বাড়তি খরচ-সময়

১ বছরে পানগাঁও টার্মিনালে কনটেইনার পরিবহন কমেছে ৯২ শতাংশ

পানগাঁও
অলঙ্করণ: আনোয়ার সোহেল/স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমদানি-রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার নৌপথে ঢাকার পানগাঁও টার্মিনালে পরিবহনে আগ্রহ হারাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। সড়ক ও রেলপথে পরিবহন খরচের তুলনায় জাহাজ ভাড়ায় বেশি খরচ, অতিরিক্ত সময় ও পণ্য খালাসে কাস্টমস দীর্ঘসূত্রিতাসহ নানান কারণে বিপুল খরচে তৈরি টার্মিনালটি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারছে না।

মূলত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর পণ্য পরিবহনের চাপ কমাতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) ও বিআইডব্লিউটিএ'র যৌথ উদ্যোগে ২০১৩ সালে ১৫৪ কোটি টাকায় ঢাকার কেরানীগঞ্জে পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনালটি (আইসিটি) তৈরি করা হয়। লক্ষ্য ছিল ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যে সময় এবং খরচ কমাতে আমদানি-রপ্তানির জন্য পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

কিন্তু বাস্তবে অত্যধিক জাহাজ ভাড়া, কনটেইনার পরিবহন ও পণ্য খালাসে দীর্ঘ সময়ের কারণে টার্মিনালটির সক্ষমতার বড় অংশ এখনো অব্যবহৃত।

চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য বলছে, পানগাঁও টার্মিনালে বছরে এক লাখের বেশি কনটেইনার ওঠানামা করানোর সক্ষমতা আছে। গত জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কনটেইনার উঠানামার হিসাব লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ওই সময়ে টার্মিনালটিতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে নিয়ে যাওয়া আমদানি কনটেইনার নামানো ও বন্দরগামী রপ্তানি কনটেইনার জাহাজে উঠানো হয়েছে দুই হাজার ১৫০ টিইইউস বা একক।

গত বছর একই সময়ে কনটেইনার উঠানামার সংখ্যা ছিল ২৮ হাজার ৪৪৪ একক। অর্থাৎ বছরে কনটেইনার পরিবহন কমেছে ৯২ শতাংশ।

গত বছর জুলাইয়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পানগাঁওগামী একটি জাহাজ ভাসানচরের কাছে ডুবে যাওয়ার পর থেকেই মূলত বন্দর থেকে টার্মিনালটিতে কনটেইনার পরিবহন কমতে শুরু করে।

বন্দর ও টার্মিনালটির মধ্যে জাহাজ চলাচলের হিসাব লক্ষ্য করলে দেখা যায়, চলতি বছর প্রথম ১০ মাসে ১৬টি জাহাজ চলাচল করেছে। গত বছর একই সময়ে ছিল ১৪২টি।

অভ্যন্তরীণ এই নৌপথে কম সংখ্যক জাহাজ চলাচল কিংবা কম কনটেইনার পরিবহনের কারণ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কনটেইনার আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে বিদেশি কনটেইনার পরিবহনকারী প্রতিষ্ঠান বা মেইন লাইন অপারেটররা তাদের রাউটিং নেটওয়ার্কে পণ্য সরবরাহের গন্তব্য পানগাঁও আইসিটিকে উল্লেখ করতে চান না। এ কারণে এ পথে আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে না।'

এ ছাড়াও, ২০২২ সালে নৌ মন্ত্রণালয় নির্ধারিত জাহাজ ভাড়ার কারণেও অনেকে আগ্রহী হচ্ছেন না বলে মনে করেন তিনি।

একটি বিদেশি মেইন লাইন অপারেটর প্রতিষ্ঠানের এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে জানান, অতিরিক্ত জাহাজ ভাড়ার কারণে বিদেশি জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্য সরবরাহের গন্তব্য হিসেবে পানগাঁওকে রাখতে চান না।

তিনি আরও জানান, মন্ত্রণালয়ের নির্ধারণ করে দেওয়া ভাড়ার কারণে প্রতিযোগিতামূলক কম খরচে পণ্য পরিবহন সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত তালিকায় বলা হয়েছে, একটি ২০ ফুট আমদানি বা রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার পরিবহনের ভাড়া ধরা হয়েছে ৩২০ ডলার।

সেই কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, 'জাহাজ ভাড়ার সঙ্গে আনুষঙ্গিক বন্দর ও টার্মিনালের মাশুল যোগ করলে একটি ২০ ফুট আমদানি কনটেইনার এই পথে পানগাঁও পৌঁছাতে খরচ হয় ৫১৯ ডলার। ফিরতি পথে রপ্তানি কনটেইনার পানগাঁও থেকে জাহাজে চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠাতে খরচ হয় ৪০২ ডলার।'

'অথচ রেলপথে এই একই মাপের একটি আমদানি কনটেইনার চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকার কমলাপুর ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) নিতে রেল ভাড়াসহ মোট খরচ হয় ২৪৫ ডলার। রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার কমলাপুর থেকে বন্দরে রেলপথে পাঠাতে খরচ হয় ২১৯ ডলার।'

কয়েকজন ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্টের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে—সড়কপথে চট্টগ্রাম বন্দর কিংবা বেসরকারি কনটেইনার ডিপো থেকে ঢাকা, গাজীপুর বা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কারখানায় একটি ২০ ফুট আমদানি কনটেইনারবাহী গাড়ি প্রাইম মুভারের ভাড়া ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা।

চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশ থেকে যে পরিমাণ আমদানি পণ্যবাহী কনটেইনার আসে এর মধ্যে কয়েকটি কনটেইনার পণ্যসহ বন্দর থেকে সরাসরি প্রাইম মুভারে ঢাকায় কারখানায় নিয়ে যান আমদানিকারকরা।

উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কনটেইনার বন্দরের ভেতরে ইয়ার্ডে খুলে পণ্য ট্রাক কিংবা কাভার্ড ভ্যানে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। বাকি কনটেইনারগুলো জাহাজ থেকে নামিয়ে সরাসরি পাঠানো হয় বন্দরের কাছাকাছি বেসরকারি কনটেইনার ডিপোয়। সেখানে পণ্য সরবরাহ নিয়ে ট্রাকে কিংবা কাভার্ড ভ্যানে ঢাকায় নিয়ে যান আমদানিকারকরা। যেসব কনটেইনার বেসরকারি ডিপোতে নিয়ে খালাস করা হয় সেগুলোর জন্য ডিপো কর্তৃপক্ষ মাশুল আদায় করেন আমদানিকারকদের কাছ থেকে।

ঢাকার কারখানা থেকে রপ্তানি পণ্য ট্রাক কিংবা কাভার্ড ভ্যানে চট্টগ্রামের বেসরকারি ডিপোয় পাঠানো হয়।

ব্যবসায়ীরা জানান, একটি ২০ ফুট কনটেইনারের পণ্য পরিবহনের জন্য দুটি ট্রাক কিংবা কাভার্ড ভ্যানের প্রয়োজন। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে একটি ট্রাক কিংবা কাভার্ড ভ্যানের ভাড়া ১৫ থেকে ২২ হাজার টাকা।

চবক সচিব মো. ওমর ফারুক ডেইলি স্টারকে জানান, তারা পানগাঁও আইসিটিকে গতিশীল করতে সম্প্রতি ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি সভা করেছেন। তাতে ব্যবসায়ীরা মন্ত্রণালয়ের পূর্বনির্ধারিত অত্যধিক জাহাজ ভাড়ার বিষয়টি সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের কাছে এ ব্যাপারে চিঠি দিয়েছে যাতে নির্ধারিত ভাড়ার ওই প্রজ্ঞাপনটি তুলে নেওয়া হয়।

তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ'র পোর্ট অ্যান্ড শিপিংবিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন,‌ 'অতিরিক্ত জাহাজ ভাড়া বড় সমস্যা। এই পথে জাহাজগুলো নিয়মিত চলে না। বিরতি দিয়ে চলে বলে কনটেইনার পরিবহনে সময় বেশি লেগে যায়। পানগাঁও আইসিটি থেকে ঢাকা কিংবা গাজীপুরের কারখানায় পণ্য ট্রাক কিংবা কাভার্ড ভ্যানে পরিবহনের জন্য আরও প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়।'

'চট্টগ্রাম থেকে একদিন বা কম সময়ের মধ্যে সড়ক পথ ব্যবহার করে পণ্য ঢাকায় নিয়ে যাওয়া যায়। এ কারণে ব্যবসায়ীরা নৌপথ ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছেন না,' বলে মন্তব্য করেন তিনি।

নিয়মিত জাহাজ না চালানোর ব্যাপারে জাহাজ পরিচালনাকারী সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর যুক্তি হলো পর্যাপ্ত কনটেইনার না পাওয়া।

করিম শিপিং লাইন এই পথে দুটি জাহাজ পরিচালনা করে। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ক্যাপ্টেন শাহ আলম ডেইলি স্টারকে জানান, দুটি জাহাজই সর্বোচ্চ ১৮৭ একক কনটেইনার পরিবহন করতে পারে। অথচ কখনোই এই সংখ্যক কনটেইনার পাওয়া যায় না।

তিনি আরও জানান, প্রায়ই খুব কম সংখ্যক কনটেইনার নিয়ে চালতে হয় বলে লোকসান হচ্ছে।

পানগাঁও আইসিটিতে কয়েকজন সিএন্ডএফ এজেন্টের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে টার্মিনালটিতে পণ্য খালাসে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের দীর্ঘসূত্রিতা ছিল।

যেমন ল্যাবরেটরি টেস্টের জন্য শতভাগ আইরন শিটবাহী কনটেইনার বুয়েটে পাঠানো হতো। কনটেইনারগুলো পরীক্ষা প্রতিবেদন শেষে ছাড়পত্র পেতে কখনো ৫০ দিনেরও বেশি সময় লেগে যেত বলে অভিযোগ করেন তারা।

পানগাঁওয়ে কাস্টমস কমিশনার শওকত আলী সাগর ডেইলি স্টারকে জানান, এসব হয়রানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, 'এখন সব কনটেইনার ল্যাবরেটরি টেস্টের জন্য পাঠানো হচ্ছে না। পণ্য ছাড় সহজ করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যেই পরিস্থিতির উন্নতি হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Penalty less than illegal gains fuels stock manipulation

While fines are intended to deter future offences, questions remain over their effectiveness if the amount is lower than the illegal gain.

12h ago