উচ্চ মূল্যস্ফীতি

বই বিক্রি কমায় বিপাকে প্রকাশকরা

বই বিক্রি
রাজধানীর শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটে এক বইয়ের দোকানে এক ক্রেতা। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

মনের খোরাক মেটায় বই। তাই সময় পেলে কিংবা অবসরে মানুষ বই পড়েন। এটা তাদের দীর্ঘদিনের অভ্যাস। কিন্তু চলমান মূল্যস্ফীতিতে বই কেনা ও পড়ার অভ্যাস যেন বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে। এমনিতেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সবকিছুর দাম বাড়তি। তাই বেশিরভাগ মানুষ খরচ বাঁচাতে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোই আগে কিনছেন। ফলে, ব্যয়ের তালিকা থেকে বাদ পড়ছে বই।

প্রকাশকরা জানিয়েছেন, পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্যান্য সৃজনশীল বইয়ের বিক্রি ও চাহিদা কমেছে। ২০২২ সালের তুলনায় চলতি বছরে সৃজনশীল বইয়ের বিক্রি ২০ থেকে ৩৫ শতাংশ কম। চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে অন্যান্য পণ্যের মতো বইয়ের দামও বেড়েছে। ফলে, খরচ কমাতে অনেকে আর আগের মতো বই কিনছেন না।

প্রকাশকরা বলছেন, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের মতো অন্যান্য বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কারণে কাগজের দাম বেড়েছে। এতে, বইয়ের দাম বাড়াতে হয়েছে। একসঙ্গে মুদ্রণ, বাইন্ডিং ও শ্রমিক খরচসহ অন্যান্য খরচ গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রায় দ্বিগুণ।

এ ছাড়া, চলতি বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রত্যাশা অনুযায়ী বই হয়নি বলেও জানিয়েছেন প্রকাশকরা।

দেশের প্রকাশকদের বই বিক্রির অন্যতম প্রধান মাধ্যম হলো বইমেলা এবং মেলাতেই সর্বোচ্চ সংখ্যক বই বিক্রি হয়ে থাকে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা জয়া দেব দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তার দুই সন্তান স্কুলে পড়ছে। আগে দোকান থেকে বই কিনলেও এ বছর কেবল বইমেলা থেকে তাদের জন্য কয়েকটি বই কিনেছিলেন।

এরপর আর বই কেনা হয়নি বলেও জানান তিনি।

জয়া বলেন, 'বইয়ের দাম অনেক বেড়েছে। চাইলেও আগের মতো বই কেনা সম্ভব না।'

বই বিক্রি
খরচ কমাতে অনেকে আর আগের মতো বই কিনছেন না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

দেশের অন্যতম শীর্ষ প্রকাশক 'প্রথমা'র বই বিক্রি ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কমেছে। এর মধ্যে কথাসাহিত্যের বইয়ের বিক্রি বেশি কমেছে।

'পাঠকদের বড় অংশ মধ্যবিত্ত। তারা পছন্দমতো বই কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন' উল্লেখ করে 'প্রথমা'র ব্যবস্থাপক জাকির হোসাইন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জীবনযাত্রার খরচ ও মূল্যবৃদ্ধির ফলে আগে যিনি পাঁচটি বই কিনতেন, এখন তিনি তিনটি বা এর চেয়েও কম বই কিনছেন। এটাই স্বাভাবিক।'

এ দিকে, গত অর্থবছরে বাংলাদেশের ভোক্তা মূল্য সূচক বেড়ে নয় দশমিক শূন্য দুই শতাংশ হয়েছে, যা গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ গড় মূল্যস্ফীতি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, চলতি অর্থবছরেও এই প্রবণতা অব্যাহত আছে এবং নভেম্বরে গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে নয় দশমিক ৪২ শতাংশে।

অপর শীর্ষ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান 'অন্যপ্রকাশ'র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বই অন্য যেকোনো পণ্যের মতোই একটি পণ্য। তবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে সৃজনশীল বই বা পাঠ্যক্রমের বাইরের বইয়ের বিক্রি ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কমেছে।'

'বিশেষ করে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বইয়ের বিক্রি কমতে শুরু করে। কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ায় বইয়ের দামও বেড়েছে,' বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তার মতে, মূল্যস্ফীতির কারণে প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। মানুষের আয় আনুপাতিক হারে বাড়েনি। তারা বইয়ের মতো জিনিস কেনা থেকে বিরত আছেন।

পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রকাশকরা বই প্রকাশের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছেন জানিয়ে তিনি আশা করেন, 'শিগগিরই এ সংকট কেটে যাবে।'

২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে চলতি ডিসেম্বর পর্যন্ত 'সময় প্রকাশন'র বিক্রি কমেছে ২০ শতাংশ।

প্রতিষ্ঠানটির প্রকাশক ফরিদ আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা যখন ধীরে ধীরে করোনার প্রভাব কাটিয়ে উঠছিলাম ঠিক তখনই ইউক্রেন-রাশিয়ার সংঘাত ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রকাশনা শিল্পে প্রভাব ফেলেছে।'

তিনি আরও বলেন, 'বাংলাদেশে বইকে অপরিহার্য বলে মনে করা হয় না। মানুষ প্রথমে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনছেন, তারপর হয়তো বইয়ের কথা ভাবছেন। যেহেতু সবকিছুর দাম বেশি তাই অনেকে খরচ কমাতে বই কেনা কমিয়ে দিয়েছেন।'

'আগামী প্রকাশনী'র স্বত্বাধিকারী ওসমান গণির মতে, সৃজনশীল বা স্কুল পাঠ্যক্রমের বাইরের বই বিক্রি ২০ শতাংশ কমেছে।

তিনি বলেন, 'এখন দোকান বা শোরুমের চেয়ে অনলাইনে বই বেশি বিক্রি হচ্ছে।'

এ বছরের একুশে বইমেলায় 'আগামী প্রকাশনী' ১২৯টি নতুন বই প্রকাশ করেছিল। আগামী বইমেলায় শতাধিক বই প্রকাশের পরিকল্পনা আছে বলে জানান তিনি।

ওসমান গণি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বইমেলার সময় এলে কাগজের চাহিদা বেড়ে যায়। এই সুযোগে কিছু ব্যবসায়ী কাগজের দাম বাড়ান। এতে প্রকাশকদের সমস্যায় পড়তে হয়।'

তাই এ সময় কাগজের ওপর আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

'পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুল হাসান শায়ক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একুশে বইমেলায় ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে বিক্রি কমেছে শূন্য দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।'

শীর্ষস্থানীয় বই বিক্রেতা ও প্রকাশক বাতিঘরের স্বত্বাধিকারী দীপঙ্কর দাশও ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন, ক্রমাগত মূল্যস্ফীতি ও দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে সৃষ্ট জটিলতার মধ্যে বই বিক্রি কমেছে বলে জানিয়েছেন।

পাবলিশার্স উইকলির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে ২০২২ সালের একই সময়ের তুলনায় ২০২৩ সালের প্রথম নয় মাসে সার্কানা বুকস্ক্যানের দোকানগুলোয় ছাপা বইয়ের বিক্রি চার দশমিক এক শতাংশ কমেছে।

Comments

The Daily Star  | English

Polythene ban: A litmus test for will and eco-innovation

Although Bangladesh became the first country in the world to announce a complete ban on the use of polythene bags in 2002, strict enforcement of the much-lauded initiative has only started taking shape recently.

15h ago