অর্থনীতিবিদদের চোখে অগ্রাধিকার
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন—নতুন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত প্রধান আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দ্রুত কার্যকর করা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং আমদানি-রপ্তানি, জিডিপি ও গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সূচকগুলোর সঠিক তথ্য তুলে ধরা।
তারা আরও মনে করেছেন যে অর্থ উপদেষ্টাকে অবশ্যই প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুসংহত করার পাশাপাশি সঠিক অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নের দিকেও মনোযোগ দিতে হবে।
তবে দ্রুত আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার বলে জানিয়েছেন তারা।
গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে শেখ হাসিনা পালানোর পর দেশে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গত ৮ আগস্ট শপথ নেন। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদকে অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সম্প্রতি পদত্যাগ করা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরের পদে দ্রুত নিয়োগ দেওয়া উচিত।
সাম্প্রতিক অবস্থায় অর্থনীতি কার্যত স্থবির হয়ে পড়লেও অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর সমস্যার সমাধান হতে শুরু করবে বলে আশা করছেন তারা।
ব্যাংকিংখাত খেলাপি ঋণে জর্জরিত। অধিকাংশ ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান মালিকদের অব্যবস্থার কারণে টিকে থাকার সংগ্রাম করছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিশটিংগুইশড ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান দ্য ডেইল স্টারকে বলেন, 'অর্থ উপদেষ্টার প্রথম কাজ হবে শক্তিশালী মুদ্রা ও রাজস্ব নীতির পাশাপাশি উন্নত বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা।'
'ব্যাংকিং কমিশন গঠন দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'এ ধরনের কমিশনের কাজ হবে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ও সাধারণ ঋণখেলাপিদের আলাদা করা।'
তার মতে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আমদানি-রপ্তানি ও মূল্যস্ফীতির মতো অর্থনৈতিক সূচকের গণনায় যথার্থতা নিশ্চিত করতে সঠিক তথ্য তুলে ধরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, 'আরেকটি অগ্রাধিকার হলো আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ক্ষমতা দিয়ে টাকা পাচার বন্ধ করা। এটি ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসা বাড়িয়ে দেবে।'
'এছাড়াও, সরকারের উচিত ডলারের বাজার স্থিতিশীল করা। আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিং চেক করা, যাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ বাড়ে।'
অর্থ উপদেষ্টাকে পুঁজিবাজারকে ঢেলে সাজাতে হবে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় প্রকল্পগুলোর গুণগত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
ঋণ ব্যবস্থাপনা ও ব্যাংকিং খাতের শ্বেতপত্র প্রকাশও গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার বলে মনে করেন তিনি।
'অর্থ উপদেষ্টাকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া উচিত। এটি বাজার স্থিতিশীল করতে বড় ভূমিকা পালন করে,' জানিয়ে এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, 'প্রস্তাবিত বাজেট ঢেলে সাজানো দরকার। বস্তুনিষ্ঠ বাজেট ও বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নেওয়ার এখনই আসল সময়। কিছু অবাস্তব পরিসংখ্যান দিয়ে বাজেট দেওয়া হয়েছে।'
তার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
তিনি মনে করেন, 'অর্থ উপদেষ্টার প্রথম কাজ হওয়া উচিত ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা আনা এবং দ্রুত কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ দেওয়া।'
আহসান এইচ মনসুরের ভাষ্য, অর্থ উপদেষ্টা কী কী সংস্কার আনতে চান এবং সেগুলো বাস্তবায়নে কত সময় লাগবে তা বিস্তারিত জানিয়ে ১০০ দিনের অগ্রাধিকার কর্মপরিকল্পনার রূপরেখা দিতে হবে।
'কর্মপরিকল্পনা হওয়া উচিত বইয়ের সূচির মতো। আর্থিক সংস্কারের মধ্যে কর, ভ্যাট ও কাস্টমসসহ রাজস্ব খাতের সংস্কারের পাশাপাশি বাণিজ্য সহজ করা ও উন্নয়নশীল দেশ থেকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় আসার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে।'
এ ধরনের সংস্কারের ফলে রাজস্ব আয় বাড়লে শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে আরও বেশি খরচ করা সম্ভব হবে।
আহসান এইচ মনসুর ব্যাংকিং এবং পুঁজিবাজার, বন্ড মার্কেট ও বিমা খাতের জন্য দুটি আলাদা কমিশন বা টাস্কফোর্স গঠনের পরামর্শ দেন। ব্যাংকিং কমিশন প্রতিটি ব্যাংকের ব্যালান্স শিট ও অডিট রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে শূন্যপদ পূরণ করা অর্থ উপদেষ্টার প্রথম কাজ হওয়া উচিত।'
'রাজনৈতিক বিবেচনায় যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদের পাশাপাশি অদক্ষ ও দুর্নীতিবাজদের অপসারণ আরেকটি অগ্রাধিকার।'
তার মতে, 'নিত্যপণ্যের বাজারে চাঁদাবাজি ঠেকানো গেলে পণ্যের দাম কমতে পারে।'
প্রস্তাবিত প্রম্পট কারেকটিভ অ্যাকশন (পিসিএ) ফ্রেমওয়ার্ক প্রবর্তনকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জ। এটি শুধু অর্থ উপদেষ্টার কাজ নয়, পুরো সরকারের কাজ।'
তিনি আরও বলেন, 'সরবরাহ ব্যবস্থার পাশাপাশি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার জোরদার ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা অন্যান্য অগ্রাধিকার।'
সর্বশেষ অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগ ও আমদানি-রপ্তানি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সেলিম রায়হান আরও বলেন, 'অর্থ উপদেষ্টার উচিত বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করা। কারণ, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা খুবই উদ্বিগ্ন।'
'অর্থ উপদেষ্টাকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া উচিত। এটি বাজার স্থিতিশীল করতে বড় ভূমিকা পালন করে,' জানিয়ে এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, 'প্রস্তাবিত বাজেট ঢেলে সাজানো দরকার। বস্তুনিষ্ঠ বাজেট ও বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নেওয়ার এখনই আসল সময়। কিছু অবাস্তব পরিসংখ্যান দিয়ে বাজেট দেওয়া হয়েছে।'
Comments