বেড়েছে খরচ, কমেছে রমজানের পণ্য বিক্রি

রমজান, পণ্য, ইফতার, ভোজ্যতেল, নিত্যপণ্য,
স্টার ফাইল ফটো

আমদানি ব্যয়, ডলারের দাম ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধিতে রমজানে যেসব পণ্যের চাহিদা বাড়ে সেগুলোর দাম গত রমজানের তুলনায় আসছে রমজানের আগে বেশ বেড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিকে এসব পণ্যের বিক্রিও বেশ কমেছে।

রমজানে চাহিদার শীর্ষে থাকা পণ্যগুলো হলো- ছোলা, মসুর ডাল, মটর ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি ও খেজুর।

ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ ও দেশের খুচরা ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর রমজান শুরুর আগের সপ্তাহে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ছোলার দাম ছিল ৭০-৭৫ টাকা। এ বছরে একই সময়ে ছোলা প্রতি কেজি ৮৫-৯৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গত বছর রমজান শুরুর আগে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ৭৮-৮০ টাকা। সেটি এখন বিক্রি হচ্ছে ১১৫-১২০ টাকায়।

গত রমজান শুরুর আগে ক্রেতাদের এক লিটার ভোজ্যতেল কিনতে ব্যয় হয়েছে ১৫৮-১৬৫ টাকা। এবার তা কিনতে হচ্ছে ১৮০-১৮৫ টাকায়। গত বছর এক কেজি মটর ডাল কিনতে হয়েছে ৫০-৬০ টাকায়, এবার তা কিনতে হচ্ছে ৭০-৭৫ টাকায়।

গত রমজানে প্রতি কেজি মোটা মসুর ডাল কিনতে ব্যয় হয়েছে ৯৫-১০০ টাকা। এবার কিনতে হচ্ছে ১৩০-১৩৫ টাকা। মানভেদে যে খেজুর গত বছর প্রতি কেজি ৫০০-৬০০ টাকা ছিল, এবার সেই খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৭০০-৮০০ টাকায়।

বাংলাদেশে ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের মে মাসে দেশে এক ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১০৬ টাকা।

আমদানিকারকরা বলছেন, কয়েকটি পণ্যের ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশে আমদানি ব্যয় বাড়ায় ক্রেতারা এর সুফল পাচ্ছে না।

রাজধানীর তেজকুনিপাড়া এলাকার বাসিন্দা জিহাদ হোসেন বলেন, গত বছর পুরো রমজানের জন্য ছোলা, মসুর ডাল, মটর ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি, ব্রয়লার মুরগি, মাছ ও কিছু ফলসহ বিভিন্ন প্রকার মসলা মিলিয়ে প্রায় ৯ হাজার টাকার পণ্য কিনেছিলেন। এবার ব্যয় করেছেন ৫ হাজার টাকা। বাড়তি দামের কারণে তিনি এবার পরিমাণে কম কিনেছেন।

এই বেসরকারি চাকরিজীবী জানান, এক ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে ২ রুমের একটি ভাড়া ফ্ল্যাটে থাকেন তিনি। বেতন পান ৩৫ হাজার টাকা।

রাজধানী ঢাকার মিরপুরের ইস্টার্ন হাউজিং এলাকার বাসিন্দা ও বেসরকারি চাকরিজীবী লাইজুর রহমান মাসুদ জানান, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিতে সংসার খরচ চালাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। তাই এবারের রমজানে প্রথমবারের মতো তারা পারিবারিকভাবে ইফতার আইটেম না খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ইফতারের সময় খেজুরের পাশাপাশি ভাত বা খিুচুড়ি খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

রহমান জানান, ৭ সদস্যের পরিবারে তার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা বাবার পাওয়া মাসিক মুক্তিযোদ্ধাভাতা ও তার বেতনই পরিবারের মূল আয়ের উৎস।

বগুড়া জেলার গাবতলী থানার জাত হলিদা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুলাহ আল মামুন বগুড়া শহরের একটি মোবাইলফোন বিক্রির দোকানে সেলসম্যান হিসেবে ৮ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন।

মামুন জানান, তাদের ৬ সদস্যের পরিবারে আয়ের ব্যক্তি তিনি ও তার বাবা। রমজান শুরুর আগে গত বছর যে পরিমাণ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনেছিলেন, এবার দাম বৃদ্ধির কারণে ৪০ শতাংশ পণ্য কম কিনেছেন।

তিনি বলেন, বর্তমানে যে টাকা বেতন পান, তা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে। তাই কম কিনেছেন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ছেলেকে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করিয়েছেন। তার পড়াশোনার বাড়তি খরচ মামুনের ওপর আলাদা চাপ তৈরি করেছে।

মামুন জানান, গত বছর রমজান শুরুর আগে পুরো রমজানের জন্য ৫ কেজি আটা কিনেছিলেন। দাম বৃদ্ধির কারণে এবার কিনেছেন ২ কেজি। গত বছর শরবত ও অন্যান্য উপকরণ তৈরির জন্য ৩ কেজি চিনি কিনেছিলেন, এবার ১ কেজি কিনেছেন। গত বছর ছোলা কিনেছিলেন ৪ কেজি এবার কিনেছেন ২ কেজি।

'যেভাবেই হোক এটা দিয়েই ম্যানেজ করতে হবে,' বলেন তিনি।

চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা আরিফ বিন সাইদুল হক জানান, প্রতি বছর রমজান শুরুর সপ্তাহখানেক আগে ১ মাসের বাজার একবারে করলেও এবার এখনো পর্যন্ত করা হয়নি।

কারণ হিসেবে তিনি বলেন, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ও তার অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা খরচ চালাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। তাই এবার একসঙ্গে ১ মাসের বাজার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

তিনি বলেন, 'প্রতিদিন ইফতারের জন্য যেটুকু না হলেই নয় সেই পরিমাণ আইটেমের বাইরে কোনো শপ থেকে কিনে ইফতার করব।'

বিক্রি কমেছে ৩০-৪০ শতাংশ

ব্যবসায়ীরা বলছেন, রোজাকে কেন্দ্র করে আগে শবে বরাতের পর থেকে পুরোদমে বেচাকেনা শুরু হতো। এবার বাজারে সেই চাপ নেই।

দেশের দুই বড় শহর ঢাকা-চট্টগ্রামের খুচরা ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন, দাম বাড়ার কারণেই গত রমজান শুরুর এক সপ্তাহ আগের বিক্রির সঙ্গে যদি চলতি রমজানের তুলনা করা হয় তাহলে তাদের বিক্রি ৩০-৪০ শতাংশ কমেছে।

রাজধানী ঢাকার অন্যতম বড় একটি কিচেন মার্কেটের ইয়াসিন জেনারেল স্টোরের খুচরা ব্যবসায়ী মনোয়ার হোসাইন বলেন, রমজানকেন্দ্রীক নিত্যপণ্যের বিক্রি গত বছরের তুলনায় এ বছর কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে।

একই বাজারের খুচরা বিক্রেতা মোহাম্মদ বাবলু বলেন, রমজানকেন্দ্রীক নিত্যপণ্যের বিক্রি গত বছরের তুলনায় এ বছর ৪০ শতাংশ কমেছে।

মৌলভীবাজারের ভোজ্যতেল ও চিনি ব্যবসায়ী আবুল হাসেন ও গোলাম মাওলা জানান, গত রমজানের তুলনায় এবারের রমজানে তাদের বিক্রি ৩০-৩৫ শতাংশ কমেছে।

চট্টগ্রামের হামজারবাগ এলাকার ফুলতাজ সুপার শপের ম্যানেজার মোহাম্মদ হাসেমও প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেন।

মুরগির বাজার অস্থির

বর্তমানে ব্রয়লার মুরগি উৎপাদন খরচের চেয়ে দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বাজারে মঙ্গলবার প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয় ২৬০ থেকে ২৮০ টাকা। দেড় থেকে দুই মাসের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম হয়েছে দ্বিগুণ।

সরকারি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বলছে, দাম ২০০ টাকার বেশি হওয়া অযৌক্তিক।

কারণ, খাবারসহ অন্যান্য ব্যয় বৃদ্ধির পরও এক কেজি ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ করপোরেট প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা। আর প্রান্তিক খামারি পর্যায়ে খরচ ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা।

বাড়তি দামের কারণে চাহিদা কমতে পারে ২০ শতাংশ

বাজারে পণ্য মূল্য বেশি থাকায় আসন্ন রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা আগের বছরের তুলনায় ২০ শতাংশ কমতে পারে। নিত্যপণ্যের দাম ও বাজার পরিস্থিতি নিয়ে গত রোববার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের টাস্কফোর্সের বৈঠকে এমন আভাস দেওয়া হয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, গম আমদানি কমে যাওয়ায় আটার রুটি ও বিস্কুট তৈরিতে ইতোমধ্যে ভোজ্যতেল ও চিনির ব্যবহার কমে গেছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে গত সাড়ে ৮ মাসে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে গমের মোট আমদানি হয়েছে ২১ দশমিক ৫৮ লাখ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে গম আমদানি হয়েছিল এর প্রায় দ্বিগুণ ৪০ দশমিক ১২ লাখ টন।

গম আমদানি কম হওয়ায় ভোজ্যতেলের ব্যবহার কমবে বলে আশা করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

দেশে বর্তমানে ৩ লাখ ২ হাজার ১৬০ টন ভোজ্যতেলের মজুদ আছে। রমজানের সাধারণ চাহিদার চেয়ে মজুদের পরিমাণ কিছুটা বেশি আছে।

তবে ওই বৈঠকে জানানো হয়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে বর্তমান চিনির মজুদ রমজানের মোট চাহিদার চেয়ে কম।

Comments

The Daily Star  | English
Dense fog disrupts flight operations

Dhaka airport: APBn at odds with aviation force over security duties

A conflict has emerged between the Aviation Security Force (AVSEC) and the Airport Armed Police Battalion (APBn) over security responsibilities at Hazrat Shahjalal International Airport (HSIA). APBn claims that AVSEC took control of their office on October 28, hindering their ability to perform duties effectively

45m ago