ইসলামি ব্যাংকগুলোর আমানত-বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ৪ বছরে সর্বনিম্ন

২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে দেশের ইসলামি ব্যাংকগুলোর আমানত ও বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর্থিক অস্থিতিশীলতা ও সুশাসনের অভাবে মানুষ এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা হারিয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে তাদের আমানত ও বিনিয়োগে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা কমার কারণ—বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, আর্থিক কেলেঙ্কারি, স্বচ্ছতা ও সুশাসনের অভাব।
বাংলাদেশে ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংক আছে। গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে এগুলোর বেশিরভাগ বড় ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কয়েকটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে ছিল।
কিন্তু পটপরিবর্তনের পর এই শিল্প রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হতে শুরু করে। এতে দীর্ঘদিনের ঋণ কেলেঙ্কারিসহ অন্যান্য অনিয়মের চিত্র সামনে আসে এবং অনেক ব্যাংকের দুর্বল আর্থিক অবস্থা দৃশ্যমান হয়।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর এসব ব্যাংকের পর্ষদে রদবদল করা হয়। কিন্তু গ্রাহকের আস্থা ফেরাতে সময় লাগবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের প্রথম প্রান্তিকে ইসলামি ব্যাংকগুলোর বার্ষিক আমানত প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১১ দশমিক ৭১ শতাংশ।
২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে তা কমে ৩ শতাংশে নেমে আসে এবং পরে কিছুটা পুনরুদ্ধার হয়। এরপর ২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে তা কমে প্রায় শূন্য দশমিক ৮০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে একই সময়ের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির হারও কমার প্রবণতা দেখা গেছে।
২০২২ সালের প্রথম প্রান্তিকে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ শতাংশে। এরপর ২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে তা ১০ দশমিক ৮২ শতাংশে নেমে আসে এবং ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে তা আরও কমে ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশে নেমে এসেছে।
সুশাসনের অভাবের প্রভাব
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেন, ২০১৭ সাল থেকে ব্যাংকটি সুশাসনের মূলনীতি থেকে বিচ্যুত হতে শুরু করে।
তিনি মনে করেন, সুশসানের অভাব প্রতিষ্ঠানটিকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে দেয়। গ্রাহকের আস্থা কমায় আমানতকারীরা তাদের অর্থ অন্যত্র সরিয়ে নেয়। এটি শেষ পর্যন্ত ব্যাংকটির চ্যালেঞ্জ বাড়িয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে তারা নানা উদ্যোগ হাতে নিয়েছে।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউজ্জামান বলেন, গ্রাহকের আস্থা সংকটের কারণে আমানত প্রবৃদ্ধি কমছে, গত বছরেও একই প্রবণতা ছিল।
তিনি জানান, চলতি বছরের প্রথমার্ধে তাদের আমানত প্রবৃদ্ধির পতন গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধের মতো বড় আকারের ছিল না।
তার ভাষ্য, 'আমানত কমার হার এখন তুলনামূলকভাবে পরিচালনাযোগ্য পর্যায়ে আছে। গত বছর আতঙ্কে সবাই যেভাবে আমানত তুলে নিচ্ছিল, তা এখন কমেছে। ধীরে ধীরে গ্রাহকের আস্থাও ফিরে এসেছে।'
যেহেতু আমানত প্রবৃদ্ধি কমেছে, তাই সামগ্রিকভাবে বিনিয়োগেও প্রভাব পড়েছে, জানান তিনি।
তিনি মন্তব্য করেন, 'গ্রাহকের আস্থা পুরোপুরি ফেরাতে আরও সময় লাগবে।'
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, ২০২৪ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নির্দিষ্ট গোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বেশ কয়েকটি ব্যাংক বিভিন্ন অফিসিয়াল প্রতিবেদনে তাদের প্রকৃত আর্থিক অবস্থা প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এসব ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে, হয় বিদেশে পাচার করা হয়েছে, নয়তো বেআইনি কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।
ফলে আমানতকারীরা এসব ব্যাংক থেকে তাদের জমানো অর্থ তুলে নিয়েছেন, জানান তিনি।
তার মন্তব্য, ব্যাংকগুলো গ্রাহকের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে, এতে আমানতকারীদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক দেখা দেয়। যার ফলে বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, 'গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত মানুষ টাকা তুলে নিতে তাড়াহুড়ো করেছে। এরপর পরিস্থিতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। মানুষ এখন আর আগের মতো নগদ টাকা তুলতে ব্যাংকের কাউন্টারে ভিড় করছে না।'
'তবে কিছু ইসলামি ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থা কমলেও সার্বিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর আস্থা কমেনি,' বলেন তিনি।
অনেকে তাদের টাকা প্রচলিত ব্যাংকগুলোর ইসলামি ব্যাংকিং শাখাতে স্থানান্তর করেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'উচ্চ মূল্যস্ফীতি আমানত প্রবৃদ্ধির ধীরগতির আরেকটি কারণ।'
দেশের ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংক ছাড়াও ১৬টি প্রচলিত ব্যাংকের ইসলামী ব্যাংকিং শাখা রয়েছে এবং ১১টি ইসলামি উইন্ডোর মাধ্যমে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং সেবা প্রদান করছে।
কী বলছেন নিয়ন্ত্রক ও বিশেষজ্ঞরা
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, দেশের সার্বিক পরিস্থিতির কারণে বিনিয়োগে গতিশীলতা কমায় ব্যাংকিং খাতে আমানত প্রবৃদ্ধি কমেছে।
তিনি বলেন, আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বেশ কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হয় বন্ধ হয়ে গেছে অথবা কার্যক্রম কমিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই ইসলামি ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিল। এতে ব্যাংকগুলোর আমানত ও বিনিয়োগ কার্যক্রম এবং সার্বিক প্রবৃদ্ধিতে মন্দা দেখা দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ২০২২ সালে দুটি ইসলামি ব্যাংকের বড় অনিয়ম এই খাতে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল। এতে গ্রাহকের আস্থা কমে যায়।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক শাহ মোহাম্মদ আহসান হাবিব বলেন, আগ্রাসী ঋণ কার্যক্রমের কারণে ২০২১ সাল থেকে দেশের ইসলামি ব্যাংকগুলোতে ঋণ প্রবাহ অস্বাভাবিকভাবে বেশি ছিল।
তিনি বলেন, 'কিছু ইসলামি ব্যাংকে অনিয়ম ও কেলেঙ্কারির কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক পর্যায়ে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়। ফলে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমতে শুরু করে।'
তিনি বলেন, 'গত বছরের ৫ আগস্টের পর একাধিক প্রতিবেদনে এই ব্যাংকগুলো তীব্র সংকটের তথ্য প্রকাশ করে। এরপর তাদের আমানত ও বিনিয়োগ উভয়ই কমেছে।'
Comments