে।

তবে শ্রমিক নেতারা বলছেন, মজুরি কাঠামো পর্যালোচনা এবার তাদের প্রধান দাবি নয়।

পোশাক শিল্প
স্টার ফাইল ফটো

সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জুলাইয়ে আন্দোলন শুরুর পর অনেককে ছাঁটাই করা হয়েছে।' শ্রমিকদের দাবির বৈধতা দিয়ে তিনি বলেন যে তাদের জীবন মানসম্মত নয়।

নাজমা আক্তার মনে করেন, পোশাক ব্যবসার বৃহত্তর স্বার্থে শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা, শ্রম আইনের কয়েকটি ধারা বাতিল, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও প্রভিডেন্ট ফান্ড বাস্তবায়ন ও নারী শ্রমিকের নির্যাতন বন্ধসহ যৌক্তিক দাবিগুলোর সঙ্গে কারখানা মালিকদের একমত হতে হবে।

একই মত বাংলাদেশ অ্যাপারেল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি তৌহিদুর রহমানেরও।

তার দাবি, সর্বশেষ অস্থিরতার সঙ্গে বহিরাগতরাও জড়িত। তবে অনেক কারখানা সময়মতো বেতন পরিশোধ করছে না বলেও জানান তিনি।

'সাধারণত পোশাক শ্রমিকরা কম বেতন পান। যদি সময়মতো বেতন না পান তবে কীভাবে সংসার চালাবেন। বাড়ি ভাড়া ও সন্তানদের পড়ালেখার খরচ মেটাবেন?'

উদাহরণ হিসেবে তিনি আরও বলেন, 'কয়েকটি কারখানা এখনো আগস্টের বেতন দেয়নি।'

গত সপ্তাহে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সংঘাতে জড়িত থাকার অভিযোগে বেশ কয়েকটি কারখানায় চার শতাধিক শ্রমিককে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।'

বায়োমেট্রিক্সের মাধ্যমে শ্রমিকদের উপস্থিতি নিবন্ধন করায় কালো তালিকাভুক্ত শ্রমিকরা অন্য কারখানায় চাকরি পাবেন না।

আমিরুল হক আমিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মালিকদের উচিত ওই শ্রমিকদের নাম কালো তালিকা থেকে বাদ দেওয়া। তারা অসন্তোষে লিপ্ত হয়েছেন শুধুমাত্র যৌক্তিক দাবি আদায়ের জন্য।'

বর্তমানে আশুলিয়া, সাভার, জিরানী ও জিরাবো এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েনের মাধ্যমে নিরাপত্তা জোরদার করায় পরিস্থিতি ক্রমশ স্বাভাবিক হচ্ছে।

সেসব এলাকার প্রায় সব কারখানা গত রোববার খুলে দেওয়া হয়। শ্রমিকরা কাজে যোগ দেওয়ায় উৎপাদন শুরু হয়।

পোশাক শিল্প
গত জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরুর পর অনেক শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়েছে। ছবি: আকলাকুর রহমান আকাশ/স্টার

শ্রমিক অশান্তির প্রভাব

দেশের কারখানাগুলো থেকে শুধু যে নির্দিষ্ট সংখ্যক কার্যাদেশ বাতিল করা হয়েছে তাই নয়, সময়মতো পণ্য পাঠানো নিশ্চিত করার বিষয়েও উদ্বিগ্ন কর্মকর্তারা।

ফলে দেশের পোশাক রপ্তানিকারকদের নষ্ট হওয়া সময় পুষিয়ে নিতে বড় ছাড় দিতে হবে অথবা উড়োজাহাজে পণ্য পাঠানোর ব্যয়বহুল পথ বেছে নিতে হবে।

কিছু ক্ষেত্রে সময়মতো পণ্য জাহাজীকরণে ব্যর্থতার কারণে কার্যাদেশ বাতিল হতে পারে।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, রপ্তানিকারকরা বিদেশি ক্রেতাদের বেঁধে দেওয়া সময় পূরণে ও তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে বেশি অর্থ খরচ করে উড়োজাহাজে পণ্য পাঠাতে বাধ্য হবেন।

তারা জানেন যে উড়োজাহাজে পণ্য পাঠানো হলে লাভের পরিমাণ অনেক কমে পাবে।

ঢাকা থেকে ইউরোপের যেকোনো দেশে আকাশপথে পাঠাতে প্রতি কেজি কাপড়ের জন্য চার ডলারের বেশি খরচ করতে হয়।

চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে একই চালান ইউরোপে পাঠাতে খরচ হয় ১০ সেন্টেরও কম।

করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, অব্যাহত মূল্যস্ফীতি ও লোহিত সাগর সংকটের মারাত্মক প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ইতোমধ্যে হিমশিম খাওয়া দেশের পোশাক শিল্পের জন্য দীর্ঘ সময় শ্রমিক অসন্তোষ হলো সর্বশেষ ধাক্কা।

বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কার্যাদেশ ১০ শতাংশ কমে যাওয়া ছাড়াও প্রায় সমপরিমাণ কার্যাদেশ অন্য দেশে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।'

তিনি টেলিফোনে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হারানো কার্যাদেশ পুনরুদ্ধারে সময় লাগবে। এটি ব্যবসার স্বাভাবিক পরিবেশ পুরোপুরি পুনরুদ্ধারের ওপর নির্ভর করছে।'

তার ভাষ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক সমস্যায় থাকা কারখানাগুলোকে আগস্টের বেতন পরিশোধে সহায়তা দেয়। গত ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৯০ শতাংশ কারখানা আগস্টের বেতন দিয়েছে।

বিজিএমইএ সভাপতি আরও বলেন, 'আশা করছি, শ্রমিকরা আবার কাজে ফেরার পর কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য পুরোপুরি স্বাভাবিক হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Postgrad doctors block Shahbagh demanding stipend hike

The blockade resulted in halt of traffic movement, causing huge suffering to commuters

1h ago