বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কের কর সুবিধা তুলে নেওয়ায় ধাক্কা

এই উদ্যোগটি এমন সময়ে নেওয়া হচ্ছে যখন সরকার খরচ জোগাতে ও ঋণের ওপর নির্ভরতা কমাতে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর চাপে আছে।
বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল
অলঙ্করণ: আনোয়ার সোহেল/স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

দেশের বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইজেড) ও হাইটেক পার্কের বিনিয়োগকারী ও ডেভেলপাররা আগামী অর্থবছর থেকে তাদের আয়ের ওপর ১০ বছরের কর মওকুফের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় আসার পর সরকার বর্তমানের কর সুবিধা ও ভর্তুকি দিতে পারবে না। দেশের কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে ও বৈশ্বিক কর হারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে পর্যায়ক্রমে সব খাতে কর ছাড়ের ব্যবস্থা তুলে নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে।

গত ৬ জুন নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণায় অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী কর ছাড়ের সুবিধা তুলে নেওয়ার নির্দেশনা দেন। সে হিসেবে সরকার শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত হাইটেক পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকেই কর ছাড় দিতে যাচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কর ছাড়ের সুবিধা থেকে বেরিয়ে আসতে এনবিআর নতুন অর্থবছরের জন্য সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দিচ্ছে।'

এই উদ্যোগটি এমন সময়ে নেওয়া হচ্ছে যখন সরকার খরচ জোগাতে ও ঋণের ওপর নির্ভরতা কমাতে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর চাপে আছে।

বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বনিম্ন রাজস্ব-জিডিপি অনুপাতের দেশগুলোর একটি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) চার দশমিক সাত বিলিয়ন ডলার ঋণের অংশ হিসেবে সরকারকে জিডিপির শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ কর আদায় বাড়ানোর শর্ত দিয়েছে।

সারাদেশে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার মাধ্যমে শিল্পায়ন, রপ্তানি আয় বাড়ানো ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সরকারের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) ইতোমধ্যে ২৯টি বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে আটটি চালু হয়েছে।

এ ছাড়াও, বেসরকারি হাইটেক পার্ক আছে ১৩টি।

বর্তমানে, বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাই-টেক পার্কগুলোয় বিনিয়োগকারীরা তাদের কার্যক্রমের প্রথম বছর থেকে শুরু করে পরবর্তী ১০ বছরের জন্য কর ছাড়ের সুবিধা পেয়ে আসছে। তারা প্রথম তিন বছর পুরোপুরি কর মওকুফের সুবিধা পাচ্ছেন।

তারা চতুর্থ বছরে ৮০ শতাংশ, পঞ্চম বছরে ৭০ শতাংশ ও ষষ্ঠ বছরে ৬০ শতাংশ কর ছাড় পাচ্ছেন। দশম বছরে ২০ শতাংশ কর ছাড়ের আগে এটি পরবর্তী প্রতি বছরে ১০ শতাংশ পয়েন্ট কর কম দেবেন।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ ও নির্মাণ সামগ্রী আমদানিতে শূন্য শুল্ক সুবিধা হারিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রতিষ্ঠানগুলোকে এক শতাংশ শুল্ক দিতে হবে।

এনবিআরের তথ্য অনুসারে, ২০২১-২২ অর্থবছরে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কগুলো যৌথভাবে চার হাজার ২২ কোটি টাকা কর ছাড়ের সুবিধা পেয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকার প্রত্যক্ষ কর হিসেবে সব খাতে মোট এক লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা ছাড় দেবে।

কর সুবিধা তুলে নেওয়ায় বিনিয়োগকারীরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, এটি এ খাতের প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করবে। দেশি-বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে এ ধরনের নীতিগত পরিবর্তন সুফল দেবে না।'

তিনি মনে করেন, যেসব বিনিয়োগকারী ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চলে কারখানা করেছেন বা পরিকল্পনা করছেন, তারা নিরুৎসাহিত হবেন।

তার অভিযোগ, বেজার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় বিনিয়োগকারীদের যেসব সুবিধা দেওয়ার কথা ছিল তা তুলে নিয়ে খারাপ সংকেত দেওয়া হলো।

রূপালী চৌধুরী আরও বলেন, 'বিশ্বে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশই একমাত্র জায়গা নয়। তাই বিনিয়োগকারীরা যেসব দেশে বেশি সুবিধা পাবেন সেখানে চলে যাবেন।'

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল তিন বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালের সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার থেকে তা ১৪ শতাংশ কম।

ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মোহাম্মদ জাভেদ আখতার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নতুন নিয়ম বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে ভুল বার্তা দেবে। এতে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমে যাবে।'

দেশে প্রতি বছর দুই থেকে তিন বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ আসে। ভিয়েতনামে আসে ১৫ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হাই-টেক পার্কের উদ্দেশ্য এখনো পূরণ না হওয়ায় কর সুবিধা চালু রাখার অনুরোধ জানিয়ে এনবিআরকে চিঠি দেওয়া হবে।'

'নতুন নিয়মে এখানকার প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে,' বলেও মনে করেন তিনি।

সিটি গ্রুপের প্রধান উপদেষ্টা পবন চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কর সুবিধার ওপর বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। এটি তুলে নেওয়া হলে এর অগ্রগতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।'

এই শিল্পপ্রতিষ্ঠানের একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্ক আছে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের সভাপতি রাসেল টি আহমেদ ডেইলি স্টারকে জানান, হাইটেক পার্কগুলো এমনিতেই বিনিয়োগের পেতে হিমশিম খাচ্ছে।

তিনি মনে করেন, 'এ ধরনের উদ্যোগ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।'

বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আয়কর, শুল্ক ও মূল্য সংযোজন করের ওপর বিদ্যমান সুবিধা ধরে রাখার জন্য ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও এনবিআরকে অনুরোধ করা হয়েছে।'

পরিকল্পিত শিল্পায়ন বিবেচনায় ও বিনিয়োগ প্রবাহ ত্বরান্বিত করতে সরকার এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানান তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

7h ago