মোবাইল নেটওয়ার্ক থেকে রেডিয়েশনের ‘অমূলক ভয়’

অপারেটররা বলছে, বিশেষ করে ঢাকা ও অন্যান্য মেট্রোপলিটন এলাকার ভবন মালিকরা টাওয়ারের জন্য ছাদ ইজারা দিতে চাচ্ছেন না। কারণ, তাদের আশঙ্কা অ্যান্টেনার সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা আরও রেডিয়েশনের মুখে ফেলবে।
রেডিয়েশন, মোবাইল অপারেটর, গ্রামীণফোন, রবি,
স্টার ফাইল ফটো

মোবাইল অপারেটরের টাওয়ার থেকে নির্গত রেডিয়েশন নিয়ে স্বাস্থ্য ঝুঁকির 'অমূলক ভয়' ভালো সেবার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অপারেটর কোম্পানিগুলোর জন্য। যদিও এই আশঙ্কাকে বৈজ্ঞানিকভাবে ভিত্তিহীন বলছেন বিশেজ্ঞরা।

অপারেটররা বলছে, বিশেষ করে ঢাকা ও অন্যান্য মেট্রোপলিটন এলাকার ভবন মালিকরা টাওয়ারের জন্য ছাদ ইজারা দিতে চাচ্ছেন না। কারণ, তাদের আশঙ্কা অ্যান্টেনার সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা আরও রেডিয়েশনের মুখে ফেলবে।

মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ারে রেডিওফ্রিকোয়েন্সি ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডস (ইএমএফ) ব্যবহার করা হয়। এটি এক ধরণের নন-আয়নাইজিং ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন, যা ডিএনএ'র ক্ষতি করার মতো পর্যাপ্ত শক্তি রাখে না এবং সরাসরি ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে না।

মানবদেহে রেডিও তরঙ্গের কয়েকটি পরিচিত প্রভাবের একটি হলো শূন্য দশমিক দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধি। কিন্তু, কোনো সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নেই, আর তা নিশ্চিত করতে এখনো গবেষণা চলছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেন, 'একটি টাওয়ার থেকে যে পরিমাণ রেডিয়েশন নির্গত হয়, তাতে কোনো সমস্যা হয় না।'

তিনি বলেন, 'আপনি আলো ছাড়া পড়তে পারবেন না। আবার খুব বেশি আলো চোখের ক্ষতি করতে পারে। টাওয়ারের অ্যান্টেনা থেকে ন্যূনতম মাত্রার রেডিয়েশন দেওয়া হয় এবং সব ধরনের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে এগুলো নকশা করা হয়। যেন মানুষ কোনো ধরনের সমস্যা ছাড়াই ফোনে কথা বলতে পারেন।'

'যারা এ নিয়ে উদ্বিগ্ন, তারা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। বিশ্ব যখন ওয়ান-জি বা টু-জি চালু করে তখনো তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন, তারা এখনো আতঙ্কের মধ্যে আছেন। কিন্তু, বিশ্ব সিক্স-জি চালু করতে প্রস্তুত। তাই তারা যদি সঠিক হতেন, তাহলে প্রযুক্তির অগ্রগতি হতো না,' যোগ করেন তিনি।

তিনি মনে করেন, যে ভবন বা অবকাঠামোতে একটি মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ার আছে, সেখানে রেডিয়েশন হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।

তিনি বলেন, 'টর্চ লাইট আমাদের সেই বস্তুটি দেখাতে পারে, যেখানে আমরা ফোকাস বা নির্দেশনা দেই। একইভাবে, অ্যান্টেনাতে দূরের অঞ্চলকে ফোকাস করা বা নির্দেশনা থাকে।'

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) উপ-পরিচালক ড. শামসুজ্জোহা বলেন, 'এক্স-রে, গামা রশ্মি এবং অতিবেগুনি রশ্মি আয়োনাইজিং রেডিয়েশন হিসেবে মানবদেহের ক্ষতি করতে পারে।'

অপারেটর ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে টাওয়ার চালু করা তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অনেক সময় টাওয়ার বসাতে গিয়ে অপারেটর কর্মীদের আবাসিক কল্যাণ সমিতি বা বিল্ডিং কমিউনিটির বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হয়েছে।

অপারেটররা বলেছে, তারা মনে করে টাওয়ার বসাতে সবুজ সংকেত পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। এমনকি সরকারি সংস্থাগুলো থেকেও।

যেমন- বিটিআরসির একজন কর্মকর্তা বলেছেন, রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিটিআরসির নতুন অফিসে বিভিন্ন অপারেটরের নেটওয়ার্ক অবকাঠামো স্থাপনে অনুমতি দিতে সরকারি সংস্থাগুলোর অনুমোদন পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এটি আগামী মাসে চালু হওয়ার কথা আছে।

বিটিআরসির প্রকৌশল ও পরিচালনা বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. এহসানুল কবির সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, 'সরকারি ভবনে টাওয়ার বসানোর ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার মুখে পড়তে হয়, সেগুলো গণপূর্ত অধিদপ্তর ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে সৃষ্টি হয়।'

তিনি বলেছিলেন, 'আমরা প্রতিটি পদক্ষেপে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি।'

পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও কর্ণফুলী টানেলের নেটওয়ার্ক অবকাঠামো স্থাপনে বিটিআরসি এখনো অনুমোদন পায়নি।

তিনি বলেন, বিটিআরসি প্রতি মাসে বিভিন্ন এলাকা থেকে টাওয়ার বসানোর জন্য ২০টির বেশি অনুরোধ পায়। আবার রেডিও তরঙ্গের ভয়ে প্রায় ৫-৭টি অনুরোধ আসে টাওয়ার অপসারণের জন্য।

'আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি ও পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। দেশের দুর্গম এলাকায় নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করতে পারব বলে আমরা মনে করছি,' বলেন তিনি।

রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার মোহাম্মদ শাহেদুল আলম বলেন, 'ভিত্তিহীন আশঙ্কার কারণে প্রতি বছর আমরা বেশ কিছু টাওয়ার স্থানান্তর করি।'

অপারেটরদের মতে, রেডিয়েশনসহ অন্যান্য আশঙ্কার কারণে তাদের প্রতি বছর প্রায় ২০০টি টাওয়ার ভেঙে ফেলতে হয়।

জানা গেছে, টেলিকম নিয়ন্ত্রকরা দীর্ঘদিন ধরে সারা দেশে জরিপ চালাচ্ছে। তাদের জরিপে দেখা গেছে, টাওয়ারের রেডিয়েশনের মাত্রা ইএমএফ এক্সপোজারের অনুমোদিত সীমার চেয়ে অনেক কম।

ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন নন-আয়োনাইজিং রেডিয়েশন প্রোটেকশন (আইসিএনআইআরপি), ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের মান অনুযায়ী, ইএমএফ এক্সপোজারের অনুমোদিত সীমা প্রতি মিটার বর্গে ২.১০৬ মিলিওয়াট (এমডাব্লিউ/এম ২)।

বিটিআরসি ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকার ১২টি এলাকার ৩০টি স্থানে মাঠ জরিপ চালিয়েছে। জরিপে দেখা গেছে, মোবাইল অপারেটরদের সেল টাওয়ার থেকে নির্গত ইএমএফ রেডিয়েশন সীমার অনেক নিচে।

সবচেয়ে বেশি রেডিয়েশন পাওয়া গেছে মালিবাগ চৌধুরীপাড়া ও আশপাশের এলাকায়। যাইহোক, সেই এলাকার টাওয়ার থেকে ইএমএফ নির্গমনের মাত্রা ছিল আইসিএনআইআরপি নির্ধারিত অনুমোদিত সীমার ২০ ভাগের ১ ভাগ।

গ্রামীণফোনের হেড অব নেটওয়ার্ক সার্ভিসেস একেএম আল-আমিন বলেন, শুধু সাধারণ মানুষ নয়, সরকারি প্রকল্প পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ তাদের পরিকল্পনায় ইউটিলিটি সেবার পাশাপাশি টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্কের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে না।

শুধু ঢাকা শহরে গ্রামীণফোনকে আরও ৩০০, রবির ১০০ ও বাংলালিংককে ৬২টি টাওয়ার বসাতে হবে। তবে, তারা বলেছে- সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা কাছ থেকে সম্মতি পাওয়া যাচ্ছে না।

আল-আমিন বলেন, 'সবাই ভালো নেটওয়ার্ক চান, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ তাদের জায়গায় টাওয়ার বসাতে দিতে চান না। এই সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। আমরা চাই সরকারি অবকাঠামো ও কৌশলগত প্রকল্পের নকশায় মোবাইল নেটওয়ার্ক স্থাপনের পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত করা হোক।'

Comments