আইএমএফের শর্ত: যা জানা গেল
বাংলাদেশকে সম্ভাব্য সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সামগ্রিক সংস্কারের জন্য যেসব শর্ত দিয়েছে তা বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সঙ্গে সমন্বয় করবে।
সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশে আসা আইএমএফের পরিদর্শনকারী দলটি বিশ্বব্যাংক ও এডিবির সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার বৈঠক করেছে। এই আলোচনার বিষয়ে অবগত ৩ জন পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে এই তথ্য জানান।
ঢাকায় ইন্টারকন্টিনেন্টালে অনুষ্ঠিত বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের একজন বলেন, 'যদিও বাংলাদেশের অর্থনীতি শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের মতো খারাপ অবস্থানে নেই, তবে বিপদের আশঙ্কা তৈরি হয়ে গেছে। ফলে, সংস্কারমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার এখনই সময়।'
বিশ্বব্যাংক থেকে ১ বিলিয়ন ডলার এবং এডিবি থেকে ৮০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, ঋণ অনুমোদন ও তহবিল বিতরণের জন্য সরকারকে আগে থেকে কিছু উদ্যোগ নিতে হবে এবং সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য কাজ শুরু হয়েছে।
আইএমএফের ঋণের জন্যও আগে থেকে কিছু উদ্যোগ নিতে হবে, যা এখনো নির্ধারণ করা হয়নি।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, 'যদি ২ দাতা সংস্থা একই কাজ করে, তাহলে তা সময়ের অপচয়।'
তিনি বলেন, 'এসব ঋণের ক্ষেত্রে আপনি দুইয়ে দুইয়ে যোগ করে ৫ পেতে চান। যদি উভয় দাতা একই সমস্যার বিষয়ে কাজ করে তাহলে দুয়ের সঙ্গে শূন্য যোগ করতে হবে এবং আপনি পাবেন শুধুমাত্র ২।'
বিশ্বব্যাংক তাদের ঋণের জন্য ১২টি শর্ত নির্ধারণ করেছে। এই অর্থবছরে তাদের ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার কথা রয়েছে।
তাদের শর্তের মধ্যে রয়েছে, জাতীয় শুল্ক নীতি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভার নেওয়া, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে সব কর অঞ্চলে উৎসে আয়কর কাটার জন্য স্বয়ংক্রিয় চালান ব্যবস্থা চালু করা এবং ই-গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট সিস্টেমের সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন।
অন্যান্য শর্তের মধ্যে রয়েছে, এই অর্থবছরে ক্যাশ ট্রান্সফার প্রোগ্রামগুলো ৫ গুণেরও বেশি সম্প্রসারণ করা, বিদ্যুৎ সঞ্চালন প্রকল্পে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেওয়া ও প্রতিযোগিতামূলক বিডিং নিশ্চিত করা এবং প্রধান সামাজিক সুরক্ষা প্রোগ্রামের সুবিধাভোগী শনাক্তকরণের জন্য ডেটাবেস ব্যবহার করা।
বিশ্বব্যাংক ব্যাংকিং খাতের পরিস্থিতি উন্নয়নেও বিশেষ জোর দিয়েছে।
এডিবি অর্থায়নের পূর্ববর্তী উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে শরিয়া-সম্মত ট্রেজারি উপকরণ প্রবর্তন, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের অধীনে লোকসানে থাকা চিনিকলগুলো বন্ধ করে দেওয়া, এই বছরের মধ্যে সংসদে নতুন আয়কর কোড পাস করা এবং বার্ষিক ৪ লাখ টাকার বেশি ব্যয় যারা করেন তাদের জন্য বাধ্যতামূলক রিটার্ন জমা দেওয়া।
এডিবি বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেটভিত্তিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে ভিত্তি ক্ষয় ও মুনাফা স্থানান্তর, স্থানান্তর মূল্য ও পুঁজিবাজারে ডেরিভেটিভ লেনদেনের মতো নতুন এবং আসন্ন সমস্যা মোকাবিলা করতে বলেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ভ্যাট ও আয়কর বিভাগের মধ্যে তথ্য বিনিময়, ভ্যাট অডিট প্রবর্তন এবং একটি ঝুঁকি-ভিত্তিক অডিট ম্যানুয়াল গ্রহণের শর্তও দেওয়া হয়েছে।
ম্যানিলাভিত্তিক বহুপাক্ষিক এই ঋণদাতা সংস্থা আগামী অর্থবছর থেকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি এবং অ-উন্নয়নমূলক কর্মসূচির বাজেট একত্রিত করার আহ্বান জানিয়েছে। এ ছাড়া, অর্থবছরের মধ্যে মন্ত্রণালয়গুলোকে বরাদ্দ বৃদ্ধির অনুরোধ করা থেকে বিরত রাখা এবং প্রকল্পের প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে সার্বিকভাবে গুণমান উন্নত করার উদ্যোগ নিতে হবে।
আইএমএফ এখনো তাদের শর্ত চূড়ান্ত করেনি। তবে, তাদের ১০ সদস্যের স্টাফ মিশন ধারণা দিয়েছে যে তাদের শর্ত কেমন হতে পারে। তাদের শর্তের সঙ্গে অপর ২টি ঋণদাতার পূর্বে নেওয়া উদ্যোগের সদৃশতা রয়েছে বলেই দৃশ্যমান হচ্ছে।
শর্তগুলোর মধ্যে একটি হবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রাজস্ব এবং সামাজিক সুরক্ষা পরিকল্পনা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতের মতো সামাজিক ব্যয়ের জন্য সময়সীমার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ।
আরেকটি শর্ত হতে পারে সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন ও ভ্যাট আইন পাস করা এবং সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য কর্ম পরিকল্পনা করা।
কর ছাড় কমাতে হবে এবং জ্বালানির জন্য একটি শক্তির মূল্য নির্ধারণের সূত্র তৈরি করতে হবে, যাতে স্থানীয় পণ্যের দাম বিশ্ব বাজারের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়।
সত্যিকারের বাজারভিত্তিক বিনিময় হার ও সুদের হারের ক্যাপ আংশিক প্রত্যাহারও থাকবে শর্তের মধ্যে।
বিদ্যমান একাধিক বিনিময় হার রেমিট্যান্স প্রবাহে ক্ষতি করেছে উল্লেখ করে জাহিদ হোসেন বলেন, 'এটি মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার সুযোগ তৈরি করবে এবং আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।'
আইএমএফের আরেকটি শর্ত হতে পারে, কার্বন ট্যাক্স প্রবর্তন।
আইএমএফের ১০ সদস্যের দলটি আগামী ৯ নভেম্বর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে সাক্ষাতের মাধ্যমে তাদের সফর শেষ করবে। এরপর ওয়াশিংটন ডিসিতে ফিরে তাদের শর্তগুলো চূড়ান্ত করবে।
সরকার যদি তাদের দেওয়া পূর্বের উদ্যোগের বিষয়ে রাজি থাকে, তাহলে অর্থমন্ত্রী তা নিশ্চিত করে চিঠি পাঠাবেন। এরপরে ঋণ প্রস্তাবটি আইএমএফ বোর্ডে তোলা হবে। এই প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে আগামী জানুয়ারিতে।
বহুপাক্ষিক ঋণদাতাদের কাছ থেকে আগামী ৩ বছরে ৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার কথা রয়েছে।
শুধুমাত্র এই অর্থবছরেই বিনিময় হার ঠিক রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি সরবরাহ করেছে, যেখানে প্রতি মাসে আমদানি বিলের গড় ৬ বিলিয়ন ডলার।
জাহিদ হোসেন বলেন, 'সাধারণ মানুষ ভুগছে। আমরা সামষ্টিক অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে রয়েছি এবং এই চাপ আরও বাড়ছে। ব্যালেন্স অব পেমেন্ট বলেন, মূল্যস্ফীতি বলেন আর রিজার্ভের কথাই বলেন, কোথাওই চাপ কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এটা তো আমাদের স্বীকার করতে হবে এবং শ্রীলঙ্কার মতো সংকটে পড়ার আগে এখনই তার সমাধান খুঁজতে হবে।'
Comments