রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ এখনো অনেক দূর
যদিও দেশের রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনার প্রয়োজনীয়তা দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে আলোচিত হচ্ছে তবুও এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে খুবই কম।
বাস্তবে রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের কোনো পরিষ্কার চিত্র দেখা যাচ্ছে না। তৈরি পোশাক এখনো আধিপত্য বজায় রেখেছে। এটি দেশের পুরো রপ্তানির পাঁচভাগের প্রায় চারভাগ।
পোশাক রপ্তানি ১৯৯০ দশকের শুরুর দিকে এক দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২৩ সালে ৪৭ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। পোশাক বহির্ভূত পণ্যের রপ্তানি ৮১১ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে আট বিলিয়ন ডলার।
২০০১-২০০২ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের রপ্তানি ৮২৮ শতাংশ বেড়ে পাঁচ দশমিক নয় বিলিয়ন ডলার থেকে হয়েছে ৫৫ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯২৫ শতাংশ।
সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও পোশাক বহির্ভূত পণ্যের রপ্তানির অনুপাত মোট রপ্তানির অনুপাত ২০০১-২০০২ অর্থবছরে ২৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৫ দশমিক ৪২ শতাংশে নেমে এসেছে।
বর্তমানে দেশের রপ্তানির বেশিরভাগ আসে নিটওয়্যার (৪৪ দশমিক ছয় শতাংশ) থেকে। এরপর ওভেন গার্মেন্টস (৩৭ দশমিক দুই শতাংশ), হোম টেক্সটাইল (তিন দশমিক তিন শতাংশ), জুতা (দুই দশমিক তিন শতাংশ), পাটজাত পণ্য (এক দশমিক নয় শতাংশ) ও মাছ (এক শতাংশ) উল্লেখযোগ্য।
পোশাকের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতার মানে হলো দেশের রপ্তানি পণ্যর সংখ্যা অনেক কম।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) 'বাংলাদেশে রপ্তানি বৈচিত্র্যকে উৎসাহিত করা' শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রপ্তানি উন্নয়নশীল দেশগুলোর গড়ের তুলনায় চারগুণ বেশি কেন্দ্রীভূত। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ রপ্তানি বাজার বহুমুখীকরণের অভাবেও ভুগছে।
রপ্তানি পণ্যের চার-পঞ্চমাংশেরও বেশি যায় উত্তর আমেরিকা ও ইইউ বাজারে। মোট রপ্তানির ৭২ শতাংশ যায় ১০ দেশে। যেখানে ভারত ও শ্রীলঙ্কার হিসাব যথাক্রমে ৫২ শতাংশ ও ৬৪ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নীতি ও অর্থায়ন বাধা এবং পোশাক বহির্ভূত খাতে অবকাঠামোগত উন্নয়নের অভাব রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণকে ধীর করে দিয়েছে।
'বাংলাদেশ খুব কম রপ্তানিমুখী সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) পেয়েছে। এটি রপ্তানি বহুমুখীকরণকে আটকে রাখার অন্যতম কারণ। আরেক কারণ হলো, রপ্তানিকেন্দ্রিক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো এখনো কাজ শুরু করতে পারেনি।'
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রপ্তানি বহুমুখীকরণ সম্প্রসারণে চারটি প্রধান বাধা হলো—নীতিগত সমস্যা, অর্থায়ন বাধা, অবকাঠামোর অভাব ও পোশাক বহির্ভূত রপ্তানিকারকদের দুর্বল দরকষাকষির ক্ষমতা।'
তিনি আরও বলেন, 'পোশাক ও পোশাক বহির্ভূত পণ্যের রপ্তানিকারকরা কার্যত একই সুবিধা পাচ্ছেন না।'
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, 'তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা বিনাশুল্কে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করতে পারেন। পোশাক বহির্ভূত পণ্যের রপ্তানিকারকদের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানিতে উচ্চ শুল্ক দিতে হয়।'
তার ভাষ্য, পোশাক বহির্ভূত রপ্তানিকারকরা পোশাক রপ্তানিকারকদের মতো সহজে বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা পান না। রপ্তানি বৈচিত্র্য ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে এটিও বড় বাধা।
তিনি আরও বলেন, 'অবকাঠামো ও যথাযথ সরকারি সহায়তার অভাবে কৃষি পণ্যের রপ্তানি বাড়ছে না।'
বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) প্রধান নির্বাহী ফেরদৌস আরা বেগম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নানান কারণে রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ হয়নি। পোশাক খাতেও বৈচিত্র্য কম।'
'পোশাক খাতে মাত্র চার থেকে পাঁচটি পণ্য রপ্তানি হয়। বিদেশি ক্রেতারা সুতি কাপড়ের দামের জন্য দর কষাকষির সুযোগ পেয়েছেন। এতে পণ্যের দাম কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছে।'
তার পরামর্শ, 'কৃত্রিম সুতায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিপুল বিনিয়োগ ও সার্বিক সহায়তা প্রয়োজন।'
তিনি আরও বলেন, 'সাম্প্রতিক বছরগুলোয় গ্যাস সংকট শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোয় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কারখানা সুষ্ঠুভাবে চালাতে বাধা দিচ্ছে। দেশে বড় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।'
তার মতে, অল্প সংখ্যক উদ্যোক্তা রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল ব্যবহার করায় অর্থায়ন আরেকটি সমস্যা।
উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় আসার চ্যালেঞ্জ
আগামী ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় আসার জন্য রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের উদ্যোগ জোরদার করা অপরিহার্য।
স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বর্তমানে কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের বাজারে একতরফা বাণিজ্যিক সুবিধা পায়। এ ধরনের শুল্কমুক্ত ব্যবস্থা বাংলাদেশকে অনেক সুবিধা দিয়েছে।
দেশের ৭০ শতাংশেরও বেশি রপ্তানি পণ্য এলডিসি-সম্পর্কিত বাণিজ্য অগ্রাধিকার পায়। এটি এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশের তুলনায় অনেক বেশি।
তবে পণ্যের পরিধি না বাড়ালে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর এসব সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর ইইউ আরও তিন বছর বা ২০২৯ সাল পর্যন্ত শুল্কমুক্ত সুবিধা দেবে।
এরপর কী হবে তা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে বর্তমানে প্রস্তাবিত শর্তগুলোর অধীনে ইইউতে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির গড় শুল্কের হার শূন্য থেকে বেড়ে প্রায় ১২ শতাংশ হবে।
একই সময়ে দেশের রপ্তানিকারকদের রপ্তানিতে গড় শুল্ক শূন্য থেকে বেড়ে কানাডায় ১৭ শতাংশ, চীনে ১৬ শতাংশ, জাপানে আট দশমিক সাত শতাংশ ও ভারতে আট দশমিক ছয় শতাংশ হতে পারে।
পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের (পিআরজি) চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নীতিগত সংস্কারের অভাবে দেশের রপ্তানি খাতে পোশাক বহির্ভূত পণ্যের পরিমাণ কমেছে। লজিস্টিক সাপোর্ট ও নতুন প্রযুক্তি গ্রহণসহ কর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে এসব খাতে সঠিক সহায়তা প্রয়োজন।'
ফেরদৌস আরার আশঙ্কা, 'এলডিসি-পরবর্তী পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। নগদ প্রণোদনা কমানোর পর প্রায় সব খাতের রপ্তানি কমে যাবে।'
'বাংলাদেশ ব্যাংক, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (এনবিআই) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মধ্যে রপ্তানি পরিসংখ্যানে অসামঞ্জস্যতা সার্বিক পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'পণ্য বহুমুখীকরণে বড় ধরনের বিনিয়োগের পাশাপাশি ইউটিলিটি, অর্থায়ন ও কর নীতি সহায়তা বাড়াতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'তৈরি পোশাক আমাদের সফলতা। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এ খাত থেকে অন্তত ১৫০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যে আমাদের পোশাক পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। আমাদের সুস্পষ্ট খাতভিত্তিক কৌশলও দরকার।'
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিশটিংগুইশড ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পোশাক খাতের দ্রুত প্রবৃদ্ধির কারণে দেশের রপ্তানি খাতে এর আধিপত্য আছে।'
তার মতে, পোশাক বহির্ভূত খাতের প্রবৃদ্ধি খুবই ধীর। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি কমেছে।
তিনি আরও বলেন, 'বাংলাদেশ খুব কম রপ্তানিমুখী সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) পেয়েছে। এটি রপ্তানি বহুমুখীকরণকে আটকে রাখার অন্যতম কারণ। আরেক কারণ হলো, রপ্তানিকেন্দ্রিক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো এখনো কাজ শুরু করতে পারেনি।'
তিনি রপ্তানিমুখী বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো ও যথাযথ ওয়ান স্টপ সার্ভিস নিশ্চিতের পরামর্শ দেন। এটি রপ্তানি বহুমুখীকরণে সহায়তা করবে।
বিশেষ করে ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে প্রযুক্তি ও দক্ষ মানবসম্পদের অভাব পোশাক বহির্ভূত খাতগুলোর বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে বলে মনে করেন তিনি।
রপ্তানি বহুমুখীকরণের সম্ভাবনাময় খাতগুলো চিহ্নিত করতে অনেক গবেষণা হলেও বারবার কার্যত একই খাতগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের (পিআরজি) চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নীতিগত সংস্কারের অভাবে দেশের রপ্তানি খাতে পোশাক বহির্ভূত পণ্যের পরিমাণ কমেছে। লজিস্টিক সাপোর্ট ও নতুন প্রযুক্তি গ্রহণসহ কর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে এসব খাতে সঠিক সহায়তা প্রয়োজন।'
তিনি আরও বলেন, 'রপ্তানিমুখী বিদেশি বিনিয়োগ আনা জরুরি। এ ছাড়া পণ্য বহুমুখী করা খুব কঠিন।'
রপ্তানি বহুমুখীকরণের আরেক বাধা পোশাক ও পোশাকবহির্ভূত খাতের মধ্যে আয়করের হারে পার্থক্য।
পোশাক খাত তুলনামূলকভাবে কম কর্পোরেট কর থেকে উপকৃত হয়েছে। এই করের হার ১০ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত।
বিপরীতে বস্ত্র, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং হোম টেক্সটাইলের মতো পোশাক বহির্ভূত খাতগুলো ১৫ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কর দেয়।
২০২২-২৩ অর্থবছরে পরিষেবা ও পণ্য রপ্তানির জন্য ১২ শতাংশের অভিন্ন আয়কর হার চালু হয়েছিল। এই উদ্যোগের ফলে রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য আয়কর হারে বৈষম্য দূর হওয়ার আশা করা হচ্ছে।
এডিবির গবেষণাপত্রে রপ্তানির বিপরীতে নীতি-প্রণোদিত প্রণোদনা মোকাবিলা, রপ্তানি বাজার বৃদ্ধি ও পণ্যের বহুমুখীকরণ দ্রুত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
Comments